শনিবার রাতে ফ্যাশন শোয়ে সিন্ধুর মতোই ভারতীয় সাজে মাতিয়েছিলেন মারিন। রবিবার সন্ধ্যায় ফিরে এল রিও-র বিষণ্ণতা।
সিন্ধু-মারিন ম্যাচটা কিছুটা স্টেডিয়ামে বসে, কিছুটা প্লেয়ার্স রুমের টিভিতে দেখলাম রবিবার। হায়দরাবাদ হান্টার্স-চেন্নাই স্ম্যাশার্সের পরেই আমাদের দিল্লি এসার্সের খেলা ছিল বেঙ্গালুরু ব্লাস্টার্সের সঙ্গে। পিবিএলে আমরাই গত বছরের চ্যাম্পিয়ন। আর গত বার থেকেই আমি দিল্লি ফ্র্যাঞ্চাইজির কোচিং টিমে আছি। এ দিন তো টুর্নামেন্ট শুরুর আগে সিন্ধুর সঙ্গে দেখা হতেই ও প্রথমে ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ জানিয়ে ঠাট্টা করে বলল, ‘‘তুমি তো আবার দিদি চ্যাম্পিয়ন টিমের কোচ!’’
একেবারে সিন্ধু বনাম মারিন হাইভোল্টেজ লড়াই দিয়ে টুর্নামেন্ট উদ্বোধন করে পিবিএল-কে এ বার প্রথম গেম থেকেই জমজমাট করে দিয়েছেন উদ্যোক্তারা। বিশ্বের কোথাও কোনও ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্ট এর চেয়ে বেশি ভাল ভাবে আর কী শুরু হতে পারত! আরও মজার ব্যাপার। নিজের শহরে খেলতে নেমে, তা-ও আবার রিও অলিম্পিক্সের পর এই প্রথম, তবু সিন্ধু পুরো গ্যালারির সাপোর্ট পাচ্ছিল না। হায়দরাবাদের মেয়ের গায়ে যে চেন্নাই জার্সি! আর গোটা বিশ্বে পিভির সবচেয়ে বড় অপোনেন্ট ক্যারোলিনা হায়দরাবাদের জার্সি পরা! গাচ্চিবোলি স্টেডিয়ামের গ্যালারি দু’ভাগ হয়ে থাকল গোটা ম্যাচ জুড়ে।
আসলে পরিবেশটাই সম্পূর্ণ আলাদা অলিম্পিক্স বা ওয়ার্ল্ড সুপার সিরিজ ফাইনালসের থেকে। যেমন আজই ধরুন। চারটে টিম চারটে প্লেয়ার্স রুমে তৈরি হচ্ছে। আমি নিজেও দিল্লির প্লেয়ারদের ফাইনাল টিপস দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে কখনও পিভির হায়দরাবাদ প্লেয়ার্স রুমে উঁকি মেরে এলাম। আবার কোনও সময় ক্যারোলিনার চেন্নাই ড্রেসিংরুমে ঢুঁ মারলাম। অলিম্পিক্স বা দুবাইয়ের ওয়ার্ল্ড সিরিজ ফাইনালসের মতো সেই প্রচণ্ড সিরিয়াসনেস বা ভয়ঙ্কর চাপের পরিস্থিতি খুঁজতে গেলে কিন্তু ভুল হবে এখানে।
ম্যাচটাও অনেকটা সে রকম হল। স্কিলের হাই স্ট্যান্ডার্ডে না হোক, দুই প্লেয়ারের মেজাজ, বডি ল্যাংগুয়েজে। নইলে আমি নিশ্চিত, প্রথম গেম ৮-১১ হারার পর দ্বিতীয় গেমে তিনটে ম্যাচ পয়েন্ট বাঁচিয়ে ১৪-১২ জিতে ১-১ করার পরেও চূড়ান্ত গেমে সিন্ধু ওই রকম ২-১১ পয়েন্টে বিনা লড়াইয়ে ম্যাচ হারত না। আসলে যত বিশাল প্রাইজমানিই পিবিএলে থাক না কেন, এটা তো একটা বিনোদন টুর্নামেন্ট। আমি বলছি না, বিনোদন ব্যাপারটা খারাপ। খেলা মানেই তো আসলে বিনোদন। শুধু দর্শকদের জন্য নয়, প্লেয়ারদের জন্যও। যখন নিজে খেলতাম কোচেদের মুখে অহরহ শুনেছি, এখন নিজে কোচ হয়েও ছেলেমেয়েদের প্রায়ই বলি সেই কথাই— খেলাটাকে উপভোগ করো।
অলিম্পিক্স হচ্ছে অলিম্পিক্স। তার ফাইনাল, এমনকী ওয়ার্ল্ড সিরিজ ফাইনালসের গ্রুপেও সিন্ধু-মারিন লড়াই, আর এখানে ওদের লড়াই কখনও এক হতে পারত না। হয়ওনি। সোমবারই আবার আওয়াধি ওয়ারিয়র্সের সাইনা নেহওয়ালের সঙ্গে মারিনের লড়াই। ফের একটা মেগা ম্যাচ। তা সত্ত্বেও মনে রাখতে হবে, ১১ পয়েন্ট গেমের ফর্ম্যাটে বিশ্বের টপ প্লেয়াররা কেউই খেলতে অভ্যস্ত নয়।
তাই আজ সিন্ধু-মারিন, দু’জনেই হয়তো সমান সমস্যায় পড়েছিল। আমার মতে র্যাপিড চেস বা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের মতো এখানেও ম্যাচ চলাকালীন প্লেয়ারের ভাবার সময় খুব কম। যা-ই গেমপ্ল্যান পাল্টাতে হোক, তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাই দ্বিতীয় গেমের মাঝমাঝি গড়ানোর আগে পর্যন্ত বড় র্যালি প্রায় হচ্ছিলই না। তার পর থেকে যেন দু’জনকে খানিকটা সড়গড় দেখাল এই ফর্ম্যাটে।
তার মধ্যেই অবশ্য সিন্ধুর সেই চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া জাম্পিং স্ম্যাশ, বুদ্ধি করে তার সঙ্গে হাফ স্ম্যাশ মেশানো। মারিনের নিখুঁত ড্রপ শট, বিপক্ষকে ধন্দে ফেলে দেওয়া প্লেসিং শটের ঝলসানি অনেক বার চমকে দিয়েছে। বিশেষ করে দ্বিতীয় গেমে। শেষ গেমে ৫২ শটের একটা অনবদ্য র্যালি দেখলাম ঠিকই, কিন্তু সেটা না হলেও ওই গেমে মারিনের জয় বা সিন্ধুর হার দু’টোর কোনওটাই আটকাত না। মারিন তখন শুধু ম্যাচ নয়, সিন্ধুকেই কব্জা করে ফেলেছিল।
বরং দ্বিতীয় গেমে সিন্ধুকে ব্যাক-টু-ব্যাক একটা জাম্পিং স্ম্যাশ মারতে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছি। ঘণ্টায় প্রায় তিনশো কিলোমিটার স্পিড ছিল তাতে! ওই স্ম্যাশের সময় পিভির হ্যান্ড স্পিড, জাম্প, র্যাকেট স্পিড, ফিনিশিং দেখে আমার নিজেকেই ভারতীয় মেয়ে হিসেবে ভাবতে গর্ব হচ্ছিল। আমার খেলাটাই আমাদের দেশের এই ইয়ং মেয়েটা খেলে। কিন্তু সেটাকে কোন লেভেলে-ই না তুলে নিয়ে গিয়েছে এই ক’মাসেই!
সিন্ধু সত্যিই বিশ্ব ব্যাডমিন্টনের জিরাফ। নামটা দিয়ে ভুল করিনি!