শ্রীবৎস গোস্বামী ও ঈশান পোড়েল।
এক জন জোর দিচ্ছেন বৈচিত্রে। অন্য জন দ্রুত ধাতস্থ হতে চাইছেন পরিবেশের সঙ্গে।
প্রথম জনের এটাই প্রথম আইপিএল। দ্বিতীয় জন এক যুগ আগে প্রথম আইপিএলেও খেলেছিলেন।
এক জন পেসার। অন্য জন উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান।
প্রথম জন অতি অবশ্যই ঈশান পোড়েল। দ্বিতীয় জন অবধারিত ভাবেই শ্রীবৎস গোস্বামী।
এ বারের আইপিএলে ঈশান খেলবেন কিংস ইলেভেন পঞ্জাবের হয়ে। শ্রীবৎসের গায়ে যথারীতি সানরাইজার্স হায়দরাবাদের জার্সি।
বাংলার দুই ক্রিকেটারের মতো আইপিএলেও এ বার প্রবল বৈপরীত্য। প্রবল গরমে নয়, শরতে এ বার কুড়ি-বিশের মহাযুদ্ধ। দেশের মাটিতে নয়, মরুরাজ্যে বসতে চলেছে আসর। আর তাই এত বছরের চেনা ধারণা, পরিকাঠামো, ছক ভেঙে নতুন ভাবে তৈরি হওয়ার পালা ফ্র্যাঞ্চাইজিদের। অদৃশ্য করোনভাইরাসের বিরুদ্ধেও জারি থাকছে যুদ্ধ, নিতে হচ্ছে প্রবল সতর্কতা। একইসঙ্গে মন রাখতে হচ্ছে বাইশ গজে।
আমিরশাহির উইকেট নিয়েও থাকছে ধন্দ। ঈশান যেমন আনন্দবাজার ডিজিটালকে সোজাসুজি বললেন, “দুবাইয়ের উইকেট টিভিতে যা দেখেছি, তাতে মন্থর মনে হয়েছে। ফলে, পেসারদের কাছে বৈচিত্র খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। স্লোয়ার বল, স্লোয়ার বাউন্সার, ইয়র্কার। এগুলো দ্রুত আয়ত্তে আনতে হবে। দুবাইয়ে গত বারের এশিয়া কাপে দেখেছি যে বেশি পেসে বল করা, গতিতে জোর দেওয়া কোনও ফ্যাক্টর হচ্ছে না। তফাত গড়ছে গতির হেরফের। ফারাক গড়ছে বৈচিত্র। এক পেসে সব বল করা যাবে না। মিশিয়ে বল করতে হবে। কখনও ইয়র্কার, কখনও স্লোয়ার, এই ভ্যারিয়েশনও দরকার। এই ফরম্যাটে ওভারের ছ’টা বল ছয় রকম করতে হবে। সেই ক্ষমতা রাখতে হবে যে ওভারের প্রত্যেকটা বল আলাদা হচ্ছে। এগুলো মাথায় রাখছি।”
আরও পড়ুন: করোনা আক্রান্ত রাজস্থান রয়্যালসের ফিল্ডিং কোচ
শ্রীবৎস বললেন, “দুবাইয়ে আগে খেলিনি। ফলে ওখানে গিয়েই প্রস্তুতি নিতে হবে। দেখতে হবে, বল ব্যাটে কেমন আসছে, উইকেট বাউন্স কতটা রয়েছে। কিপিং করে বুঝব বল কতটা ফ্লাই করছে, ব্যাটিং করে বুঝব কত তাড়াতাড়ি আসছে। কলকাতায় বসে এগুলো আন্দাজ করা সম্ভব নয়। তবে লোকজনকে জিজ্ঞাসা করে যা বুঝেছি তাতে একটু লো বাউন্সই থাকবে। ম্যাচ যত গড়াবে বাউন্স তত কমবে। শুকনো হবে উইকেট। আর হট কন্ডিশনে খেলা তো। তবে প্রথম দিকে বল যাবে। ওপেনার হিসেবে ব্যাট করলে আমি তো পেসারদেরই সামনে পাব। ফলে শট নেওয়া যাবে।”
এ বারই প্রথম আইপিএলের মঞ্চে খেলবেন ঈশান, গায়ে চাপাবেন পঞ্জাবের জার্সি। —ফাইল চিত্র।
২০০৮ সালের উদ্বোধনী আইপিএল থেকে খেলছেন শ্রীবৎস। এ বার প্রথম এগারোয় কি নিয়মিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন? বিশেষ করে ডেভিড ওয়ার্নার, জনি বেয়ারস্টো কবে যোগ দেবেন, তা এখনও পরিষ্কার নয়। অস্ট্রেলিয়া বনাম ইংল্যান্ডের সিরিজ শেষে আমিরশাহি পৌঁছবেন তাঁরা। তার উপর কোয়রান্টিনে থাকার ব্যাপারও আছে। শ্রীবৎস অবশ্য অত দূর ভাবছেন না। বললেন, “পরিষ্কার ছবি এখন মিলবে না। শুনছি, ফ্র্যাঞ্চাইজির তরফে কোয়রান্টিনের মেয়াদ কমাতে বলা হবে। এখান থেকে ভেবে লাভ নেই। পরিস্থিতি বদলাচ্ছে প্রতি দিন। সেই হিসেবে তো বাংলায় অরুণ-স্যার কোচ থাকবেন না শুনছি। আবার সেটাও পাল্টে যেতে পারে। তাই একদম শেষ মুহূর্তেই বোঝা যাবে কে এসেছে, কে আসেনি। আর আমি দলের তৃতীয় কিপার। তাই কতটা সুযোগ পাব, তা মাথায় রাখছি না। তৈরি থাকতে চাইছি।”
তৈরি থাকতে চাইছেন ঈশানও। সেই লক্ষ্যে প্রাথমিক ভাবে ট্রেনিং শুরুও করে দিয়েছেন। আপাতত রোজই হাত ঘোরাচ্ছেন নেটে। স্বাস্থ্যবিধি মেনেই করছেন বোলিং। যতটা সম্ভব অভ্যস্ত হয়ে উঠতে চাইছেন ‘নিউ নরমাল’ জীবনের সঙ্গে। তবে আসল প্রস্তুতি যে আমিরশাহিতেই হবে, সেটা মেনে নিচ্ছেন। তাঁর কথায়, “সপ্তাহ দেড়েক ধরে বাড়ির আশপাশে বা কলকাতায় যেখানে সুযোগ পাচ্ছি, নেট করছি। কোভিড আতঙ্কের মধ্যে তো আর পুরোপুরি নেট করা সম্ভব নয়। নকিং, ব্যাটিং, ফিল্ডিংয়ের জন্য ন্যূনতম চার-পাঁচজনকে ডাকছি। এর বেশি কাউকে বলছি না। আমারও তো একটা দায়িত্ব থাকে। তাই যেটুকু করা যাচ্ছে, সেটুকুতেই প্র্যাক্টিস সারছি। তাছাড়া আবহাওয়া, পরিবেশ, মাঠ, উইকেট— এগুলো তো এখানে বসে জানতে পারবও না। ওখানে গিয়েই পরিচিত হতে হবে। সব কিছুর সঙ্গে অ্যাডডাস্ট করার মতো সময় আমরা পাচ্ছি ওখানে। তাই নিজেকে চাপে রাখছি না। ওখানে গিয়ে অনেক কিছু শিখতেও পারব। সেটা যত দ্রুত হবে, আমার পক্ষে তত উপকারী হবে।”
আরও পড়ুন: ইউরোপের সেরা হতে চাই, বলছেন ব্রাজিলীয় তারকা
কোভিড অতিমারির জেরে কয়েক মাস স্তব্ধ ছিল খেলার দুনিয়া। সেখান থেকে আইপিএলে নেমে পড়া কতটা চ্যালেঞ্জের? ঈশান বললেন, “ছন্দে ফেরা সকলের কাছেই চ্যালেঞ্জের। আমার কাছেও তাই। আর ছন্দে ফেরাটা বিচার করা সহজ নয়। এক জন বোলার ছন্দে থেকেও আইপিএলে মার খেয়ে যেতে পারে। মানসিকতা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি যদি ভাবি কোভিডের পরে খেলা খুব কঠিন হতে চলেছে। তবে তাই হবে। আবার যদি ভাবি, ক্রিকেট খেলাটাই তো খেলতে যাচ্ছি আমিরশাহিতে, তা হলে এক রকম। এমন ভাবলে ব্যাপারটা মোটেই শক্ত থাকবে না। যদি ভাবি, কোভিডের সময় কিছু করিনি, বাড়িতে থেকেছি, তার পর খেলতে এসেছি, তা হলে নেগেটিভ চিন্তাই সঙ্গী হবে। এই মুহূর্তে কোনও নেতিবাচক মানসিকতা আনতে চাইছি না।”
আইপিএল মানে ক্রিকেট-উৎসব। গ্যালারির উন্মাদনা বাড়িয়ে তোলে অ্যাড্রিনালিন প্রবাহ। কিন্তু এ বার তো সেই আবহই থাকছে অনুপস্থিত। শ্রীবৎস বললেন, “আমি প্রথম আইপিএল থেকে খেললেও খুব বেশি ম্যাচে নামিনি। ফলে, গ্যালারির উন্মাদনা নিয়ে আমার কোনও উৎসাহ নেই। বরং ফাঁকা মাঠে খেললেও অসুবিধা হবে না। সারা বছর বাংলার হয়ে দর্শকহীন গ্যালারিতেই তো খেলি। একমাত্র আইপিএলেই দর্শকের সামনে খেলার ব্যাপার থাকে। তবে যাঁরা তারকা তাঁদের কাছে ফাঁকা গ্যালারি প্রভাব ফেলতে পারে। একটা-দুটো ম্যাচ না গেলে তা ধরা সম্ভব নয়।” ইংল্যান্ডে হওয়া টেস্ট সিরিজে অবশ্য দর্শকদের অনুপস্থিতি সে ভাবে টের পাননি তিনি। বললেন, “ওখানে ক্যামেরা খুব স্মার্টলি খেলা দেখিয়েছে। বল সীমানায় পৌঁছলে তখনই সাধারণত ফাঁকা গ্যালারি চোখে পড়েছে। আর টিভিতে কমেন্ট্রি চলছে বলে তফাত ধরে পড়েনি। মাঠে নেমে খেললে অবশ্যই অন্যরকম লাগবে। তবে মানুষের স্বভাব হল ধীরে ধীরে তার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা। আর ক্রিকেটাররা সবাই পেশাদার। যদি অন্যরকম লাগেও, তা হলেও প্রত্যেকের কেরিয়ার আইপিএলের সঙ্গে যুক্ত। একটা হার বা জয়ের গুরুত্ব অনেক। আউট হয়ে কেউ তো আর বলতে পারবে না যে ক্রিকেট না থাকায় ফিরতে হয়েছে! খেলোয়াড়দের মন থেকে এটাকে সরাতেই হবে।”
সানরাইজার্সের জার্সিতে আক্রমণাত্মক শ্রীবৎস। —ফাইল ছবি।
একই সুরে গলা মেলালেন ঈশান পোড়েল। তাঁর মতে, “একজন ক্রীড়াবিদকে যে কোনও পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয়। আমাদেরও হবে। দেশে হলে অবশ্যই প্রচুর মানুষ আসতেন। উন্মাদনা থাকত। আমি উপভোগ করার চেষ্টাই করতাম। চাপ হিসেবে নিতাম না। অনেক দর্শক থাকতে আলাদা অনুভূতি হত। এখন সেটা হবে না। এখন যে অনুভূতি হবে, তা ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলার মতো। অল্প দর্শক থাকে বা থাকে-না ডোমেস্টিক ক্রিকেটে। তাই অসুবিধা হবে না। আর একজন ক্রিকেটার মাঠে নামলে বাইরের বিষয় নিয়ে ভাবে না।”
কিংস ইলেভেনের কোচ এ বার অনিল কুম্বলে। টেস্টে ছশোর বেশি উইকেটের মালিকের থেকে কী শিখতে চান ঈশান? বললেন, “এটা আমার প্রথম আইপিএল। পুরোটাই শেখার জায়গা। আর কোনও একজনের থেকে শিখতে নয়, সবার থেকেই শিখতে চাই। যেখানে পারব, সবটাই শেখার চেষ্টা করব। বেশি শিখে নিলে আবার নিজের জন্য যাতে চাপ না হয়, সেটাও দেখতে হবে! যেন গুলিয়ে না যায়। যেগুলো আমার কাজে আসবে সেগুলো আয়ত্তে আনার লক্ষ্য রয়েছে। অনেক অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরতে চাই। অনিল স্যার বা জন্টি রোডসের কাছ থেকেই নয়, সবার কাছ থেকেই যা নেওয়ার, তা নিতে চাইব।”
আরও পড়ুন: ভারতীয় স্পিনের ভবিষ্যৎ কি অন্ধকারে? আনন্দবাজারের মুখোমুখি বেঙ্কটপতি রাজু
শ্রীবৎস গোস্বামী আবার ব্যক্তিগত কোনও লক্ষ্য রাখছেন না। তাঁর সাফ কথা, “সানরাইজার্স খুব ভাল ফ্র্যাঞ্চাইজি। ম্যানেজমেন্ট খুব ভাল। আমি শুধু নিজেকে তৈরি করায় মন দিই। যখনই ম্যাচ পাব, সেরাটা উজাড় করে দেব। আমার সুযোগ কবে আসবে, তা জানি না। তার জন্য অপেক্ষা করব।” কোভিডের কারণে গত মরসুমের পারফরম্যান্স আইপিএল মঞ্চে আত্মবিশ্বাস জোগাবে না বলে মনে করছেন শ্রীবৎস। বললেন, “আগের মরসুমের কনফিডেন্স এখন কাজে আসবে না। এতদিন কেটে গিয়েছে। সাধারণ, মার্চে ঘরোয়া টি-টোয়েন্টির পর আমরা আইপিএল খেলতে চলে যেতাম। এ বার অনেক গ্যাপ হয়ে গিয়েছে। যাঁরা ভাল বা খারাপ ফর্মে ছিল, তাঁরা সবাই শূন্য থেকে শুরু করবে। আর টি-টোয়েন্টিতে প্রতিটা কাজই কঠিন। বোলারদের যেমন চার ওভার বল করতে হলেও তা সহজ নয়। আবার যাঁরা কিপার, তাঁরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ওপেনও করে। ফলে দুই ইনিংসের ফাঁকে খুব কম সময় মেলে। দেরিতে ওভার শেষ করলে তা আরও কমে যায়। কিপিং গ্লাভস খুলে দ্রুত ব্যাটিংয়ের জন্য রেডি হতে হয়। ডিফিকাল্ট জব। তবে এটা অনেক বছর ধরে করছি। সিস্টেমে ঢুকে পড়েছে আর কী!”
রঞ্জিতে সুইংয়ের কারিকুরিতে নজর কেড়েছিলেন ঈশান। কিন্তু আইপিএলে তো অন্য রকমের খেলা। ডট বলই এখানে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একজন উঠতি পেসার হিসেবে সুইংয়ের সঙ্গে আপস করতে হবে না তো? ঈশান বললেন, “না, না কমপ্রোমাইজ কেন। বিশ্বের যে কোনও ব্যাটসম্যানেরই যে কোনও কন্ডিশনে সুইংয়ে অস্বস্তি হয়। সুইং হলে সব জোরে বোলারই খুশি হবে। এর সঙ্গে সমঝোতার প্রশ্নই নেই। হ্যাঁ, এখানে স্টক ডেলিভারি বাড়াতে হবে। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে কখনও ইয়র্কার, কখনও স্লোয়ার, কখনও নাকল, কখনও ব্যাক অফ লেংথ বল করতে হবে। ইয়র্কারেরও রকমফের রয়েছে। সেটাতে রপ্ত হতে হবে। আর উইকেট আশা করছি ভাল থাকবে শুরুতে। তিন মাঠে পঞ্চাশ দিনের বেশি সময় ধরে চলবে প্রতিযোগিতা। তাই ন্যাড়া বা পাটা উইকেট দিলে পরের দিকে তা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। তখন পরের দিকে কোনও দলকে একশো তুলতেও হাঁফাতে হবে। আশা করছি, তেমন হবে না।”
১৯ অগস্ট রওনা দুই ক্রিকেটারেরই। তবে পুরোপুরি ট্র্যাভেল প্ল্যান এখনও না পাওয়া শ্রীবৎস বললেন, “করোনাভাইরাসের পর ক্রিকেট ফিরছে। আমাদের সমস্ত সুরক্ষা বিধি মানতে হবে। ওখানে গিয়ে সময় পাব তৈরি হওয়ার জন্য। সব নিয়ম মানলে মনে হয় না অসুবিধা হবে।” আমিরশাহিতে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন তিনি। মাঠের বাইরে একাকিত্ব যাতে গ্রাস না করে।
একজনের লাল-সাদা। অন্যজনের কমলা। একজন পঞ্জাবের। অন্যজন হায়দরাবাদের। কলকাতা নাইট রাইডার্সের না হলেই বা, দু’জনেই বাংলার!