স্মৃতি: সেই মাসাইমারা অভিযান। রয়েছেন শিবশঙ্কর, ধোনি (লাল গেঞ্জিতে)।
মহেন্দ্র সিংহ ধোনি নামটা শুনলে আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে লম্বা চুলের, শক্তপোক্ত, ভয়ডরহীন একটা ছেলের মুখ। যাকে আমরা ডাকতাম ‘টারজান’ নামে। আর মনে পড়ে ২০০৪-এ জ়িম্বাবোয়ে-কিনিয়া সফর। ভারতীয় ‘এ’ দলের হয়ে খেলতে গিয়েছিলাম আমরা। এই সফর থেকেই উত্থান ধোনির।
সেই সময়ে আফ্রিকার কোনও দেশে যেতে গেলে ইয়েলো ফিভারের টিকা নিতে হচ্ছিল। চেন্নাই থেকে আমাদের উড়ান ধরার আগে সকলকে তাই টিকা নিতে হত। ধোনি কিছুতেই নেবে না। সে দিন জেনেছিলাম, ইঞ্জেকশনে ওর খুব ভয়। সবার শেষে টিকা নেওয়ার সময় চিৎকারও করছিল। সম্ভবত একমাত্র জিনিস, যাতে ভয় পেত মহেন্দ্র সিংহ ধোনি।
আমার আর ধোনির, দু’জনেরই সেটা ছিল প্রথম বিদেশ সফর। বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন-সহ অনেক কিছু সম্পর্কেই কোনও ধারণা ছিল না। আমাদের দু’জনকে বিমানবন্দরে ‘গাইড’ করেছিল রোহন গাওস্কর। কিনিয়াতে সাদা বলের ক্রিকেটে রুদ্রমূর্তিতে দেখা গিয়েছিল ধোনিকে। নাইরোবি জিমখানা মাঠের বাইরে বল ফেলে দিয়েছিল। ওয়ান ডে ম্যাচগুলোতে ওপেন করছিল ও। সঙ্গী গৌতম গম্ভীর। ফাইনালে আমরা মিসবা-উল-হকের পাকিস্তানকে হারাই। ওয়ান ডে সিরিজে দু’টো সেঞ্চুরি করে ও ছিল সর্বোচ্চ স্কোরার।
আরও খবর: ‘কোলে সরফরাজের ছেলে, ওই একটা ছবিই ধোনিকে পাকিস্তানে জনপ্রিয় করে তুলেছিল’
ওই সময় থেকেই কিন্তু উইকেটের পিছনে দাঁড়িয়ে মাহি বোলারদের দারুণ ভাবে পরামর্শ দিত। পরবর্তীকালে কুলদীপ, চহাল থেকে শুরু করে বুমরা, অনেক বোলারই যেটা বলেছে। আমাকে সেই সফরে অনেক মূল্যবান পরামর্শ দিয়েছিল স্টাম্পের পিছন থেকে। আমাদের কোচ ছিলেন সন্দীপ পাটিল। উনিও ধোনিকে ‘টারজান’ নামেই ডাকতেন। রিসর্টে থাকলে কোচ নিজে রান্না করে খাওয়াতেন। প্রায় সব কিছুই রান্না করতে পারতেন উনি। মাহি খেতে ভালবাসত। আর সব সময় ওর পকেটে থাকত চকোলেট।
সব চেয়ে মজা হয়েছিল মাসাইমারার জঙ্গলে বেড়াতে গিয়ে। দারুণ জমেছিল আমাদের সাফারি। তবে কিছুটা উদ্বেগও তৈরি হয়েছিল। আমাদের বলে দেওয়া হয়েছিল, কোনও শব্দ না করতে। কিন্তু হাতি দেখে উত্তেজনায় শব্দ করে ফেলেছিল ধোনি। হাতিও ধেয়ে আসতে শুরু করে। আমাদের সঙ্গে পাকাপোক্ত ড্রাইভার ছিল। দ্রুত গাড়ি স্টার্ট দিয়ে সরে এল। হাতিও আর তাড়া করেনি। সে দিন জঙ্গলে পরিস্থিতি সামান্য গুলিয়ে ফেলা তরুণই পরবর্তী কালে পরিস্থিতি সামলানোর মাস্টারে পরিণত হল। ব্যাট হাতে ভয়ডরহীন ভাবে অনিল কুম্বলের মতো বোলারকেও ওড়াতে দেখেছি। বোলারের নাম কী, সে সব দিকে ও তাকাতই না। আবার কলকাতায় আমার বাড়িতে এসে মোটরবাইক নিয়ে রাস্তায় বেরিয়েছে। পিছনের সিটে বসে ঘুরেছি আমি। তখন কিন্তু একদম সাবধানি ড্রাইভার। পরবর্তীকালের ফিনিশারের মতো।
ধোনির রুমমেট হওয়ার অভিজ্ঞতাও আমার আছে। এ রকম অমায়িক সঙ্গী আর পাওয়া যাবে না। বড় বড় চুল ছিল বলে স্নান করতে সময় লাগত ওর। নানা রকম শ্যাম্পু থাকত ওর ব্যাগে। তার পর বেশ খানিক্ষণ ধরে চুল শুকোতেও হত। তাই সব সময় আমাকে বলত, আগে তুমি স্নান করো। আমার তো অনেক সময় লাগে। খ্যাতির চূড়োয় উঠেও কিন্তু মানুষটা পাল্টায়নি। ইডেনে খেলতে এলে আমি দেখা করতে গিয়েছি আর এমনও হয়েছে, ড্রেসিংরুমের সামনে দাঁড়িয়ে ঘণ্টাখানেকও আমরা গল্প করেছি।
টারজান, সব কিছুর জন্য ধন্যবাদ!
(লেখক বাংলার প্রাক্তন জোরে বোলার। ভারত ‘এ’ এবং জাতীয় দলে ধোনির সফরসঙ্গী হয়েছেন।)