সানগ্লাস। কালো পোশাক। নিখুঁত কোঁকড়ানো চুল। কমলা উত্তরীয়। চোখ ধাঁধানো নাচ।
কেকেআরের লোগো আঁকা সাদা টি-শার্ট। ঢোলা জিন্স। একমাথা অবিন্যস্ত কালো চুল। ফ্লাইং কিস।
প্রথম জন, হৃতিক রোশন। যিনি মঙ্গলবারের যুবভারতীকে উত্তাল করে দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় জন তার চব্বিশ ঘণ্টা পর ইডেন মাতিয়ে দিলেন। আর যেন বুঝিয়ে দিলেন, হৃতিক এই শহরে ক্ষণিকের অতিথি হিসেবে প্রচুর ভালবাসা পেতে পারেন। কিন্তু এই শহরটা তাঁর ছিল, আছে, থাকবে।
শুরুটা হয়েছিল সন্ধে সাতটা নাগাদ, একটা টুইট দিয়ে। ‘এখন আমি আমার শহরে...কলকাতা। শহরটাকে প্রচণ্ড ভালবাসি।’
আটটা বেজে কয়েক মিনিট সবে হয়েছে। মর্নি মর্কেল ফিরিয়ে দিয়েছেন মুম্বই ওপেনারকে। উইকেটের উচ্ছাসের মধ্যে নতুন করে ফেটে পড়ল ইডেন। কারণ? বি ব্লকের উপরে ভিআইপি বক্সের ব্যালকনিতে বেঙ্কি মাইসোর-জয় মেটা-ঊষা উত্থুপদের মাঝে খুব চেনা, খুব প্রিয় সেই অবয়বের আবির্ভাব।
শাহরুখ খান!
সঙ্গে সঙ্গে হাজারো ক্যামেরার ফ্ল্যাশ, তাঁর দিকে অজস্র মানুষের হাতছানি, কানায় কানায় ভরা ইডেন জুড়ে ‘শাহরুখ...শাহরুখ’ প্রতিধ্বনি। ম্যাচ শেষেও যে উত্তেজনা শেষ হয়নি। শাহরুখ তাঁর প্রায় কোমর-সমান ছোট ছেলেকে নিয়ে গোটা মাঠ ঘুরেছেন আর মধ্যরাত পেরোতে চলা ইডেনের ভিড় হুমড়ি খেয়ে পড়েছে পিতা-পুত্রকে আর একটু কাছ থেকে দেখার জন্য।
রিইউনিয়ন বটে!
রিইউনিয়ন, প্রাণোচ্ছল একটা শহরের সঙ্গে তার প্রাণশক্তির অন্যতম উৎসের। রিইউনিয়ন, এক বাদশার সঙ্গে তাঁর চির-মন্ত্রমুগ্ধ ভক্তদের। রিইউনিয়ন, শব্দমুখর এক জাতির সঙ্গে তার সুনির্দিষ্ট কণ্ঠস্বরের। রিইউনিয়ন, একটা অদম্য শহরের স্পিরিটের সঙ্গে সেই অদৃশ্য স্পিরিটের মূর্ত প্রতীকের।
শাহরুখ খানের সঙ্গে তাঁর কলকাতার!
যে পুনর্মিলন নিঃসন্দেহে আরও মধুর করে দিলেন গৌতম গম্ভীররা, চ্যাম্পিয়নের মতোই আইপিএল আট অভিযান শুরু করে। কিন্তু যে পুনর্মিলনের মাধু্র্য শুধু ওই জয়টায় সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না। রাখা যাবে না কারণ, শাহরুখের সঙ্গে কলকাতার সম্পর্ক হার-জিতের মতো সাধারণ মাপকাঠি দিয়ে বিচার্য নয়। আট বছরে পা দেওয়া সম্পর্কটা ও সবের অনেক ঊর্ধ্বে।
কলকাতার সঙ্গে শাহরুখ খানের সম্পর্কের সূচনায় যদি থেকে থাকে আশা-ভাল লাগা-প্রত্যাশা মেশানো প্রথম প্রণয়ের মিষ্টতা, তা হলে সৌরভ-বিদায়ের জেরে তার পরপরই এসেছে ক্ষুব্ধ বিহ্বলতার তেতো স্বাদ। এই ইডেনে বসেই শাহরুখকে দেখতে হয়েছে, কলকাতা নাইট রাইডার্স খেলছে কিন্তু ফাঁকা গ্যালারির কলকাতা প্রবল প্রতিবাদের নীরব স্লোগান তুলছে। এই ইডেনে বসেই শাহরুখকে দেখতে হয়েছে, ঘরের টিমকে ভুলে কলকাতা গলা ফাটাচ্ছে পশ্চিম ভারতের কোনও এক ফ্র্যাঞ্চাইজির জন্য। দেখতে হয়েছে, ঘরের মাঠেই তাঁর টিম প্রবল অস্তিত্ব সঙ্কটে!
সেই বিদ্বেষ অবশ্য ভুলে গিয়েছে কলকাতা। ভুলিয়ে দিয়েছেন শাহরুখ, ভুলিয়ে দিয়েছে শাহরুখের টিম। যে শহর কেকেআর থেকে ‘কলকাতা’ শব্দটা বাদ দিয়ে দেওয়ার আওয়াজ তুলেছিল, সেই শহরই আবার এসেছে ইডেনে। এসেছে, সোনালি-বেগুনির ভিড়ে। এসেছে, আর আওয়াজ তুলেছে টিম কলকাতার জন্য। হাজারে-হাজারে এসেছে, ট্রফি জয়ের উৎসবে শামিল হওয়ার আনন্দে। এসেছে, শাহরুখের সঙ্গে হাসতে, নাচতে, গাইতে, শহরের স্পিরিটটা নতুন করে সেলিব্রেট করতে।
সাত বছরে একটু একটু করে তৈরি হওয়া আবেগের সেই কোলাজ বোধহয় পূর্ণতা পেল বুধবারের ইডেনে। যে দিন বৃষ্টির চোখরাঙানি উপেক্ষা করে, সপ্তাহের মাঝখানের ব্যস্ততা উড়িয়ে সত্তর হাজারের ইডেন ভরিয়ে দিল কলকাতা। আর তার চেয়েও তাৎপর্যের, যে দিন শাহরুখ নিজে সেই প্রেম-অপ্রেমের সম্পর্কটাকে খুব সহজ স্বীকৃতি দিলেন। বলে দিলেন, ‘‘যখন দাদা আমার টিমে ছিল, যখন আমরা প্রাণপণ চেষ্টা করেও ভাল পারফর্ম করতে পারছিলাম না, তখনও কলকাতা আমার পাশে ছিল। কলকাতা আমাকে যা দিয়েছে, আমি কোনও দিন ভুলতে পারব না। আমার ছোট ছেলেটাকে আজ কেন নিয়ে এসেছি জানেন? নিয়ে এসেছি ওকে চিনিয়ে দেওয়ার জন্য যে, পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভালবাসা তুমি এখানেই পাবে!’’
সত্যিই তো, আর কোন শহর এই মানুষটাকে এত বছর ধরে, এত কিছু দিতে পেরেছে? যে শহরে তাঁর জন্ম, সেই দিল্লি পারেনি। যেখানে তাঁর ‘এসআরকে’ হয়ে ওঠা, সেই মুম্বই তো তাঁর জন্য বরাদ্দ রেখেছে চরম অসম্মান। মস্কো, বার্লিন, নিউইয়র্ক, প্যারিস— এই শহরগুলো তাঁকে দু’হাত ভরে ভালবাসা নিশ্চয়ই দিয়েছে। কিন্তু নিছক তারকা-পুজোর সীমানা পেরিয়ে একজনকে একেবারে নিজের করে নেওয়া?
ওটা বোধহয় কলকাতাই পারে!
ছবি উৎপল সরকার ও পিটিআই