Salim Durani

সৌরভ আছে বলেই এই বোর্ডের কাছে প্রত্যাশা বেশি: সেলিম দুরানি

মুছে যাওয়া দিনগুলো এখন পিছু ডাকে প্রায়শই। বাইশ গজের কত ঘটনা, কত স্মৃতি। যার সবই ক্রিকেট-রোমান্টিকতার অঙ্গ। এখন অবশ্য সঙ্গী কঠোর বাস্তবতা। দিন চলে বোর্ডের দেওয়া পেনশনের টাকায়।

Advertisement

সৌরাংশু দেবনাথ

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০২০ ১৫:১২
Share:

সেলিম দুরানি। তখন ও এখন।

ভারতীয় ক্রিকেটের ‘প্রিন্স সেলিম’ তিনি। মহিলামহলে ছিলেন দারুণ জনপ্রিয়। ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে আকর্ষণীয়। গ্ল্যামারের ঝলমলানিতে ঝলসে যেতেন ভক্তরা।

Advertisement

সোনালি সেই দিনগুলো ফেলে এসেছেন অনেক আগে। তবে বার্ধক্য থাবা বসাতে পারেনি ৮৫ বছর বয়সেও।

ইনি সেলিম দুরানি। আফগানিস্তানে জন্মানো একমাত্র ভারতীয় ক্রিকেটার। এক সময় ‘পাবলিক ডিমান্ড’ মেনে ছয় হাঁকাতেন। বল উড়ে যেত গ্যালারিতে। হাততালিতে ফেটে পড়ত মাঠ। রাজকীয় হাবভাবে জাগাতেন সমীহ। এমনই তারকাসুলভ ভাবমূর্তি ছিল যে, সত্তরের দশকে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্ট দলে তাঁকে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছিল বোর্ড!

Advertisement

আরও পড়ুন: সচিন-সৌরভকে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে খেলতে দেননি রাহুল দ্রাবিড়!​

১৯৬০ থেকে ১৯৭৩, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। ২৫.০৪ গড়ে ১২০২ রান, একটি সেঞ্চুরি, সাতটি হাফ-সেঞ্চুরি। বাঁ-হাতি স্পিনে নিয়েছিলেন ৭৫ উইকেট। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ১৭০ ম্যাচে ৮৫৪৫ রান, ৪৮৪ উইকেট। অবশ্য নিছক পরিসংখ্যানে তাঁকে মাপা মুশকিল। তারকার গ্ল্যামার জড়িয়ে ছিল তাঁর ক্রিকেটে। সুদর্শন ক্রিকেটার পা রেখেছিলেন বলিউডেও। ১৯৭৩ সালে করেন ‘চরিত্র’ নামের সিনেমা। পরভিন ববি ছিলেন নায়িকা। সেই শুরু, সেই শেষ। আর সিনেমা করেননি।

মুছে যাওয়া দিনগুলো এখন পিছু ডাকে প্রায়শই। বাইশ গজের কত ঘটনা, কত স্মৃতি। যার সবই ক্রিকেট-রোমান্টিকতার অঙ্গ। এখন অবশ্য সঙ্গী কঠোর বাস্তবতা। দিন চলে বোর্ডের দেওয়া পেনশনের টাকায়। জামনগরের বাড়ির সদস্যসংখ্যা সাত। বাড়ির চেহারা নেহাতই আটপৌরে। ক্রিকেটারসুলভ চটক নেই একটুও। নেই কোনও গাড়ি। যাতায়াত করেন অটোরিকশায়। যেখানে শুধু আইপিএল খেলেই ক্রিকেটারদের জীবনযাত্রায় ঘটছে আমূল বদল, গাড়ি-বাড়ি-ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স, সেখানে ২৯ টেস্ট খেলা ক্রিকেটার চড়েন অটো।

সেলিম দুরানি অবশ্য এই সব নিয়ে মুখ খুলতেই রাজি নন। কখনই কারও কাছে সাহায্যের জন্য যাননি। সৌরাষ্ট্র ক্রিকেট সংস্থার কাছেও সাহায্যের দরবার করেননি। আনন্দবাজার ডিজিটালকে শুধু বললেন, “বোর্ড ক্রিকেটারদের জন্য অনেক কিছু করেছে। অনেক সুবিধা দিয়েছে। আমরা পেনশন পাচ্ছি। তবে পুরনো ক্রিকেটারদের আরও সাহায্য করা দরকার। বাচ্চারা বড় হয়ে গিয়েছে। তাদের পড়াশোনার জন্য অনেক খরচও হয়েছে। তবে সৌরভ এখন বোর্ড প্রেসিডেন্ট। নিশ্চয়ই ক্রিকেটারদের পাশে আরও বেশি করে থাকবে বোর্ড। আমার সেই বিশ্বাস রয়েছে।” সাহায্য প্রার্থনা নয়, বরং গলার স্বরে মিশল আভিজাত্য।

জয়পুরে মনোজ তিওয়ারির সঙ্গে সেলিম দুরানি। —নিজস্ব চিত্র।

বর্ষীয়ান ক্রিকেটার বরং বেশি স্বচ্ছন্দ পুরনো দিনের কথায়। বললেন, “আমাদের সময়ে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট ছিল না। তখন রঞ্জি ট্রফি, দলীপ ট্রফি ছিল। ইরানি কাপে খেলতাম। এখন যখন টি-টোয়েন্টিতে দেখি একের পর এক ছয় মারা হচ্ছে, তখন ভাল লাগে। মনে হয় যে আমিও তো এক সময় এমন ভাবেই ছয় হাঁকাতাম। এখন খেললেও টি-টোয়েন্টিতে মারতাম। কিন্তু কী করা যাবে, তখন আইপিএল কোথায়!” বোঝা গেল, টি-টোয়েন্টি নামের বিনোদনের অংশ হতে না পারা কোথাও গিয়ে যন্ত্রণাই ডেকে আনে।

ফের ফিরে গেলেন স্মৃতিচারণে। বললেন, “অভিষেক হয়েছিল সৌরাষ্ট্রের হয়ে। তার পর গুজরাত ও রাজস্থানের হয়েও খেলেছি। ২৪ বছর বয়সে জাতীয় দলে খেলার ডাক পাই। সেই আনন্দ ভুলব না।” এখন দিন কাটে খেলা দেখে, নানা অনুষ্ঠানে গিয়ে। জয়পুরে গিয়ে যেমন বাংলার মনোজ তিওয়ারির সঙ্গে আড্ডায় বসে পড়েছিলেন। বললেন, “জামনগরে থাকি বটে। কিন্তু জয়পুরেও যাই কখনও কখনও। যাই উদয়পুরেও। পুরনো লোকদের সঙ্গে দেখা করি, কথা হয় ক্রিকেটারদের সঙ্গেও। রবীন্দ্র জাডেজা, চেতেশ্বর পূজারা— দু’জনেই যেমন সৌরাষ্ট্রের। গল্প হয় দেখা হলে। ভাল লাগে ওদের খেলা।”

এই সময়ের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে অবশ্য বিরাট কোহালির ভক্ত তিনি। বার বার ভারত অধিনায়কের নাম শোনা গেল তাঁর মুখে। বললেন, “বিরাট কোহালির ব্যাটিং অনবদ্য। ও ম্যাচ-উইনার। ওয়ানডে ক্রিকেটে আমাদের ছেলেরা খুব ভাল খেলছে। টি-টোয়েন্টিতেও ভাল খেলছে দল। বিরাটর খুব ইন্টেলিজেন্ট ব্যাটিং করে। ওর ব্যাটিং দেখে খুব মজা পাই।”

নিজে বাঁহাতি। সেই জন্যই হয়তো আরও বেশি করে পছন্দ করতেন সৌরভের ব্যাটিং। বললেনও, “হ্যাঁ, ওর ব্যাটিংয়ের ধরন টানত আমাকে। এখন বোর্ড প্রেসিডেন্ট। শুভেচ্ছা রইল।” ডাকাবুকো বীরেন্দ্র সহবাগও ছিলেন পছন্দের তালিকায়। বললেন, “ভাল লাগত বীরেন্দ্র সহবাগের আক্রমণাত্মক ব্যাটিংও। ও তো টেস্টেও এক দিনের মেজাজে ব্যাট করত। আমাদের সময়ে এ ভাবে খেলা হত না। তবে আবার বলছি, কোহালির ব্যাটিং আমার খুব প্রিয়। কভার ড্রাইভ যা মারে, আহা। তবে ওর হাতে আরও শট রয়েছে। উইকেটের সবদিকে মারে ও। ভার্সেটাইল ব্যাটসম্যান ও।” ফের কোহালি-প্রেম উঠে এল গলায়।

আরও পড়ুন: ‘মোস্ট, মোস্ট, মোস্ট আন্ডাররেটেড ক্রিকেটার হলেন রাহুল দ্রাবিড়’​

গত অর্ধ শতকের সেরা টেস্ট ব্যাটসম্যান নিয়ে ক্রিকেটমহলে এখন চলছে তুমুল চর্চা। অনলাইন সমীক্ষায় শিরোপা উঠেছে রাহুল দ্রাবিড়ের মাথায়। যা মানতে পারছেন না অনেকে। সুনীল গাওস্করের নাম উঠে আসছে জোরালো ভাবে। তবে দুরানি সেই তাজ পরাতে চান সচিনকে। বললেন, “সুনীল গাওস্কর, রাহুল দ্রাবিড়, সচিন তেন্ডুলকর, বিরাট কোহালিরা সবাই আলাদা ধরনের ব্যাটসম্যান। কিন্তু, সচিন খুবই বড় মাপের ক্রিকেটার। গাওস্করও এক জমানায় সেরা ছিল। এখনও বিদেশে ওর প্রতি সেই শ্রদ্ধা রয়েছে ক্রিকেটপ্রেমীদের। কিন্তু সবচেয়ে বড় বাছতে হলে সচিনের মুখই ভাসছে। টেস্টে ও-ই ভারতের সবচেয়ে বড় ব্যাটসম্যান।”

ব্যাট হাতে দর্শক মনোরঞ্জন ছিল তাঁর খেলার স্টাইল। আনন্দ দিতে ভালবাসতেন ক্রিকেটপ্রেমীদের। বোলারদের পরোয়া করতেন না, চালাতেন ব্যাট। তবে নতুন এক ‘বোলার’ চিন্তায় রেখেছে হালফিল। বললেন, “ওফ! করোনা পুরো পাগল করে দিয়েছে। যবে থেকে করোনা এসেছে, খুব ভয়ে ভয়ে রয়েছি। বাইরে বেরনো বন্ধ। মুখে থাকছে মাস্ক। খুব মুশকিলে পড়েছি!” খোলামেলা সময়ের মানুষ বলেই লকডাউন বাড়িয়েছে অস্বস্তি।

তবে এখনও অটুট ক্রিকেটপ্রেম। এখনও অটুট আভিজাত্য। চাহিদা নেই, নেই প্রত্যাশাও। সুনীল গাওস্করের ‘প্রিন্স সেলিম’ আছেন নিজের জগতেই পরিপূর্ণ!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement