রবি শাস্ত্রী একা নন, বিরাট কোহালির ব্যাটিং বিক্রমে মোহিত দেখাচ্ছে ক্রিকেট বিশ্বের অনেককেই।
তাঁদের মধ্যে থাকছেন ভারতীয় ক্রিকেটের সর্বকালের অন্যতম সেরা এক অফস্পিনারও। তিনি— হরভজন সিংহ বলে দিচ্ছেন, এ ভাবে ব্যাট করতে থাকলে কোহালির পক্ষে কোনও রেকর্ডই অধরা থাকবে না। এমনকি, এ রকম ফর্মে ব্যাট করলে সচিন তেন্ডুলকরের ‘সেঞ্চুরি অব সেঞ্চুরিজ’-এর রেকর্ডও কোহালি ভেঙে দিতে পারেন বলে মনে হতে শুরু করেছে সচিনের প্রাক্তন সতীর্থ এবং তাঁর খুবই ঘনিষ্ঠ স্পিনারের।
ট্রেন্ট ব্রিজে কোহালির রাজসিক ব্যাটিং আর তাঁর দলের জয় দেখে মুগ্ধ হরভজন বলে দিচ্ছেন, ‘‘ভারতীয় ক্রিকেটের সেরা জয়গুলোর একটা দেখতে পেলাম আমরা। কিন্তু আমি আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছি বিরাট কোহালিতে। কী অসাধারণ ক্রিকেটার! হার বলে কোনও শব্দই নেই ওর অভিধানে। ওকে দেখে মনেই হচ্ছে না আউট হবে। আর আউট হলেও এমন চোখমুখ করে তাকাচ্ছে যেন পৃথিবীর সব চেয়ে আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছে সেই বোলার।’’
ভাজ্জির বিস্ময় এখানেই শেষ হচ্ছে না। যোগ করছেন, ‘‘সিরিজে ০-২ পিছিয়ে থাকা অবস্থায় অনেকেই ভিতরে ভিতরে শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু বিরাট যেন লোহা দিয়ে তৈরি। এত কঠিন একটা পরিস্থিতি! ও দলের ক্যাপ্টেন। কিন্তু এমন ভঙ্গিতে খেলল যেন কোনও ব্যাপারই নয়। যেন এই পরিস্থিতি সামলানোর সহজাত দক্ষতা নিয়ে ও জন্মেছে।’’
কোহালির কোন গুণটা দেখে আপনি সব চেয়ে চমৎকৃত? জিজ্ঞেস করায় হরভজন বললেন, ‘‘ওর আত্মবিশ্বাস। দেখে মনে হচ্ছে, আউট হতে পারে বলে ভাবেই না। আমি এতটা মনের জোর কখনও কোনও ক্রিকেটারের মধ্যে দেখিনি।’’
বুধবার ভারতের টেস্ট জয়ের পরে ট্রেন্ট ব্রিজে কোহালিদের ড্রেসিংরুমের দিক থেকে টিভি শো শেষ করে উল্টো দিকে যাওয়ার পথে কথা হচ্ছিল তাঁর সঙ্গে। চোখেমুখে তখনও মুগ্ধতা। বলে চলেন, ‘‘প্রথম ইনিংসে ৯৭ করল। তিন রানের জন্য সেঞ্চুরি পেল না। দ্বিতীয় ইনিংসে যেন দ্বিগুণ প্রতিজ্ঞা নিয়ে নামল। প্রথম ইনিংসে সেঞ্চুরি না পাওয়ার যন্ত্রণাটা মিটিয়ে তবেই শান্তি পেল। আমি অ্যাকাডেমি করলে তো উঠতি ক্রিকেটারদের শুধু এই প্রতিজ্ঞার ভিডিয়োটাই দেখাব আর বলব, দেখো মনের জোর
একেই বলে।’’
হরভজন সিংহের মুখ থেকে ‘আমি কখনও দেখিনি’ মন্তব্য বেরনোর অন্য অর্থও রয়েছে। টেস্টে ৪১৭ এবং ওয়ান ডে-তে ২৬৯ উইকেট নিয়ে তিনি শুধু ভারতের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারিদের এক জনই নন, ভারতীয় ব্যাটিংয়ের স্বর্ণযুগের সমসাময়িক তিনি। সচিন তেন্ডুলকর, রাহুল দ্রাবিড়, ভি ভি এস লক্ষ্মণ, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, বীরেন্দ্র সহবাগ— মহাতারকা পঞ্চকের সঙ্গে এক দশকের উপরে একই দলে খেলেছেন। তবু সচিনের ক্রিকেট জীবনে তাঁর খুবই ঘনিষ্ঠ হরভজন বলে ফেলছেন, ‘‘আমি কারও নাম টেনে আনতে চাই না। কাউকে অসম্মান করার প্রশ্নই নেই। সকলে বড় ক্রিকেটার। শুধু একটাই কথা বলব। কোহালি এখন যা ব্যাট করছে, যে কোনও বড় নাম, যে কোনও কিংবদন্তির সমতুল্য।’’
ক্রিকেটার হিসেবে সচিন, রাহুল দ্রাবিড়দের প্রস্তুতি, অধ্যবসায়, দায়বদ্ধতা খুব কাছ থেকে দেখেছেন হরভজন। তেমনই কোহালিকে দেখছেন খুব ছোটবেলা থেকে। ‘‘বিরাটের খিদেটা সাংঘাতিক। পরিশ্রম করায় কোনও অনীহা নেই। কিন্তু সব চেয়ে যেটা ওকে এগিয়ে রাখছে, তা হল, প্রত্যেক ম্যাচে ভাল করার তাগিদ। প্রথম ইনিংসে রান পেলেও দ্বিতীয়টাতে একই রকম খিদে নিয়ে উপস্থিত হয়। এটা একটা-দু’টো, তিনটে-চারটে ম্যাচে আমরা দেখতে অভ্যস্ত। কিন্তু ম্যাচের পর ম্যাচ ধরে, টানা দু’বছর ধরে করে যাওয়াটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার!’’
ব্যাটসম্যান কোহালিকে সর্বকালের সেরাদের সঙ্গে তুলনা করা শুরু হয়ে গিয়েছে। আপনি কাদের পাশে রাখবেন? ভিভিয়ান রিচার্ডস, সচিন তেন্ডুলকরদের সঙ্গে কি তুলনা করা যায় কোহালির? ইডেনে হ্যাটট্রিক করে স্টিভ ওয়ের দলের বিজয়রথ থামানো স্পিনার জোরের সঙ্গে বললেন, ‘‘অবশ্যই করা যায়। সেরাদের দলে জায়গা করে নিচ্ছে বিরাট।’’ এর পরেই গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ, ‘‘ওর ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স তো আছেই। কিন্তু সেটা কোন মুহূর্তে আসছে দেখুন। টিম যখন ঘোর অন্ধকারের মধ্যে, তখন একার কাঁধে দলকে টেনে বার করছে অন্ধকার সুড়ঙ্গ থেকে। এক বার নয়, বার বার। আমরা একটা কথা বলি, বড় খেলোয়াড় বোঝানোর জন্য। দাদা প্লেয়ার। কোহালি হচ্ছে দাদা প্লেয়ার।’’
ভারতীয় দলের হেড কোচ রবি শাস্ত্রী বুধবার টেস্ট জেতার পরে বলেছিলেন, প্রস্তুতি এবং কর্মপদ্ধতির দিক থেকে সচিন তেন্ডুলকরের সমতুল্য কোহালি। সেই মন্তব্যকে আরও উস্কে দিচ্ছেন সচিনের প্রিয় স্পিনার। কোহালি কি পারবেন সচিনের একশো সেঞ্চুরির কীর্তিকে ছুঁতে? হরভজন বললেন, ‘‘যে ভাবে খেলে চলেছে বিরাট, কোনও কিছুই অসম্ভব নয়। যদি এ রকম ফর্ম চলতে থাকে, ব্যাটিংয়ের কোনও রেকর্ডই আর নিরাপদ নয়।’’
বুধবার ট্রেন্ট ব্রিজে পঞ্চম দিনের খেলা স্থায়ী হয় ১০ মিনিট আর ১৭ বল। জেমস অ্যান্ডারসনের শেষ উইকেট আর অশ্বিন তুলে নিতেই বিদেশের মাঠে অন্যতম বড় জয় ছিনিয়ে নেয় কোহালির ভারত। কিন্তু সকালে তৃতীয় ওভারে খেলা শেষ হলেও প্রায় দুপুর গড়িয়ে বিকেল পর্যন্ত মাঠে বসেই ডেভিড গাওয়ার, নাসের হুসেন, কুমার সঙ্গকারারা আলোচনা করতে থাকলেন কোহালির ব্যাটিং নিয়ে।
ইংল্যান্ডের প্রাক্তন অধিনায়ক মাইকেল আথারটন মনে করছেন, চলতি সিরিজে বাকি ব্যাটসম্যানদের এক গ্রহের দেখাচ্ছে আর কোহালিকে অন্য গ্রহের। ছয় ইনিংসে কোহালির এখনও পর্যন্ত সংগ্রহ ৪৪০ রান। এর মধ্যে দু’টো সেঞ্চুরি এবং দু’টো হাফ সেঞ্চুরি হয়ে গিয়েছে। দু’দলের বাকি ব্যাটসম্যানদের মধ্যে একমাত্র ইংল্যান্ডের উইকেটরক্ষক জনি বেয়ারস্টো ২০০ রান পেরোতে পেরেছেন। হরভজনের হিসেব বলছে, ‘‘বিরাট অন্তত সাতশো রান নিয়ে ফিরবে এই সিরিজ থেকে। এখনও দু’টো টেস্ট বাকি। যে ইংল্যান্ডে ও আগের বারে এসে রান পায়নি, সেখানে ফিরে এই যে জেদটা দেখাচ্ছে, সেটাই বিরাটকে বিশেষ চরিত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করছে।’’
সাউদাম্পটন টেস্টের আগে আট দিনের ছুটি। শ্বশুরবাড়িতে সময় কাটিয়ে হরভজন ফিরবেন কমেন্ট্রি বক্সে। এই জয় সিরিজের গতিপথই ঘুরিয়ে দিতে পারে বলে মনে হচ্ছে তাঁর। হার্দিক পাণ্ড্য ও যশপ্রীত বুমরার প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত শোনাল তাঁকে। কিন্তু আবিষ্ট কোহালিকে নিয়ে। গাড়িতে ওঠার আগেও বিড় বিড় করতে শোনা গেল তাঁকে, ‘‘দাদা প্লেয়ার হ্যায়, বহুত বড়া প্লেয়ার!’’