মনোবিদ এ বার ব্রাত্য

আফ্রিকার গুহায় গুরু গ্যারি ও তাঁর তেন্ডুলকর মডেল

অভিনেতা রণবীর কপূর সেই রাতেই প্রস্তাব দিয়েছিলেন ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের সামনের রাস্তা তাঁর নামে করার। চার বছর আগে দেশকে এনে দেওয়া বিশ্বকাপের জন্য তাঁর প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতায়। গুরু গ্যারি!

Advertisement

গৌতম ভট্টাচার্য

মেলবোর্ন শেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:২১
Share:

দক্ষিণ আফ্রিকার নেটে কার্স্টেনের থ্রো-ডাউন। বুধবার। ছবি: দেবাশিস সেন।

অভিনেতা রণবীর কপূর সেই রাতেই প্রস্তাব দিয়েছিলেন ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামের সামনের রাস্তা তাঁর নামে করার। চার বছর আগে দেশকে এনে দেওয়া বিশ্বকাপের জন্য তাঁর প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতায়। গুরু গ্যারি!

Advertisement

চার বছর পর সেই গুরু গ্যারি এ বার ভারতের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ। বুধবার জাংশন ওভাল মাঠে গুরু গ্যারির শস্ত্রশিক্ষা দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, সেই রামও নেই! সেই অযোধ্যাও নেই!

তিনি গ্যারি কার্স্টেন সেই সময় ভারতীয় নেটে প্রসিদ্ধ ছিলেন থ্রো-ডাউন প্র্যাকটিস দেওয়ার জন্য। যাঁকে অক্লান্ত ভাবে পরের পর বল ছুড়ে যেতেন, তিনি রোববার ইন্ডিয়া-সাউথ আফ্রিকা ম্যাচে এমসিজিতেই থাকবেন। কিন্তু আজ— তিনি সচিন তেন্ডুলকরও তো গ্যালারিতে! প্র্যাকটিসে বল ছোড়ার প্রয়োজনীয়তাটাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গিয়েছে।

Advertisement

বুধবার ১৯ মিনিটে টানা ৮৮ বার যাঁকে গ্যারি কার্স্টেন বল ছুড়ে গেলেন, তাঁর নাম ডেভিড মিলার। বিশ্বকাপের সম্ভাব্য মহাতারা। গ্যারির খেলোয়াড়ি জীবন থেকেই বল ছোড়ার অভ্যেস রয়েছে। তখন প্র্যাকটিস দিতেন সহ ওপেনার হার্শেল গিবসকে। এর পর ভারতীয় নেটে তেন্ডুলকরকে দেওয়া তাঁর প্র্যাকটিসের ধরন তো প্রবাদ হয়ে যায়। এখন দক্ষিণ আফ্রিকান নেটেও সেই সচিন মডেল।

কার্স্টেন এই দক্ষিণ আফ্রিকা টিমের কোচ নন— পরামর্শদাতা। টিমের সঙ্গে টানা পুরো বিশ্বকাপ পর্যন্ত থাকবেন কি না তা-ও অনিশ্চিত। কিন্তু তিনি আইপিএল নিলাম শেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকা টিমের সঙ্গে আজ যোগ দিতেই স্প্রিংবকদের চেহারাই যেন বদলে গিয়েছে। ভারত ম্যাচের এখনও চার দিন। অথচ যে নিবিড় ভঙ্গিতে এ দিন ডে’ভিলিয়ার্সের টিম প্র্যাকটিস করল, যেন কালই খেলা! আর খেলাটা বিশ্বকাপ ফাইনাল!

টিমের মাথারা ঝুঁকে পড়েছেন পিচের ধারে একসঙ্গে। ডে’ভিলিয়ার্সকে টেনে নিয়ে গেলেন কার্স্টেন। পাশে মাইক হাসি, বিশ্বকাপের জন্য যাঁকে বিশেষ পরামর্শদাতা নিযুক্ত করেছে দক্ষিণ আফ্রিকা বোর্ড। আছেন বোলিং কোচ অ্যালান ডোনাল্ড আর সহকারী বোলিং কোচ শার্ল ল্যাঙ্গভেল্ট। একমাত্র সাইনাসাইটিসে আক্রান্ত ডেল স্টেইনকে এ দিন দেখা গেল না। বিশেষজ্ঞদের মতে, নিরানব্বই বিশ্বকাপে সেই ক্রোনিয়ের দলের পর এত ভাল টিম নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা আর কখনও আসেনি। টিমকে ঘিরে স্পেশ্যালিস্টদের এমন সমারোহও অতীতে কখনও ঘটেনি। শুধু অন্য বারের মতো টিমের সঙ্গে কোনও মনোবিদ দেখলাম না।

আগের বিশ্বকাপে ভারতের সঙ্গে থাকা প্যাডি আপটনকে মাঝখানে একটা সময় তারা নিযুক্ত করেছিল। এ বার প্যাডিকে দেখা গেল না। দ্বিতীয় অন্য কেউও নেই। শুনলাম আর কোনও মনোবিদ নাকি দলের সঙ্গে রাখা হচ্ছে না। বছরের পর বছর মনোবিদ রেখেও দক্ষিণ আফ্রিকা সেই চাপের মুখে ম্যাচ হেরেছে। বারবার ‘চোকার্স’ উপাধি পেয়েছে। তাই সম্পূর্ণ অন্য মেরুর মডেল এ বার!

দক্ষিণ আফ্রিকা চলে যাওয়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আবির্ভূত হল ভারত। দুটো টিমই প্র্যাকটিস সারল জাংশন ওভাল মাঠে। এটা সেন্ট কিলডা ক্লাবের মাঠ। সচিনের যেমন শিবাজি পার্ক। সৌরভের যেমন বেহালায় রেলের মাঠ। তেমনই শেন ওয়ার্নের সেন্ট কিলডা! ওয়ার্নের কোটি টাকার অট্টালিকাও কাছাকাছি। যেখানে একটা সময় নিজের বাচ্চাকাচ্চা আর লিজ হার্লিকে নিয়ে ছিলেন তিনি।

এখন অবশ্য সে সব অতীতের কথা। যেমন ভারতীয় সাংবাদিক আর ক্রিকেটারের এককালীন ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও দূর অতীতের কথা। ভারতের মিডিয়া ম্যানেজার এ দিন দু’চারজন সাংবাদিককে বলে দিলেন, হাই-হ্যালোও করতে যাবেন না প্লেয়ারদের সঙ্গে। সেটাও বারণ আছে। প্লেয়ারদের হয়েছে সমস্যা। পরিচিত সাংবাদিক দেখলেও অধিনায়কের নির্দেশে তাঁদের মাথা নিচু করে চলে যেতে হচ্ছে। যে কথা বলবে সে ক্যাপ্টেনের ব্যাড বুকে চলে যাবে।

ভারতীয় দল ঘিরে নিরাপত্তারক্ষীর সংখ্যাও এ বার অনেক বেশি। তাঁদের ওপর নির্দেশ রয়েছে মিডিয়াকে কাছে ঘেঁষতে না দেওয়ার। রবি শাস্ত্রী অবশ্য তার মধ্যে এক ফাঁকে বলে গেলেন, “কী বলেছিলাম যে, একটা ম্যাচ জিতেই শ্যাম্পেন বোতল খোলার সময় আসেনি। সচিনও তো শুনলাম একই কথা বলেছে।”

শাস্ত্রীদের কথা শুনে এবং এ দিন সাড়ে তিন ঘণ্টা কঠিন প্র্যাকটিস করার ধরনেই বোঝা যাচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচ আপ্রাণ জিততে চাইছে টিম ইন্ডিয়া। ধরে নেওয়া যায় এই ম্যাচটা যারা জিতবে তারাই গ্রুপ শীর্ষে থাকার মুখ্য দাবিদার। গ্রুপ বি থেকে শীর্ষে থেকে ওঠা মানে ওই গ্রুপ থেকে কোয়ার্টার ফাইনালে অস্ট্রেলিয়া বা নিউজিল্যান্ডকে এড়িয়ে যাওয়া যাবে। বিপক্ষে পড়বে ইংল্যান্ড বা শ্রীলঙ্কার মতো সহজতর কেউ।

ড্রেসিংরুম থেকে একগাদা পুরনো ছবি দেখে মাঠে নামল টিম। শাস্ত্রী তীব্র বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, “এ মাঠ থেকে বিল পন্সফোর্ডের যে উত্থান, জানতামই না।” পন্সফোর্ড হলেন ব্র্যাডম্যানের টিমের জবরদস্ত ওপেনার। ভিক্টোরিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার হয়ে বহু বছর খেলেছেন। জীবিত ও মৃত মিলিয়ে সেন্ট কিলডা মাঠের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাস্যাডর তিন জন। ওয়ার্ন, পন্সফোর্ড এবং পাশের লাল ইটের গ্যালারিটা যাঁর নামে।

বার্ট আয়রনমঙ্গার। বাঁ-হাতি স্লো মিডিয়াম বোলার। ব্যাটের হাত এত খারাপ ছিল যে, প্রবাদ আছে এক বার তিনি ব্যাট করার সময় ড্রেসিংরুমে ফোন আসে। যে ধরেছিল সে বলে, উনি তো এখনই ব্যাট করতে গেলেন! ফোনকারী এ বার গভীর নিশ্চিন্ত। ঠিক আছে— আমি তা হলে ধরে আছি। আয়রনমঙ্গারের ব্যাটিং অ্যাভারেজ চন্দ্রশেখরের চেয়েও খারাপ। টেস্ট ক্রিকেটে ২৩টা শূন্য-সহ চন্দ্রর ব্যাটিং অ্যাভারেজ ৪.০৭। আয়রনমঙ্গারের সেখানে ২.৬২। তবু তাঁর নামে প্যাভিলিয়নের পাশের স্ট্যান্ডের নামকরণ যেহেতু, অসামান্য বোলিং অ্যাভারেজ আয়রনমঙ্গারের। ১৭.৯৭। মাত্র চোদ্দো টেস্টে ৭৪ উইকেট। টেস্ট গড় ৪৮.২২। প্রথম শ্রেণির গড় ৬৫.১৮। জাংশন ওভাল মাঠ তাই এমন চিরস্মরণীয় রেখে দিয়েছে তাঁকে।

শাস্ত্রীর টিমের এত ইতিহাস জানার কোনও প্রয়োজন নেই। তাদের এটুকু জানলেই চলবে যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তারা যেমন বিশ্বকাপে ৬-০ এগিয়ে, তেমনই দক্ষিণ আফ্রিকা তাদের বিরুদ্ধে এগিয়ে ৩-০!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement