দ্রাবিড়কে সরাও, বাড়ি এসে বললেন চ্যাপেল

পূর্বাভাস ছিল, নভেম্বরের গোড়ায় ভারতীয় ক্রিকেটে ঝড়টা প্রথম উঠবে মুদগল কমিটির চূড়ান্ত রিপোর্ট জমা পড়লে। তার পর থাকবে সচিন তেন্ডুলকরের আত্মজীবনী ‘প্লেয়িং ইট মাই ওয়ে’। সোমবার সুপ্রিম কোর্টে পেশ হল মুদগল কমিটির রিপোর্ট। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তোলপাড় করা তীব্রতায় সচিন তেন্ডুলকরের অবিশ্বাস্য আক্রমণাত্মক কলম বহু পিছনে ফেলে দিল মুদগল রিপোর্টকে! মরুঝড়ের ইনিংসটা যে স্টান্সে খেলেছিলেন, তার থেকেও অনেক বেশি শাণিত আক্রমণে নিজের বইয়ে গ্রেগ চ্যাপেলকে ‘রিং মাস্টার’ বলে তুলোধোনা করেছেন সচিন।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০১৪ ০২:০৭
Share:

পূর্বাভাস ছিল, নভেম্বরের গোড়ায় ভারতীয় ক্রিকেটে ঝড়টা প্রথম উঠবে মুদগল কমিটির চূড়ান্ত রিপোর্ট জমা পড়লে। তার পর থাকবে সচিন তেন্ডুলকরের আত্মজীবনী ‘প্লেয়িং ইট মাই ওয়ে’। সোমবার সুপ্রিম কোর্টে পেশ হল মুদগল কমিটির রিপোর্ট। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তোলপাড় করা তীব্রতায় সচিন তেন্ডুলকরের অবিশ্বাস্য আক্রমণাত্মক কলম বহু পিছনে ফেলে দিল মুদগল রিপোর্টকে!

Advertisement

মরুঝড়ের ইনিংসটা যে স্টান্সে খেলেছিলেন, তার থেকেও অনেক বেশি শাণিত আক্রমণে নিজের বইয়ে গ্রেগ চ্যাপেলকে ‘রিং মাস্টার’ বলে তুলোধোনা করেছেন সচিন। কয়েক মেগাটনের বোমা ফাটিয়ে জানিয়েছেন, ২০০৭ বিশ্বকাপের আগে কী ভাবে গোপনে তাঁর বাড়িতে এসে রাহুল দ্রাবিড়কে অধিনায়কত্ব থেকে সরানোর ষড়যন্ত্রে সচিনকে জড়াতে চেয়েছিলেন চ্যাপেল। “চলো একসঙ্গে ভারতীয় ক্রিকেটকে নিয়ন্ত্রণ করি আমরা,” বলে লোভ দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন। অস্ট্রেলীয় কিংবদন্তি সম্পর্কে সচিন যা লিখেছেন, তাতে চ্যাপেলের ‘কড়া হেডস্যার’ ভাবমূর্তি চুরমার হয়ে বেরিয়ে এসেছে এক ক্ষমতালোভী, প্রচার-প্রিয়, স্বার্থপর, একনায়কের চেহারা। যিনি টিমের সিনিয়রদের একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়িয়ে বিভাজন ও শাসনের নীতিতে ভারতীয় ক্রিকেটকে কব্জা করতে চেয়েছিলেন।

এবং সচিনের কথায়, “ভারতীয় ক্রিকেটকে পুরোপুরি বিপর্যস্ত করে তোলা ছাড়া চ্যাপেল-জমানার আর অন্য কোনও দিশা ছিল না।”

Advertisement

যে মূল্যায়নের সঙ্গে একেবারে একমত সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। যিনি বলেছেন, “সচিন সত্যি কথাটা লেখায় আমি খুবই খুশি। গ্রেগ চ্যাপেল নিয়ে আরও কী কী রয়েছে সচিনের বইয়ে, সেটা দেখার অপেক্ষায় আছি। আশা করি এক দিন আমিও নিজের অভিজ্ঞতা বলার সুযোগ পাব। তবে সে সব বলতে শুরু করলে হয়তো আগামী দু’বছর শুধু সেটা নিয়েই চর্চা হবে।” সৌরভ অবশ্য জানিয়েছেন, সচিন আর গ্রেগের আলোচনার কথা তিনি জানতেন না। টিভি চ্যানেলে সৌরভ বলেন, “এটা প্রথম শুনলাম। ২০০৫-এর গোড়ায় আমাকে সরিয়ে রাহুলকে অধিনায়ক করেন। তার আট মাসের মধ্যেই আবার নতুন ক্যাপ্টেন চাইছিলেন! এতেই বোঝা যায় গ্রেগ ভারতীয় ক্রিকেটের কতটা ক্ষতি করেছেন। ওঁকে বিশ্বাস করা যায় না।”

এ দিন বইয়ের নির্বাচিত যে অংশ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তাতে সৌরভের প্রতি চ্যাপেলের ‘অবিচার’ থেকে শুরু করে ভিভিএস লক্ষ্মণের মতো ব্যাটসম্যানকে দল থেকে ছেঁটে ফেলার প্রছন্ন হুমকি দেওয়া নানা প্রসঙ্গ রয়েছে। কিন্তু সব চেয়ে বিস্ফোরক অংশটা এই রকম:

“২০০৭ বিশ্বকাপের মাত্র কয়েক মাস আগে চ্যাপেল এক দিন আমার বাড়ি আসেন। এবং আমাকে স্তম্ভিত করে প্রস্তাব দেন, ‘রাহুলের কাছ থেকে তুমি ক্যাপ্টেন্সিটা কেড়ে নাও। এই কাজে আমি নিজে তোমাকে সাহায্য করব। তার পর দু’জনে মিলে আগামী বহু বছর ভারতীয় ক্রিকেটে রাজত্ব করা যাবে।’ আমার স্ত্রী অঞ্জলি পর্যন্ত কোচের এমন প্রস্তাবে হতভম্ব হয়ে যায়। আমাকে অবশ্য প্রস্তাবের চেয়েও এটা বেশি ধাক্কা দিয়েছিল যে, ক্রিকেটের সর্বোচ্চ টুর্নামেন্ট মাত্র ক’মাস দূরে, অথচ আমাদের ক্যাপ্টেন সম্পর্কে কোচের মনে এতটুকুও সম্মান নেই! আমাকে নানা ভাবে বোঝানোর চেষ্টায় উনি আরও দু’ঘণ্টা আমার বাড়িতে ছিলেন। শেষে ফিরে যান।”

রাহুল দ্রাবিড় অবশ্য এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি নন। এ দিন রাহুল বলেছেন, “এ ব্যাপারে আমার কোনও ধারণা নেই। যা-ই হয়ে থাক, সেটা নিয়ে এখন আর কিছু আসে-যায় না। আমি বরং জানতে আগ্রহী, সচিন বইয়ে ব্যাটসম্যানশিপ নিয়ে কী লিখেছে।”

দ্রাবিড় ‘‘কিছু যায়-আসে না’’ বললেও ওই ঘটনায় সচিন এতটাই বীতশ্রদ্ধ হন যে, ভারতীয় ক্রিকেটের স্বার্থেই চাননি, ২০০৭ বিশ্বকাপে কোচ টিমের সঙ্গে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে যান। সচিন লিখেছেন, “বোর্ডকে বলেছিলাম, সব চেয়ে ভাল হয় যদি বিশ্বকাপে গ্রেগ টিমের সঙ্গে না যান। কোচকে দেশে রেখে বাকি টিমকে পাঠানো হোক। সিনিয়র ক্রিকেটাররা দায়িত্ব নিয়ে দলকে সামলে রাখবে।”

সচিনের সেই প্রস্তাব অবশ্য গ্রাহ্য হয়নি। গ্রেগ চ্যাপেল ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারতীয় দলের সঙ্গেই যান। বাকিটা সবাই জানেন। গ্রুপ পর্যায়েই ছিটকে গিয়েছিল ভারত। শ্রীলঙ্কা এবং বাংলাদেশের কাছে হেরে। সেই বিপর্যয়ের জন্য সরাসরি চ্যাপেলকে কাঠগড়ায় তুলে সচিন লিখেছেন, “২০০৭ বিশ্বকাপ অভিযানটা প্রহসনে পর্যবসিত হয়েছিল স্রেফ চ্যাপেলের জন্য। কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেটের দফা রফা করে দেওয়ার পরেও নিজের সব দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলে উনি আমাদের দায়বদ্ধতা নিয়েই প্রশ্ন তোলেন।” চ্যাপেল বনাম সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় দ্বৈরথে সচিন খোলাখুলি সৌরভের পক্ষে। “সৌরভের প্রতি চ্যাপেলের আচরণ বিস্ময়কর! সৌরভ ভারতের সর্বকালের সেরা ক্রিকেটারদের এক জন। টিমে থাকার জন্য ওর চ্যাপেলের দাক্ষিণ্যের প্রয়োজন ছিল না। চ্যাপেল অবশ্য বলে বেড়াতেন, ভারতীয় কোচের চাকরিটা উনি সৌরভের সুপারিশে পেয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, বাকি জীবন স্রেফ সৌরভের উপকার করে যাবেন!”

শুধু সৌরভ নন, অন্য সিনিয়রদেরও নাকি টিম থেকে ছেঁটে ফেলতে উঠে পড়ে লেগেছিলেন চ্যাপেল। সচিন লিখেছেন, “টিমের কোনও সিনিয়রের প্রতি কখনও সুবিচার করেননি চ্যাপেল। কেন, সেই কারণটা আজও দুর্বোধ্য! মরিয়া হয়ে বয়স্ক ক্রিকেটারদের বাদ দিতে গিয়ে টিমের সংহতিটাই ছারখার করে দিয়েছিলেন। এক বার লক্ষ্মণকে বললেন, ‘তোমাকে ওপেন করতে হবে’। লক্ষ্মণ খুব বিনীত ভাবে জানায়, ও মিডল অর্ডারে অভ্যস্ত, ওপেনিংয়ে স্বচ্ছন্দ বোধ করবে না। তাতে আমাদের সবাইকে অবাক করে গ্রেগ ওকে প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, ‘খুব সাবধান! বত্রিশ বছর বয়সে কাম ব্যাক করা কিন্তু তোমার পক্ষে সহজ হবে না!” সচিন পরে জানতে পারেন, বোর্ডকে চ্যাপেল বলেছেন, প্রত্যেক সিনিয়রকে ছেঁটে ফেলা নাকি জরুরি।

সুপ্রিম কোর্টে মুদগল কমিটির চূড়ান্ত রিপোর্ট নিয়ে শুনানি শুরু হবে ১০ নভেম্বর। সেই ঝড়ের আগে, আগামী ক’দিন মাস্টার ব্লাস্টারের আত্মজীবনী আরও কী কী ঘূর্ণাবর্ত তৈরি করবে, কে জানে!

দ্রাবিড় বলেছিল ও সব বুঝেও গ্রেগকে সামলাতে পারেনি
ভারতীয় ক্রিকেটে ঝড়টা তাঁর বই দিয়েই শুরু হল। সচিন তেন্ডুলকর আত্মজীবনীতে গ্রেগ চ্যাপেলকে ‘রিং মাস্টার’ বলার কিছু পরে মুখ খুললেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ও...

সচিনের বইয়ের ওই অংশে কী লেখা, সেটা আমি পড়িনি। সচিন আর গ্রেগ চ্যাপেলের মধ্যে কী কথা হয়েছিল, সেটাও আমি জানি না। তবে এ নিয়ে আগে কিছু শুনিনি। কোনও মন্তব্যও করব না। সাত বছর আগে ঘটনাটা ঘটেছিল। তাতে এখন আর কিছু আসে যায় না।

রাহুল দ্রাবিড়

সচিন সত্যিটা লেখায় আমি খুব খুশি। ওই সময়ে অনেক কিছুই লেখা হয়েছিল। ভারতের অধিনায়কত্ব থেকে সরে গিয়েছিলাম, ফের টিমে ফিরে এসেছিলাম। তবে ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য সময়টা খুব একটা ভাল ছিল না। সচিনের মতো বড়সড় ব্যক্তিত্ব সেই সময়ে যা ঘটেছিল সেটা সামনে আনায় আমি খুশি। গ্রেগ চ্যাপেল নিয়ে আরও কী কী রয়েছে সচিনের এই বইয়ে সেটা দেখার অপেক্ষায় আছি। আশা করি একদিন আমিও নিজের অভিজ্ঞতাটা বলার সুযোগ পাব। তবে সে সব বলতে শুরু করলে হয়তো আগামী দু’বছর শুধু এটা নিয়েই চর্চা হবে।

....জানতাম না, প্রথম বার শুনলাম সচিন আর গ্রেগের ক্লোজড ডোর আলোচনা হয়েছিল। ২০০৫-এর গোড়ার দিকে আমায় সরিয়ে দ্রাবিড়কে অধিনায়ক করা হয়। তার আট মাসের মধ্যে নতুন ক্যাপ্টেন হিসেবে গ্রেগ চাইছিলেন সচিনকে! এতেই বোঝা যায় উনি ভারতীয় ক্রিকেটের কতটা ক্ষতি করেছেন। গাঙ্গুলি, সচিন বা দ্রাবিড় নাম যাই হোক, কাউকেই গ্রেগ বিশ্বাস করতে পারতেন না।

...২০০৭ বিশ্বকাপে ভারতের ব্যর্থতা দেখে অবাক হইনি। পরে যখন আমি টিমে ফেরত আসি দ্রাবিড়কে বলেছিলাম, কী ঘটছে! দ্রাবিড় বলেছিল ও জানত কিন্তু গ্রেগকে সামলাতে পারেনি।

...গ্রেগের কাছে সিনিয়র প্লেয়ারদের কতটা সম্মান ছিল তার অভিজ্ঞতা আমারও হয়েছে জিম্বাবোয়ে সফরে। তখন আমি টিমের ক্যাপ্টেন। এই নিয়ে বেশি কিছু আর বলতে চাই না। সচিনকে এতদিন ব্যাটসম্যান হিসেবে শ্রদ্ধা করতাম এ বার ব্যক্তি সচিনের উপর শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গেল। ওর বইয়ে সচিন যা লিখেছে তাতে ভারতীয় ক্রিকেটের ভাল হবে আর তার সঙ্গে চোখ খুলে দেবে অনেকেরই।

—এক টিভি চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাত্‌কারে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement