ক্রিকেটকে ছাপিয়ে বিতর্কই শাসন করেছে তাঁর জীবন। বাইশ গজের মতো মাঠের বাইরেও বেশির ভাগ সময়ে শ্রীসন্থ শিরোনামে থেকেছেন ক্রিকেটের বাইরে অন্য কারণে।
ক্রিকেটার হিসেবে কেরিয়ার ট্র্যাজিক হলেও তাঁর ব্যক্তিগত জীবন বরাবরই রঙিন। জীবনের খারাপ সময়েও তাঁর পাশে থেকেছেন পরিজনরা। জীবনের ছন্দে ফিরে আসার সাহস দিয়েছেন স্ত্রী, ভুবনেশ্বরী কুমারী।
জয়পুরের শেখাওয়াত রাজবংশের মেয়ে ভুবনেশ্বরী কুমারীর সঙ্গে শ্রীসন্থের বিয়ে হয় ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর। তবে বিয়ের আগে একাধিক বলিউডি তারকার সঙ্গে শ্রীসন্থের প্রেম নিয়ে জল্পনা শোনা গিয়েছে।
নায়িকাদের সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জনের জন্যই সবসময় প্রচারের আলোকবৃত্তে থেকেছেন শ্রীসন্থ। প্রথম যে নায়িকার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে গুঞ্জন শোনা গিয়েছিল, তিনি হলেন শ্রিয়া সরন।
২০০৮ সালে মুম্বইয়ে একটি ফ্যাশন শো-এ অংশ নেন শ্রীসন্থ এবং শ্রিয়া। এর পরই তাঁদের সম্পর্ক নিয়ে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। রেস্তরাঁয় নৈশভোজে এবং গাড়ির নিভৃতে তাঁদের একসঙ্গে দেখা গিয়েছিল।
তবে এই সম্পর্ককে অস্বীকার করেন শ্রিয়া। নায়িকা বলেন, শ্রীসন্থ এবং তিনি একটি পণ্যের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডার ছিলেন। সেই সূত্রেই আলাপ। একটি পার্টিতে মাত্র ৫ মিনিটের জন্য কথা বলেছিলেন। শ্রিয়ার দাবি, তার থেকে আলাপ বেশি দূর এগোয়নি। তবে শ্রিয়া এ কথাও জানিয়েছিলেন, কেরলের ক্রিকেটারের সঙ্গে কথা বলে তাঁর ভাল লেগেছিল।
শ্রিয়ার পরে শ্রীসন্থের জীবনে এসেছিলেন রিয়া সেন। ঘনিষ্ঠ মহলে কান পাতলে শোনা যায়, মুনমুনকন্যার রূপে মুগ্ধ ছিলেন শ্রীসন্থ। দু’জনের আলাপ হয়েছিল একটি পার্টিতে। সে সময় সদ্য যুবরাজ সিংহের সঙ্গে রিয়ার সম্পর্ক ভেঙে গিয়েছিল। আর এক ক্রিকেটার শ্রীসন্থের মধ্যে তিনি নিজের ক্ষত প্রশমনের জায়গা খুঁজে পেয়েছিলেন।
২০১১ সালে বেশ কিছু ক্রিকেট ম্যাচে শ্রীসন্থের পারফরম্যান্স দেখতে গ্যালারির ভিভিআইপি বক্সে হাজির ছিলেন রিয়া। এমনও শোনা যাচ্ছিল, দু’জনে খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চলেছেন। কিন্তু সে সব রয়ে যায় জল্পনার স্তরেই। এক বছর প্রেমপর্বের পরে দু’জনের সম্পর্ক ভেঙে যায়।
শোনা যায়, রিয়াই সরে এসেছিলেন শ্রীসন্থের কাছ থেকে। পরে টুইট করে তিনি জানান, শ্রীসন্থের সঙ্গে তাঁর কোনও সম্পর্ক নেই। তিনি আইপিএল-এ কেরলের তিনটি ম্যাচ দেখতে গিয়েছিলেন শুধু। কাজের বাইরে কোনও সম্পর্ক নেই শ্রীসন্থের সঙ্গে।
রিয়ার সঙ্গে বিচ্ছেদের পরে শ্রীসন্থ অবশ্য বেশি দিন সিঙ্গল থাকেননি। এ বার তাঁর পাশে বসে গিয়েছিল শাজাহন পদমজির নাম। থিয়েটার ব্যক্তিত্ব অ্যালেক পদমজি এবং গায়িকা শ্যারন প্রভাকরের মেয়ে শাজাহন ছিলেন সে সময়কার উঠতি নায়িকা। অভিনয় করেছিলেন ‘রকেট সিংহ: সেলসম্যান অব দ্য ইয়ার’ ছবিতে।
মুম্বই ছাড়িয়ে তাঁদের নাকি লং ড্রাইভের পথেও দেখা গিয়েছিল। কিন্তু সে কথা অস্বীকার করেন দু’জনেই। বলেছিলেন, তাঁরা একে অন্যের খুব ভাল বন্ধু। এবং দু’জনেই সিঙ্গল।
তৃতীয় যে নায়িকার নাম শ্রীসন্থের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল, সেই রাই লক্ষ্মী ছিলেন মূলত দক্ষিণী ইন্ডাস্ট্রির। ২০১৭ সালে বলিউডে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন ‘জুলি টু’ ছবিতে। কিন্তু নায়িকা হিসেবে বেশি উচ্চতায় নিজেকে নিয়ে যেতে পারেননি।
এই গুঞ্জনও অস্বীকার করেছিলেন শ্রীসন্থ। তবে একইসঙ্গে এও জানিয়েছিলেন তিনি রাই লক্ষ্মীর ছবির সেটে গিয়েছিলেন। তার পর থেকেই তাঁদের সম্পর্ক নিয়ে নানা রকম খবর ছড়িয়ে পড়তে থাকে। শ্রীসন্থের দাবি, বেঙ্গালুরুর মতো আধুনিক শহরে বড় হয়েছেন তিনি। ফলে তাঁর তিনি নিজেও মুক্তমনা। কিন্তু নায়িকাদের মানে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব মানেই তাঁর কাছে বিশেষ সম্পর্ক নয়।
কিন্তু শ্রীসন্থ এক দিকে নিজের দাবি জানিয়েছেন, অন্য দিকে একের পর এক নায়িকা এসে ‘হানা’ দিয়েছেন তাঁর সেলেব-তকমার পাশে। ডান্স রিয়েলিটি শো ‘এক খিলাড়ি এক হাসিনা’-য় অংশ নিয়েছিলেন শ্রীসন্থ। সেখানেই আলাপ সুরভিন চাওলার সঙ্গে।
তার পর শ্রীসন্থ-সুরভিন গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগেনি। ম্যাচ গড়াপেটায় শ্রীসন্থ জড়িয়ে পড়ার পরে সুরভিন তাঁর বার্তা পোস্ট করেছিলেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। ম্যাচ গড়াপেটার নিন্দা করে সুরভিন বলেন, শ্রীসন্থ তাঁর বন্ধু ঠিকই। কিন্তু সে সময় তাঁদের যোগাযোগ ছিল না। তবে শ্রীসন্থের জন্য কেরলে ক্রিকেট জনপ্রিয় হয়েছে, সে কথাও দাবি করেন সুরভিন।
তবে ঘনিষ্ঠ সূত্রের দাবি, এত ফর্মাল ছিল না তাঁদের সম্পর্ক। বরং, কোনও এক শ্যুটিং ইউনিটে নাকি সুরভিনের ফোনালাপ শুনে ফেলেছিলেন বাকিরা। সেখানে তাঁর কথা শুনে বোঝা যাচ্ছিল তিনি সম্পর্ক থেকে সরে যাওয়ার কথা বলছেন। ঘনিষ্ঠ মহলের দাবি, টেলিফোনের ওপারে ছিলেন শ্রীসন্থই।
শোনা যায়, সে সময় সুরভিন সিরিয়াল ছেড়ে ছবিতে অভিনয় শুরু করেছিলেন। সেটা মানতে পারেননি শ্রীসন্থ। কিন্তু সুরভিন নিজের কেরিয়ারের আগে অন্য কিছুকে গুরুত্ব দিতে চাননি। এই প্রসঙ্গে সুরভিনও জানান, তিনি কেরিয়ার ছাড়া অন্য কিছুতে ফোকাস করছেন না।
সাময়িক হলেও এক বার প্রিয়ঙ্কা চোপড়ার সঙ্গেও শ্রীসন্থের নাম জড়িয়ে গুঞ্জন রটেছিল। এই প্রসঙ্গে শ্রীসন্থ বলেছিলেন, তিনি নায়িকাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করেন। তার জেরেই তাঁদের সঙ্গে তাঁর নাম রোমান্টিক সম্পর্কে শোনা যায়।
২০১৩ সালের ১৬ মে দিল্লি পুলিশ মুম্বই থেকে গ্রেফতার করে শ্রীসন্থ-সহ রাজস্থান রয়্যালসের বাকি দুই ক্রিকেটার অজিত চাণ্ডিলা এবং অঙ্কিত চহ্বানকে। তাঁদের বিরুদ্ধে ষষ্ঠ আইপিএলে ম্যাচ গড়াপেটার অভিযোগ ছিল।
দিল্লি পুলিশের দাবি, শ্রীসন্থ মুম্বইয়ের কার্টার রোডে একটি পাঁচতারা হোটেলের সামনে এসইউইভি-তে এক মহিলার সঙ্গে মদ্যপ অবস্থায় ছিলেন। তিনি প্রথমে ভেবেছিলেন তাঁকে মদ্যপ অবস্থায় থাকার জন্য গ্রেফতার করা হচ্ছে।
শাস্তির মেয়াদ শেষে তাঁর উপর থেকে উঠেছে নির্বাসনের খাঁড়া। তবে ক্রিকেটের মূলস্রোতে তিনি আর ফিরতে পারবেন কি না, সে বিষয়ে সন্দিহান ক্রিকেট মহল। ইতিমধ্য়ে তিনি অভিনয় করেছেন ‘অকসর টু’, ‘ক্যাবারে’-সহ কিছু ছবিতে। ২০১৬ সালে যোগ দেন বিজেপি-তে। বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে অবশ্য পরাজিত হন।
জীবনের কঠিন সময়ে, ২০১৩ সালেই ভুবনেশ্বর কুমারীর সঙ্গে রাজকীয় অনুষ্ঠানে বিয়ে হয় শ্রীসন্থের। রাজকন্যা ভুবনেশ্বরী পেশায় এক জন জুয়েলারি ডিজাইনার। তাঁর পরিবার শ্রীসন্থ পরিবারের পূর্ব পরিচিত। শ্রীসন্থ জানান, তাঁদের বিয়ে অভিভাবকদের ঠিক করে দেওয়া। তিনি ছোটবেলা থেকেই চিনতেন ভুবনেশ্বরীকে। তবে প্রেমের অনুভূতি এসেছে অনেক পরে, ২০১২ সালে।
ক্রিকেটের বাইরে থাকা শ্রীসন্থকে নানা ভাবে অনুপ্রেরণা জোগাতেন ভুবনেশ্রী। তখন থেকেই তাঁর প্রতি শ্রীসন্থের মন দুর্বল হতে থাকে। তাঁর মনের ভাব বুঝেই সম্বন্ধ ঠিক করেন বাড়ির লোক। তবে বিয়ের ছাদনাতলাতেই তিনি প্রথম ভুবনেশ্বরীর হাত ধরেছিলেন। স্মৃতিচারণা করেছেন শ্রীসন্থ।
জাতীয় দলে শ্রীসন্থের অভিষেক হয়েছিল ২০০৫ সালে। সে বছরই প্রথম ওয়ান ডে ম্যাচে খেলেন তিনি। টেস্টে অভিষেক তার পরের বছর। ২৭ টেস্টে তাঁর মোট উইকেট ৮৭। রান করেছেন ২৮৪। সর্বোচ্চ ৩৫। ওয়ান ডে খেলেছেন ৫৩টি। উইকেট শিকার ৭৫টি। রান ৪৪। সর্বোচ্চ অপরাজিত ১০।
এ সব ক্রিকেটীয় পরিসংখ্যান থেকে বহু দূরে শ্রীসন্থের জীবন এখন আবর্তিত হয় স্ত্রী ভুবনেশ্বরী এবং মেয়ে সন্বিকা ও ছেলে সূর্যশ্রীকে ঘিরে। অন্য সম্পর্ক এবং বিতর্কও বিশেষ হানা দেয়নি তাঁর বিবাহিত জীবনে।