টক্কর: মহড়ায় দুই দলের অধিনায়ক। আরসিবির বিরাট এবং মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের রোহিত। বৃহস্পতিবার। টুইটার
এক জন অতি আগ্রাসনে বিশ্বাসী। অন্য জন ধীরস্থির, ঠান্ডা মাথায় কাজ সারতে ভালবাসেন। এক জন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের ঢংয়ে শরীরী ভাষার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পছন্দ করেন। অন্য জন মহেন্দ্র সিংহ ধোনির মতো ‘ক্যাপ্টেন কুল’ ঘরানার। এক জন আগুন হলে অন্য জন বরফ।
দাঁড়ান, এখানেই শেষ নয়। বিরাট কোহালি বনাম রোহিত শর্মা— চতুর্দশ আইপিএলের মারমার-কাটকাট বোধনের নেপথ্যে আরও মশলা রয়েছে যে! বিশেষ করে সাদা বলের দ্বৈরথে বিরাট ভারতীয় ক্রিকেটের রাজা হলে রোহিত হালফিলে জনতার ভোটে উঠে আসা প্রতিদ্বন্দ্বী। মাঝেমধ্যেই দাবি উঠছে, রোহিতকে সীমিত ওভারের অধিনায়ক করা হোক। বিরাট থাকুন লাল বলের রাজা। মুম্বই ইন্ডিয়ান্স পাঁচ বার ট্রফি জিতেছে রোহিতের নেতৃত্বে। বিরাটের অধিনায়কত্বে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোর এক বারও জেতেনি। কোহালির সঙ্গে গত দশ বারের সাক্ষাতে আট বার জিতেছেন রোহিত।
হাতের কাছে থাকা এ সব তথ্য দাঁড়িপাল্লায় তোলা হয় বারবার। সেই তুলনা নিশ্চয়ই বিরাটের কানে অনুষ্কার ফিল্মের জনপ্রিয় গানের রিংটোন হয়ে বাজে না। শুক্রবারের ‘ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শো’-তে চকমকি পাথরের মতো এ সব আগুনের স্ফুলিঙ্গ তৈরি করে দেবে না, কে বলতে পারে!
এমনিতে প্রত্যেক দিন লাখের উপর কোভিড আক্রান্তের সংখ্যার আতঙ্কের মাঝে ক্রিকেটীয় পরিসংখ্যান অনেকের কাছে অর্থহীন দেখাতে পারে। কোহালি জিতলেন না রোহিত, তার চেয়েও বেশি জরুরি প্রশ্ন, কোভ্যাক্সিন নেব না কোভিশিল্ড? ভয়ের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে আইপিএলের জৈব সুরক্ষা বলয়ের মধ্যেও। দলের সদস্যরা আক্রান্ত হচ্ছেন, ওয়াংখেড়েতে মাঠ কর্মীদের কোভিড ধরা পড়েছে, অন্তত পাঁচটি কেন্দ্রে (মুম্বই, চেন্নাই, বেঙ্গালুরু, দিল্লি ও আমদাবাদ) অতিমারি নিয়ে পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। তার মধ্যেই উড়ানে ওঠো, বিমানবন্দর দিয়ে বার বার প্রবেশ-প্রস্থান, হোটেলে বসবাস। বলয়ে বিষ ঢুকতে
কত ক্ষণ!
বোর্ড কর্তারা অবশ্য তাঁবু গুটিয়ে নেওয়ার মতো কিছু দেখছেন না। পাঁচ মাসের মধ্যেই তাই দ্বিতীয় আইপিএল এসে পড়েছে। চেন্নাইয়ের দর্শকশূন্য মাঠে তা শুরু হয়ে যাচ্ছে শুক্রবার। বোর্ড প্রেসিডেন্ট সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়-সহ সব শীর্ষস্থানীয় পদাধিকারী উদ্বোধনী দিনে শ্রীনিবাসনের শহরে উপস্থিত থাকছেন। এবং, নিশ্চিত থাকা যায়, গোল দড়ি পেরিয়ে এক বার মাঠে ঢুকে পড়লে বিরাট বা রোহিত কারও মাথাতেই আর অতিমারির আতঙ্ক থাকবে না। চলবে শুধু চোখে-চোখ রেখে লড়াই। যুদ্ধের সেই প্রাচীন প্রবাদ—চোখের পলক আগে ফেলেছ মানে তুমি শেষ!
চেন্নাইয়ের এম এ চিদম্বরম স্টেডিয়ামে উদ্বোধনী দিনে শুধুই দুই সেরা তারকার ব্যাটের ঝনঝনানি হতে চলেছে, বলা যাবে না। বরং নেতায়-নেতায় শিঙা ফোঁকাফুঁকিই আসল আকর্ষণ হতে যাচ্ছে। আইপিএল চালু হওয়ার পর থেকে শহর বনাম শহর, তারকা বনাম তারকা অভাবনীয় সব দ্বৈরথের চিত্রনাট্য তৈরি করে দিয়েছে। শুরুর সময়ে যেমন ছিল সৌরভ বনাম সচিন তেন্ডুলকর বা রাহুল দ্রাবিড়। পরে সৌরভ বনাম ধোনি। আরও পরে ধোনি বনাম গৌতম গম্ভীর। এখন তেমনই আইপিএলের এল ক্লাসিকো হচ্ছে বিরাট বনাম রোহিত। ক্রিকেটের মেসি বনাম রোনাল্ডো মহারণ।
দুই সেনাপতির রণসজ্জাও তৈরি। রোহিতের হাতে সদ্য ভারতের জার্সিতে স্বপ্নের অভিষেক ঘটানো সূর্যকুমার যাদব, ঈশান কিশানরা আছেন। পাঠান ভাইদের ছাপিয়ে পাণ্ড্য ভাইদের উত্থান ঘটেছে উল্কার মতো। দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করা পরিবারে প্র্যাক্টিস থেকে ফেরার পথে খাওয়ার জন্য জুটত শুধু ম্যাগি। তা খেয়েই গাড়ির মধ্যে ঘুমিয়ে পড়তেন দুই ভাই। হার্দিক-ক্রুণালের গলি থেকে রাজপথে উত্তরণের কাহিনি উদ্বুদ্ধ
করার মতো।
কোহালির হাতে তেমনই আছেন দুই তরুণ ভারতীয় স্পিনার যুজ়বেন্দ্র চহাল এবং ওয়াশিংটন সুন্দর। চেন্নাইয়ের পিচ বরাবরই স্পিন-সহায়ক। ক’দিন আগে জো রুটের ইংল্যান্ড সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে লুটিয়ে পড়েছিল। রোহিতের চেয়ে স্পিন বিভাগে বিরাটের দল এগিয়ে। চহাল, সুন্দরের সঙ্গে কাজে আসতে পারে গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের অফস্পিনও। চেন্নাই থেকে পিচ রিপোর্ট হচ্ছে, প্রথমার্ধে পেসাররা সাহায্য পেতে পারেন। পরের দিকে বল ঘুরবে। শিশিরের ভূমিকা কী হয়, সেটাও দেখার।
আরসিবি-র পেসারদের মধ্যে নবদীপ সাইনির সঙ্গী মহম্মদ সিরাজ। বাবাকে হারিয়েও যাঁর অস্ট্রেলিয়ায় ক্রিকেট রণক্ষেত্র ছেড়ে চলে না আসা বিরাটের নিজের বাবাকে হারিয়ে দিল্লিকে বাঁচানোর কথা মনে করিয়ে দিতে পারে। হায়দরাবাদের রাস্তায় অটো চালিয়ে রোজগার করে বাবা বোলিং জুতো কিনে দিতেন পুত্র সিরাজকে। পাণ্ড্য ভাইদের উত্থানের নেপথ্যেও সদ্য প্রয়াত পিতার লড়াই। আবেগরুদ্ধ করে দেওয়ার মতো সব জীবনকাহিনি রয়েছে দু’দলে। অভিযাত্রীর মতো ভয়ডরহীন ভাবে যাঁরা এগিয়ে চলেছেন জীবনের রাস্তা ধরে, ক্রিকেটকে সম্বল করে। এক-এক সময় মনে হচ্ছে, মানুষের মধ্যে উল্টো প্রতিক্রিয়াও তো হতে পারে। জীবনযুদ্ধের এই কাহিনিগুলো নেপথ্য-সঙ্গীতের মতো বাজতে থাকবে আর কোভিডের কঠিন সময়ে অনুপ্রেরণা হিসেবে লড়াইয়ের সুর তৈরি করে দিয়ে যাবে হয়তো।
ও দিকে রোহিতের রয়েছে যশপ্রীত বুমরা, ট্রেন্ট বোল্ট, নেথান কুল্টার-নাইলদের নিয়ে তৈরি পেস ব্যাটারি। বুমরার গতি-বাউন্স, বোল্টের সুইং। বিরাট, এ বি ডিভিলিয়ার্সদের ব্যাটিং বনাম মুম্বই পেস বোলিং শুরুতেই আইপিএলের টিআরপি বাড়িয়ে দিতে পারে। ছোটবেলায় মায়ের ঘুম ভাঙাবেন না বলে দরজায় কাপড় রেখে বল করতে গিয়ে ইয়র্কার শেখা বুমরা বনাম ছোটবেলায় বাবার স্কুটারে চড়ে ক্রিকেটের হাইওয়েতে পাড়ি দেওয়া বিরাটের দ্বৈরথ নিয়ে সারা ক্রিকেট বিশ্ব ফুটছে। বিরাট বলে দিয়েছেন, ওপেন করবেন। তা হলে শুরুতেই কি দেখা যাবে এই লড়াই? না কি হালফিলে স্পিনারদের বিরুদ্ধে বিরাটের অস্বস্তির কথা মাথায় রেখে শুরুতে লেগস্পিনার রাহুল চাহারকে নিয়ে আসবেন রোহিত?
মুম্বইয়ের আছে কায়রন পোলার্ড, হার্দিকের মতো ছক্কার ওস্তাদেরা। আরসিবি এ বার কিনেছে গ্লেন ম্যাক্সওয়েলকে। সঙ্গে ‘মিস্টার ৩৬০ ডিগ্রি’ ডিভিলিয়ার্স তো আছেনই। উইকেটের চারদিকে শট খেলতে পারেন বলেই এমন নামকরণ। যেমন কপিবুক কভার ড্রাইভ মারেন, তেমনই গ্যালারিতে ছক্কাবৃষ্টি ঘটাতে পারেন। এ বি যেন একই সঙ্গে শিল্পী এবং সংহারক।
ক্রিস গেল, আন্দ্রে রাসেলদের মতো শক্তিমান না হয়েও অসাধারণ সময়জ্ঞানে কী অনায়াস ভঙ্গিতে ছক্কা মারেন রোহিত শর্মা! আর বিরাট হলেন সেই হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা, যাঁর সুরে সম্মোহিত ক্রিকেট বিশ্ব। ব্যাট দোলাতে দোলাতে তাঁর ক্রিজের দিকে এগিয়ে যাওয়া হলিউড ফিল্মের দুঃসাহসিক নায়কের আবির্ভাব দৃশ্যের মতোই রোমহর্ষক। ভিভ রিচার্ডসের পর এত ঔদ্ধত্যপূর্ণ ভঙ্গিতে আর কেউ প্যাভিলয়ন থেকে বাইশ গজের দিকে হেঁটে যাননি।
স্বপ্নের দ্বৈরথ দিয়েই দেশের মাঠে ফিরছে আইপিএল। সন্ধে সাড়ে সাতটা বাজতে আর কত ক্ষণ!