ঋষভ অনেক ম্যাচ জেতাবে, বিদায়বেলায় বললেন যুবি

ওয়ান ডে ক্রিকেটে দশ হাজার রান না করতে পারায় আমার কোনও দুঃখ নেই। আমি বিশ্বকাপ জিততে চেয়েছি ছোট থেকেই। তাই বিশ্বকাপ জয় আমার কাছে দশ হাজার রান করার চেয়েও বিশেষ মুহূর্ত।  

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১১ জুন ২০১৯ ০৪:২৬
Share:

আবেগাশ্রু: অবসর ঘোষণার দিন সাংবাদিকদের সামনে চোখের জল ধরে রাখতে পারলেন না যুবরাজ সিংহ। সোমবার। পিটিআই

ওয়ান ডে ক্রিকেটে দশহাজার রান করার চেয়েও বিশ্বকাপ জেতাকেই গুরুত্ব দিয়েছেন বেশি। খেদ রয়েছে টেস্টে কেরিয়ার দীর্ঘ না হওয়ার জন্যও। ক্রিকেট থেকে বিদায় নেওয়ার দিনে যুবরাজ সোমবার সাংবাদিকদের যা বললেন তা তুলে ধরা হল:

Advertisement

বাবার সঙ্গে সম্পর্ক: কয়েক দিন আগে বাবার সঙ্গে আড্ডা দিতে গিয়ে দারুণ শান্তি পেলাম। আমরা দু’জনে নিজেদের অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা করছিলাম। গত ২০ বছর ধরে বাবার সঙ্গে এই আড্ডাটাই হয়নি। কারণ, উনি সব সময়েই আমার কাছে ড্রাগনের মতো রাগী। বাবার জন্যই আমার ক্রিকেটার হওয়া। বাবা ছোটবেলায় প্রায়ই বলতেন ১৯৮৩ সালে ভারত যখন বিশ্বকাপ জেতে সে দিন ওই দলে না থাকার জন্য খুব দুঃখ হয়েছিল তাঁর। বাবা সেই দুঃখ ভুলে গিয়েছিলেন যখন আমি বিশ্বকাপ হাতে তুলেছিলাম।

ওয়ান ডে-তে দশ হাজার রান না করেও খুশি: দশ হাজার রান করতে পারলে রেকর্ড বুকে নাম ওঠে। পরবর্তী প্রজন্ম সম্মানের চোখে দেখে। কিন্তু ওয়ান ডে ক্রিকেটে দশ হাজার রান না করতে পারায় আমার কোনও দুঃখ নেই। আমি বিশ্বকাপ জিততে চেয়েছি ছোট থেকেই। তাই বিশ্বকাপ জয় আমার কাছে দশ হাজার রান করার চেয়েও বিশেষ মুহূর্ত।

Advertisement

ইয়ো ইয়ো টেস্ট: খেলা ছাড়ার পরে এখন কথা বলার অনেক সময় পাব। অনেক কিছু বলার আছে। কিন্তু এখন বলার সময় নয়। ভারত বিশ্বকাপে খেলছে। তাই বিতর্ক তৈরি করতে চাই না। সবার মতো আমিও চাই লিগ পর্যায়ে প্রথম চারে থাকুক ভারত। সময় আসবে। তখন এই ব্যাপারে কথা বলা যাবে।

ক্যানসারকে হারানো: কখনও চাইনি ক্যানসার আমাকে হারিয়ে দিয়ে যাক। ২০১১ সালে বিশ্বকাপে প্রতিযোগিতার সেরা ক্রিকেটার হওয়া, চার ম্যাচে সেরা হওয়া ছিল আমার কাছে একটা স্বপ্নের মতো। কিন্তু সেই মধুর মুহূর্ত ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল, যখন জেনেছিলাম আমার ক্যানসার হয়েছে। তখন আমি কেরিয়ারের শিখরে। ব্যাপারটা সাফল্যের আকাশ ছুঁয়ে আলোর গতিতে শক্ত মাটিতে ছিটকে পড়ার মতোই। দ্রুতই এ সব ঘটেছিল। সেই সময়ে পরিবার ও যে বন্ধুরা পাশে দাঁড়িয়েছিল, সেটা ভুলতে পারিনি। ওদের ভালবাসাই ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়ার সাহস ও শক্তি দিয়েছিল।

প্রত্যাবর্তন: ক্যানসার সারিয়ে ফিরে এসে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে জায়গা খুঁজে নেওয়াটা জীবনের অন্যতম কঠিন মুহূর্ত। ফিরে এসে ২০১৪ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালে যখন শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ২১ বলে ১১ রান করেছিলাম, অনেকেই বলেছিলেন আমি শেষ। নিজেও খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু আস্থা হারাইনি নিজের প্রতি। যাঁরা আমার প্রতি আস্থা হারিয়েছিলেন, তাঁদের ভুল প্রমাণিত করতে পেরে খুব আনন্দ হয়েছিল পরবর্তীকালে।

নিজেকে কার মধ্যে দেখছেন এখন: আমার মতো নয়। সে আমার চেয়েও ভাল। সেই ছেলে হল ঋষভ পন্থ। যে ইতিমধ্যেই অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডে গিয়ে টেস্ট শতরান করে ফেলেছে। আমার মতে ঋষভ একই সঙ্গে দারুণ প্রতিভাবান ও আগ্রাসী। বাঁ হাতি এই ব্যাটসম্যান আগামী দিনে ভারতের হয়ে অনেক ম্যাচ জেতানো ইনিংস খেলবে। আগামী বছরগুলোতে তা দেখার অপেক্ষায় থাকব।

যে অধিনায়করা প্রভাব ফেলেছেন: প্রথম নামটা অবশ্যই সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর অধিনায়কত্বেই আমার জাতীয় দলে অভিষেক। আমাকে প্রচুর সাহায্য করেছেন তিনি। আর অবশ্যই মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। এদের অধিনায়কত্বে খেলে আমি অনেক প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। সৌরভ সবসময় আমি, আশিস (নেহরা), ভাজ্জু (হরভজন সিংহ), জ়াহির খান ও বীরেন্দ্র সহবাগকে দলে রাখার জন্য লড়াই করতেন। আমাদের দলটা উনিই তৈরি করেছিলেন। ধোনি আবার চাপের মুখে খুব শান্ত থাকতে পারে। খেলা চলার সময়ে উইকেটের পিছনে দাঁড়িয়ে ম্যাচটা দারুণ বিশ্লেষণ করে।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকের আগের দিনে ভাবনা: সৌরভ আমাদের অধিনায়ক। ম্যাচের আগের রাতে এসে বললেন, ‘‘তোকে ওপেন করতে হবে।’’ বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়া। বোলার ব্রেট লি, জেসন গিলেসপি, গ্লেন ম্যাকগ্রা। এঁদের বিরুদ্ধে ওপেন! তাই রাতে চিন্তায় ঘুম আসছিল না। পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ওপেন করার জন্য মানসিক ভাবে তৈরি হয়ে গিয়েছিলাম। তখন সৌরভ ফের ডেকে বললেন, ‘‘তোকে ওপেন করতে হবে না। মজা করছিলাম।’’ আমিও বলেছিলাম, ‘‘তোমার এই মজা একদিন সুদে-আসলে ফিরিয়ে দেব।’’ ব্যাট করতে গেলে কোনও চাপ থাকে না। চাপ তো বাইরে। মাঠে একবার নেমে পড়লে আমি আর বল ছাড়া চাপের কোনও জায়গা নেই।

সৌরভকে পাল্টা: কয়েক বছর পরেরর ঘটনা। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ম্যাচ। আমি আর হরভজন মিলে একটা ভুয়ো খবরের কাগজের কাটিং তৈরি করি। যেখানে ওঁর দলের কয়েকজনের তুমুল সমালোচনা করা হয়। সেটা ওঁকে দেখানো হয় মাঠে। যা দেখে সৌরভ উত্তেজিত হয়ে বলেন, ‘‘আর এই দলের অধিনায়কত্বই করব না।’’ আমরা শুনে বলি, ‘‘এপ্রিল ফুল দাদা।’’

কোন বোলারকে খেলা কঠিন ছিল: আমার মতে, যাদের বিরুদ্ধে খেলেছি, তাদের মধ্যে মুথাইয়া মুরলীধরনকে খেলা ছিল কঠিন। অপর জন গ্লেন ম্যাকগ্রা।

কোন বিদেশি খেলোয়াড়কে শ্রদ্ধা করেন: ব্যাটসম্যান হিসেবে রিকি পন্টিংকে আমি অসম্ভব শ্রদ্ধা করি। আর এবি ডিভিলিয়ার্স, ক্রিস গেলদের বিরুদ্ধে খেলার সময় মনে হত, ক্রিকেটের প্রকৃত পাওয়ার হাউস এরাই।

চাপের মুখে খেলা: চাপের মুখে সব সময় ভাল খেলেছি। তিন বা চার উইকেট পড়ে যাওয়ার পড়ে মাঠে নেমে রান করা আমার কাছে ছিল চ্যালেঞ্জ। ন্যাটওয়েস্ট ফাইনালে আমি ও মহম্মদ কাইফ মিলে ভারতকে জিতিয়েছিলাম, তখন থেকেই আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠেছিল, এই বয়সে যদি এই অসম্ভব কাজটা করে ফেলতে পারি, তা হলে আগামী দিনে এর চেয়েও কঠিন পরিস্থিতি পার হওয়া যাবে। তবে প্রকৃত চাপের মুখে পড়েছিলাম ক্যানসারকে হারিয়ে মাঠে ফেরার পথে। ফিটনেস ছিল না। তা ফিরে পাওয়ার জন্য ফ্রান্সে অনুশীলন করতে গিয়েছিলাম। যখন দেশে ফিরলাম, তখন ডানকান ফ্লেচার আমাদের কোচ। সেই সময়ে মাঠে নেমে পুরনো ছন্দে খেলতে গেলে চাপ অনুভব করতাম। কারণ, আমার চারপাশ তখন বদলে গিয়েছিল। সকলেই বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন, আমি ক্যানসার থেকে সেরে উঠেছি। আর আগের ছন্দে খেলতে পারব না। তাদের ভুল প্রমাণিত করাই ছিল আমার জীবনে সবচেয়ে বড় চাপ। কিন্তু এর জন্য কাউকে দোষ দিই না। এটাই জীবন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement