অধিনায়ক হিসেবে টেস্টে প্রথম বার হোয়াইটওয়াশের লজ্জার মুখে পড়লেন বিরাট কোহালি। বিশ্বের এক নম্বর টেস্ট দল ভারতকে চরম লজ্জার মুখে পড়তে হল নিউজিল্যান্ডে। এর আগে একদিনের সিরিজেও ০-৩ হোয়াইটওয়াশ হতে হয়েছে দলকে। এ বার দুই টেস্টের সিরিজেও দুরমুশ হতে হল টিম ইন্ডিয়াকে।
এর আগে ২০১২ সালে অস্ট্রেলিয়ায় শেষ বার টেস্টে হোয়াইটওয়াশ হতে হয়েছিল ভারতকে। সে বার মহেন্দ্র সিংহ ধোনির দল ব্র্যাডম্যানের দেশে এসে ০-৪ হেরেছিল টেস্ট সিরিজে। তার পর এটাই প্রথম। অবাক করার মতো হচ্ছে, টি-টোয়েন্টি সিরিজে ভারতই ৫-০ হোয়াইটওয়াশ করেছিল কিউয়িদের!
এই সফরে ক্রমশ খারাপ থেকে আরও খারাপ হয়েছে ভারতের পারফরম্যান্স। ব্যাটসম্যানরা ক্রমশ ফর্ম হারিয়েছেন। বড় জুটি গড়তে পারেননি। বোলাররা সঠিক সময় উইকেট নিতে পারেননি। কোহালির নেতৃত্ব নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন।
প্রধান কোচ রবি শাস্ত্রী একসময় দাবি করতেন যে, বিদেশ সফরের রেকর্ডে কোহালিরাই গত ১৫ বছরে ভারতের সেরা দল। কিন্তু, পারফরম্যান্স অন্য কথাই বলছে। এ আগে ২০১৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে ১-২ সিরিজ হেরেছে দল। ২০১৮ সালেই ইংল্যান্ডে টেস্ট সিরিজ হারতে হয়েছে ১-৪ ফলে।
ইয়ান চ্যাপেলের মতে, ওপেনিংয়ে রোহিত শর্মার অনুপস্থিতি ভুগিয়েছে ভারতকে। রোহিত আক্রমণাত্মক মেজাজে শুরু করতেন। যা চাপ কমিয়ে দিত পরের ব্যাটসম্যানদের উপর। সেটাই দেখা যায়নি এই টেস্ট সিরিজে। বিরাট কোহালিকে সে জন্যই প্রথম টেস্ট হারের পর ব্যাটসম্যানদের ইতিবাচক থাকার কথা মনে করিয়ে দিতে হয়েছিল।
ভারতের দুই ওপেনার ময়াঙ্ক আগরওয়াল ও পৃথ্বী শ ভরসা দিতে পারেননি। ময়াঙ্কের তো পুরো নিউজিল্যান্ড সফরই খারাপ কাটল। ওয়ানডে সিরিজ ও টেস্ট সিরিজ মিলিয়ে মাত্র এক বারই পঞ্চাশের গণ্ডি পার করেছেন। চার ইনিংসে করেছেন মাত্র ১০২ রান। দুর্ভাগ্য হল, টেস্ট সিরিজে ময়াঙ্কের রানই দলের সর্বাধিক রান!
হ্যাঁ, ময়াঙ্কের ১০২ রানের চেয়ে বেশি করতে পারেননি কোনও ব্যাটসম্যান। পৃথ্বী শ অবশ্য কাছাকাছিই আছেন। চার ইনিংসে একটি পঞ্চাশ সহ করেছেন ৯৮। মুশকিল হল, বড় রানের সুযোগ হেলায় হাতছাড়া করেছেন তিনি। বাউন্সারের বিরুদ্ধে প্রশ্ন উঠছে তাঁর টেকনিক নিয়ে। অতিরিক্ত আগ্রাসী হতে গিয়ে উইকেট ছুড়েও দিয়েছেন তিনি।
পৃথ্বীর সমস্যা যদি হয় অতিরিক্ত আগ্রাসন, তবে চেতেশ্বর পূজারা আবার রক্ষণাত্মক খোলসের মধ্যে ঢুকে পড়ছেন। যার থেকে বের করা যাচ্ছে না তাঁকে। চার ইনিংসে তাঁর ব্যাটে এসেছে ১০০ রান। কিন্তু, তার থেকেও জরুরি হল, রাউন্ড দ্য উইকেট থেকে ট্রেন্ট বোল্টের বাঁক খাওয়ানো ডেলিভারি তাঁর টেকনিকের দুর্বলতা প্রকাশ্যে এনে দিয়েছে।
বিরাট কোহালির ব্যাডপ্যাচ অব্যাহত। চার ইনিংসে তাঁর ব্যাটে এসেছে ৩৮ রান। গড় খুব খারাপ, দশও নয়! কাট করে ভিতরে ঢুকে পড়া ডেলিভারি বার বার স্টাম্পের সামনে পেয়ে যাচ্ছে তাঁর পা। এলবিডব্লিউ হওয়ার পাশাপাশি অফস্টাম্পের বাইরের ডেলিভারিতে খোঁচা দিয়েও আউট হয়েছেন।
আজিঙ্ক রাহানে চার ইনিংসে করেছেন ৯১ রান। কিন্তু বাউন্সারের বিরুদ্ধে তাঁকে অস্বস্তিতে দেখিয়েছে বার বার। কিউয়ি বোলাররা ক্রমাগত শর্টপিচড ডেলিভারিতে অতিষ্ঠ করে তুলেছেন তাঁকে। মাথায়ও বল লেগেছে তাঁর। যা তাঁর টেকনিক নিয়েও তুলছে প্রশ্ন।
হনুমা বিহারী চার ইনিংসে করেছেন ৮৬। ক্রাইস্টচার্চ টেস্টের প্রথম দিন চায়ের বিরতির ঠিক আগে পরের তিন বলে যে ভাবে ব্যাট চালিয়ে শেষে আউট হলেন, তাতে তাঁর মানসিকতা নিয়েও প্রশ্ন থাকছে। কখন মারতে হবে, কখন ক্রিজে সময় কাটাতে হবে, এটা পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে। যা বিহারীর এর মধ্যেই শেখা উচিত ছিল।
ঋষভ পন্থকে এই দুই টেস্টে খেলানো হয়েছিল ব্যাটিং গভীরতার আনতে। কিন্তু, ব্যাট হাতে সেই ভরসা দিতে পারেননি তিনি। চার ইনিংসে করেছেন মাত্র ৬০ রান। তাঁর উইকেট হওয়ার ভঙ্গিতেও পরিষ্কার যে, ব্যাটসম্যান হিসেবেও অনেক উন্নতি করতে হবে তাঁকে।
সামগ্রিক ভাবে ব্যাটিং বিভাগই ব্যর্থ। প্রথম টেস্টে কোনও ইনিংসেই দুশো রান ওঠেনি। দ্বিতীয় টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে ১২৪ রানে শেষ হয় ইনিংস। দুই টেস্টে মাত্র এক বারই দুশো পেরিয়েছে স্কোর। জুটিই তৈরি হয়নি। টপ অর্ডার, মিডল অর্ডার, লোয়ার অর্ডার— সবাই এমন ব্যাটিং করলে হোয়াইটওয়াশই পরিণতি।
সবুজ উইকেট, সিম-সুইংয়ের উপযোগী কন্ডিশন, নিখুঁত লাইন-লেংথে বোল্ট-সাউদিদের বিরামহীন বোলিংয়ের সামনে হাঁসফাঁস করেছেন ব্যাটসম্যানরা। তা থেকে বের করার কোনও উপায় পাননি। চাপ কাটাতে চরিত্রবিরোধী শট নিতে বাধ্য হয়েছেন পূজারাও। যদিও তাতে আউটই হতে হয়েছে, রান আসেনি।
ভারতীয় বোলাররা আবার এটাই পারেননি। লাগাতার চাপ রেখে যেতে পারেননি। শুরুতে উইকেট পাননি যশপ্রীত বুমরা, মহম্মদ শামিরা। ফলে, ওপেনিংয়ে বড় জুটি গড়েছেন টম লাথাম, টম ব্লান্ডেলরা। নতুন বলে উইকেট নিতে না পারা চাপ বাড়িয়েছে ক্রমশ।
এটা ঘটনা, দুই টেস্ট মিলিয়ে ভারতীয়দের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উইকেট নিয়েছেন বুমরা। তাঁর দখলে ছয় উইকেট। কিন্তু ভারতের হারের বড় কারণ তিনিই। নতুন বলে আঘাত হানতে পারেননি তিনি। আগের ছায়া মনে হয়েছে তাঁকে। ৩১.৬৬ গড়, ৬১.৬ স্ট্রাইক রেট সেটাই দেখাচ্ছে।
মহম্মদ শামি পাঁচ উইকেট নিয়েছেন দুই টেস্টে। কিন্তু, তাঁর গড় আরও খারাপ, ৩৬.৬০। সবুজ পিচে শামিদের থেকে যে তীক্ষ্ণতা চাইছিল দল, তা অনুপস্থিত থেকেছে। অবশ্য ইশান্ত শর্মার জায়গায় সুযোগ পাওয়া উমেশ যাদব আরও খারাপ বল করেছেন।
অবশ্য ভাগ্যও সঙ্গ দেয়নি বিরাটদের। দুই টেস্টেই টসে হেরেছেন বিরাট। ফলে দুই ক্ষেত্রেই সবুজ পিচে প্রথমে ব্যাট করতে হয়েছে ভারতকে। টস জিতে কিউয়িদের ব্যাটিং করতে পাঠালে হয়ত ছবিটা আলাদা হতেও পারত।