শুধু চরম লজ্জার নয়, চরম অপমানেরও। ওয়েলিংটনের বেসিন রিজার্ভে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ভারতের ১০ উইকেট পরাজয় সেই কারণেই তিক্ত হয়ে উঠছে ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে। আইসিসির বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ শুরু হওয়ার পর এই প্রথম টেস্ট হারল বিরাট কোহালির দল। শুধু পরাজয় নয়, রীতিমতো আত্মসমর্পণ করেছে টিম ইন্ডিয়া। কেন এমন হল? ময়নাতদন্তে উঠে আসছে বেশ কিছু এই কারণ।
এটা ঘটনা, ঐতিহ্যগত ভাবেই ওয়েলিংটন ভারতের প্রিয় মাঠগুলোর মধ্যে পড়ে না। ১৯৬৮ সালে এই মাঠে প্রথম বার টেস্ট খেলতে নেমেই জিতেছিল ভারত। এবং সেটাই বেসিন রিজার্ভে একমাত্র সাফল্য। ১৯৭৬, ১৯৮১, ১৯৯৮, ২০০২— টানা চার বার এখানে টেস্ট হেরেছিল ভারত। ২০০৯ ও ২০১৪ সালে হয়েছিল ড্র। আর এ বার ফের হার।
টেস্টে হারের পর বিরাট কোহালি বলেছেন টস হেরে প্রথমে ব্যাট করতে যাওয়ার কথা। সকালের সেশনেই তিন উইকেট পড়ে গিয়েছিল ভারতের। সেই ধাক্কা আর কাটানো যায়নি। সবুজ পিচ, ঝোড়ো হাওয়া মিলেমিশে টিম সাউদিদের বিধ্বংসী করে তুলেছিল। কিন্তু প্রতিকূল পরিবেশে খেলা তো ক্রিকেটেরই অঙ্গ। তা কি ভুলে গেলেন কোহালিরা।
রবি শাস্ত্রী থেকে বিরাট কোহালি বার বার বলেন যে, কন্ডিশনকে তাঁরা হিসেবের বাইরে রাখতে ভালবাসেন। মানে, পরিবেশ-পরিস্থিতি যেমনই হোক, পিচ যেমনই হোক, তা যেন দলের পারফরম্যান্সে প্রভাব না ফেলে। কথাগুলো শুনতে ভাল, কিন্তু বাস্তব ছবি অন্য কথাই বলছে। বেসিন রিজার্ভে ১০ উইকেটে হারেই যা প্রতিফলিত।
ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের মানসিকতাও রক্ষণাত্মক ছিল। টেস্টে যখন নতুন বলের বোলাররা সেরা ছন্দে থাকেন, তখন ব্যাটসম্যানদের সেই সময়টুকু পার করে দিতে হয় ঠিকই। কিন্তু, খারাপ বলে রানটাও করতে হয়। না হলে বিপক্ষ ঘাড়ে চেপে বসে। কিন্তু, দুই ইনিংসেই খোলসে ঢুকে পড়েছিলেন ব্যাটসম্যানরা।
স্ট্রাইক রেট দেখলেই যা পরিষ্কার। চেতেশ্বর পূজারার দুই ইনিংসের স্ট্রাইক রেট যথাক্রমে ২৬.১৯ ও ১৩.৫৮। অজিঙ্ক রাহানের স্ট্রাইক রেট যথাক্রমে ৩৩.৩৩ ও ৩৮.৬৭। হনুমা বিহারির সেটাই ৩৫ ও ১৮.৯৯। এত সাবধান হয়ে যে লাভ হয় না, তা ভারতের কোনও ইনিংসেই দু’শো করতে না পারায় স্পষ্ট।
ঘুরে দাঁড়াতে গেলে এই অতিরিক্ত সতর্কতা ঝেড়ে ফেলতেই হবে। খারাপ বলে রান করতে না পারলে চাপ কাটিয়ে ওঠা যায় না। পূজারা যেমন দ্বিতীয় ইনিংসে ঠুকে ঠুকে খেলে শেষে বল ছেড়ে দিয়ে বোল্ড হলেন। ফলে তাঁর এত ক্ষণ ক্রিজে থাকা মূল্যহীন হয়ে পড়ল। মাথায় রাখতে হবে, আউট হওয়ার বলটা যে কোনও সময় আসতেই পারে।
বিরাট কোহালির মতে, নিউজিল্যান্ডের প্রথম ইনিংসে সাত উইকেট নেওয়া পর্যন্ত বোলাররা উজাড় করে দিয়েছিলেন। ঠিকই, কিন্তু প্রশ্ন হল, কেন টেলএন্ডারদের আউট করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার রোগ সারানো যাচ্ছে না। এমন নয় যে বেসিন রিজার্ভেই প্রথম বার বিপক্ষের তলার দিকের ব্যাটসম্যানরা ম্যাচ ছিনিয়ে নিয়ে চলে গেলেন!
ভারতের দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে ভার্নন ফিল্যান্ডাররা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন ভারতীয় বোলারদের সামনে। ইংল্যান্ড সফরে স্যাম কুরানরা তফাত গড়ে দিয়েছিলেন। এ বার বেসিন রিজার্ভে কাইল জেমিসন ও ট্রেন্ট বোস্ট সেই পুরনো ক্ষতই খুঁচিয়ে দিলেন। এবং টেস্টে চালকের আসনে বসিয়ে দিলেন নিউজিল্যান্ডকে।
টেস্ট সিরিজে ফিরতে হলে বিশেষজ্ঞ নয়, এমন ব্যাটসম্যানদের দ্রুত ফেরাতেই হবে। না হলে, প্রথম সারির ব্যাটসম্যানদের ফিরিয়েও লাভ হবে না। বেসিন রিজার্ভ কিন্তু চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল বোলারদের কোথায় দুর্বলতা। তাই সে দিকে নজর দিতে হবে জলদি। কী ভাবে টেলএন্ডারদের ফেরানো যায়, শামিদের সেই ছক কষতে হবে এখনই।
প্রশ্নের মুখে যশপ্রীত বুমরা, মহম্মদ শামিও। অতীতেও দেখা গিয়েছে যে ভারতীয় বোলাররা সবুজ পিচ পেয়েও নিজেদের মেলে ধরতে পারেননি। টিম সাউদি, ট্রেন্ট বোল্ট, কাইল জেমিসনরা কিন্তু অভ্রান্ত লাইন-লেংথে বল করে গিয়েছেন। স্বস্তিতে থাকতে দেননি ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের। সেই শৃঙ্খলা অনুপস্থিত ছিল বুমরাদের।
অতীতে দেখা গিয়েছে, সিম-সুইং সহায়ক পরিবেশে বিপক্ষ পেসাররা বিপজ্জনক হয়ে উঠলেও ভারতীয়রা তা কাজে লাগাতে পারেননি। কখনও জেমস অ্যান্ডারসন, কখনও সাউদি-বোল্টরা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছেন। এটা কেন হচ্ছে, সেটাও বের করতে হবে টিম ম্যানেজমেন্টকে।
এবং ব্যাটিং টেকনিক। পৃথ্বী শ কি সত্যিই উপমহাদেশের বাইরে টেস্টে ওপেন করার মতো টেকনিক ধরেন? প্রশ্নের আকার কিন্তু বাড়ছে। ময়াঙ্ক আগরওয়ালই বা কেন বার বার ক্রিজে জমে গিয়েও উইকেট ছুড়ে দিচ্ছেন। পূজারা, রাহানে, হনুমাকে থাকতে হবে ইতিবাচক। রানের সুযোগ হারানো চলবে না।
এ বার অবশ্যই বিরাট কোহালি। বোঝাই যাচ্ছে, ব্যাডপ্যাচ চলছে। কিন্তু তাঁর ব্যাটে রান জরুরি। অতীতেও দুঃসময় কাটিয়ে ফিরে এসেছিলেন তিনি। এ বারও নিশ্চয়ই আসবেন। আর সেটা ক্রাইস্টচার্চে ২৯ ফেব্রুয়ারি থেকে সিরিজের শেষ টেস্টে হলেই ভাল। না হলে দ্বিতীয় টেস্টেও ঘুরে দাঁড়ানো মুশকিল।