আবেগ: সতীর্থদের বিদায় জানিয়ে চোখে জল ইনিয়েস্তার। ছবি: এএফপি
অবিশ্বাস্য! ফুটবলকে কেন্দ্রে করে উন্মাদনা যে এই উচ্চতায় পৌঁছতে পারে, রবিবার ক্যাম্প ন্যু-তে না গেলে অজনাই থেকে যেত। প্রায় এক লাখ দর্শক কখনও গান গাইছেন, কখনও কাঁদছেন!
লিয়োনেল মেসি ও আন্দ্রে ইনিয়েস্তার জন্য আমি বার্সেলোনার ভক্ত। স্বপ্ন দেখতাম, ক্যাম্প ন্যু-তে বসে প্রিয় দুই নায়কের একটা ম্যাচ অন্তত দেখব। কিন্তু নানা কারণে সেই স্বপ্ন অধরাই থেকে গিয়েছিল। মাস তিনেক আগে যখন শুনলাম বার্সেলোনায় এটাই শেষ মরসুম ইনিয়েস্তার, তখনই সিদ্ধান্ত নিই ক্যাম্প ন্যু-তে আমাকে যেতেই হবে। লা লিগার ক্রীড়াসূচিতে দেখলাম, রিয়াল সোসিদাদের বিরুদ্ধে বার্সেলোনা শেষ ম্যাচ খেলবে ঘরের মাঠে। আর দেরি করিনি। সঙ্গে সঙ্গেই টিকিট কেটে ফেললাম। টিকিটের দাম ভারতীয় মুদ্রায় ১৩ হাজার ৮০০। অবশ্য ৩০ হাজার টাকা হলেও আমি কাটতাম। আমার দাদা অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ও বার্সেলোনার সমর্থক। দাদা ও বৌদির সঙ্গে প্যারিস হয়ে রবিবার সকালে পৌঁছলাম বার্সেলোনায়। ম্যাচ শুরু হওয়ার ঘণ্টা দু’য়েক আগে স্টেডিয়ামের উদ্দেশে রওনা হলাম। রাস্তায় নেমেই চমকে গেলাম। বার্সেলোনার জার্সি গায়ে, পতাকা হাতে গান গাইতে গাইতে হাঁটছেন অসংখ্য মানুষ। স্প্যানিশ ভাষায় গানের অর্থ হল— ‘আন্দ্রে তোমাকে ধন্যবাদ এত বছর ধরে আমাদের আনন্দ দেওয়ার জন্য। তোমাকে কখনও ভুলব না।’
আমি ইস্টবেঙ্গলের সমর্থক। কলকাতা ময়দানে খেলা দেখেই বড় হয়েছি। আমি নিজেও অসংখ্য বার ভাইচুং ভুটিয়ার নামে জয়ধ্বনি দিতে দিতে যুবভারতীতে ঢুকেছি। কিন্তু এ রকম স্বতঃস্ফূর্ততা, আবেগ এক জন ফুটবলারকে নিয়ে কখনও দেখিনি। পুরো ম্যাচটাই বার্সেলোনা সমর্থকরা ক্লান্তিহীন ভাবে গান গেয়ে গেলেন। বার্সেলোনার দলেরও নিজস্ব গান রয়েছে। ম্যাচের সময় সেই গান গেয়ে ফুটবলারদের উদ্বুদ্ধ করেন সমর্থকেরা। কিন্তু রবিবারের ক্যাম্প ন্যু-র পুরোটাই ছিল ইনিয়েস্তাময়।
ম্যাচের ৮২ মিনিটে ইনিয়েস্তা যখন চির দিনের মতো ক্যাম্প ন্যু ছেড়ে বেরিয়ে আসছেন, তখন আবহটা সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছিল। সবাই কাঁদছে! শুনেছিলাম, বার্সেলোনার ফুটবলারদের মধ্যে এক মাত্র ইনিয়েস্তাকেই কখনও রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থকরা কটাক্ষ করেননি। সান্তিয়াগো বের্নাবাউতে উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান জানান। রবিবার সেটা উপলব্ধি করলাম। আমাদের ঠিক পাশেই এক জন রিয়াল ভক্ত বসেছিলেন। তিনি বললেন, ‘‘বার্সেলোনা আমাদের শত্রু। কিন্তু ইনিয়েস্তা স্পেনের। তাই ইনিয়েস্তাকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য মাদ্রিদ থেকে ম্যাচটা দেখতে এসেছি।’’ ইনিয়েস্তা মাঠ ছাড়ার সময় সেই রিয়াল সমর্থকও চোখের জল সামলাতে পারলেন না! আমরাও নিজেদের সামলাতে পারিনি।
মেসি, জেরার পিকে-রা যে ভাবে মাঝমাঠের জাদুকরকে বিদায় জানালেন, সেটাও অসাধারণ। ম্যাচ শেষ হওয়ার পরে পুরো দলটাই টানেলে ঢুকে পড়ল। আমরা হোটেলে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছি। কিন্তু দেখলাম, গ্যালারি ছেড়ে কেউ নড়ছে না। কী ব্যাপার? হঠাৎ দেখলাম, টানেল দিয়ে একে একে বেরিয়ে আসছেন মেসিরা। সবার গায়ে ইনিয়েস্তার লেখা আট নম্বর জার্সি! এর পরেই ইনিয়েস্তাকে আট বার শূন্যে ছুড়লেন ওঁরা। অভাবনীয় দৃশ্য। ফুটবলপ্রেমী হিসেবে আমার জীবন সার্থক।
ধন্যবাদ ইনিয়েস্তা।