কপিলদের কমিটির আস্থার মর্যাদা দিতে চান গুরু শাস্ত্রী

‘ক্রীড়া বিশ্বের সেরা হয়ে ওঠার দক্ষতা রয়েছে এই দলটার’

হেড কোচ ধরলে এটা দ্বিতীয় ইনিংস। তার আগে ডিরেক্টরের পদ ধরলে তৃতীয়। ২০১৪-তে ডিরেক্টর হিসেবে যখন এসেছিলেন, মহেন্দ্র সিংহ ধোনি অধিনায়ক। কোচ ডানকান ফ্লেচার। অস্ট্রেলিয়া আর ইংল্যান্ডে টেস্টে হোয়াইটওয়াশ হয়ে ভারতীয় দল ধুঁকছে। সাত নম্বর থেকে চড়াই-উতরাই পেরিয়ে সেই দল টেস্টে এখন বিশ্বের এক নম্বর। ওয়ান ডে-তে সব সময় থাকছে এক থেকে তিনের মধ্যে। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটেও তাই। টম মুডি, মাইক হেসনদের হারিয়ে ফের হেড কোচ তিনি। আগামী ছাব্বিশ মাসের জন্য। তিরাশি বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক কপিল দেব ছিলেন অন্যতম বিচারক। অ্যান্টিগা থেকে ভোরবেলায় কপিলদের সামনে টেলি যোগাযোগে ইন্টারভিউ দিতে বসেন তিনি। তার পর ছুটলেন টিমের প্র্যাক্টিসে। সেখান থেকে হোটেলে ফিরে রবি শাস্ত্রী একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন আনন্দবাজারকে। নতুন ইনিংস নিয়ে আরও উত্তেজিত, আরও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ শোনাল তাঁকে।    টম মুডি, মাইক হেসনদের হারিয়ে ফের হেড কোচ রবি শাস্ত্রী। আগামী ছাব্বিশ মাসের জন্য। একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন আনন্দবাজারকে। নতুন ইনিংস নিয়ে আরও উত্তেজিত, আরও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ শোনাল তাঁকে।   

Advertisement

সুমিত ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ অগস্ট ২০১৯ ০৪:০৩
Share:

দূরদর্শী: অভিজ্ঞতা ও সাফল্যের নিরিখে ফের হেড কোচের দায়িত্বে ফিরলেন রবি শাস্ত্রী। ফাইল চিত্র

প্রশ্ন: হেড কোচ হিসেবে আরও একটা ইনিংস। শোনার পরে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?

Advertisement

রবি শাস্ত্রী: প্রথমেই আমি ধন্যবাদ দিতে চাই আর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চাই সিএসি-র (ক্রিকেট অ্যাডভাইসরি কমিটি) প্রতি। ওঁরা যে আমার প্রতি আস্থা দেখিয়েছেন, তাতে সম্মানিত বোধ করছি। ওঁদের এই আস্থা আমাকে আরও উত্তেজিত এবং উদ্বুদ্ধ করে তুলছে। আরও সাফল্যের জন্য পরিশ্রম করতে চাই। এবং, বিশ্বাস করি, সেটা করে দেখানো সম্ভব। ভারতীয় ক্রিকেট এই মুহূর্তে দারুণ উত্তেজক একটা জায়গায় রয়েছে। সেটাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে আমাদের। সিএসি আমাকে যে যোগ্য ভেবেছে, তার পূর্ণ মর্যাদা দিতে চাই।

প্র: এর আগে ডিরেক্টর ছিলেন। হেড কোচ হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদ। পুরোটা ধরলে তৃতীয় ইনিংস। এ বার কোনও টার্গেট সেট করছেন কি?

Advertisement

শাস্ত্রী: টার্গেট হল, ভারতীয় ক্রিকেটকে আরও উঁচুতে নিয়ে যাওয়া। আমি আগেই বলেছি, আবারও বলছি, এই ভারতীয় দল অন্য পর্যায়ের ক্রিকেট খেলছে। মাঠে ওরা দুঃসাহসিক ক্রিকেট খেলছে। গত দু’বছরে টিমটা বিদেশে কী ধরনের ক্রিকেট খেলেছে, দেখুন। সেরা দলগুলোর ডেরায় গিয়ে তাদের মনে ভয় ধরিয়ে দিচ্ছে। ওয়ান্ডারার্সে দক্ষিণ আফ্রিকা যখন ভয়ঙ্কর পিচ বানাল, ওরা ভেবেছিল, আমাদের ভয় দেখাবে। উল্টে ওরাই ভয় পেয়ে গিয়েছিল। আমার মনে হয়, এই ডাকাবুকো মনোভাব এসে যাওয়াটাই দলটার আসল প্রাপ্তি। কোথাও গিয়ে খেলতে ছেলেরা ভয় পায় না। উল্টে প্রতিপক্ষের বুকে কাঁপুনি এনে দিচ্ছে। এই দলগত মানকে আরও উঁচুতে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। এ বারে আমাদের টার্গেট হবে সেটাই।

প্র: বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে হার এবং স্বপ্নভঙ্গ নিয়ে কথা উঠেছে। এটা নিয়ে কি কপিলরা জানতে চাইলেন?

শাস্ত্রী: সিএসি সদস্যরা কী প্রশ্ন করলেন, সেটা নিয়ে কোনও মন্তব্য করব না। সেটা একান্তই রুদ্ধদ্বার একটা বৈঠক। আমি ব্যক্তিগত ভাবে ছিলাম না, ওয়েস্ট ইন্ডিজে টিমের সঙ্গে আছি বলে টেলি যোগাযোগে অংশ নিই। ইন্টারভিউতে কী বলেছি, সেটা প্রকাশ করতে চাই না। তবে বিশ্বকাপের হার নিয়ে একটা কথা বলছি। সব চেয়ে দুঃখী এবং আহত হয়েছিল আমাদের টিমই। কেউ যেন ভুলে না যায়, চোখে সব চেয়ে বেশি স্বপ্ন নিয়ে ইংল্যান্ডে এসেছিল আমাদের ছেলেরাই। তার আগে টানা চোদ্দো-পনেরো মাস ধরে আমরা ধারাবাহিক ভাবে দুর্ধর্ষ ক্রিকেট খেলে গিয়েছি। দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, সব জায়গাতে গিয়ে ওয়ান ডে সিরিজ জিতেছি। ওয়ান ডে ফর্ম্যাটে আমাদের জয়ের শতকরা হার ৭১ শতাংশ। আমার মনে হয় না কখনও কোনও ভারতীয় দলের এমন সাফল্যের হার ছিল বলে। শুধু কুড়ি মিনিটের একটা পর্ব ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে আমাদের স্বপ্ন গুঁড়িয়ে দিয়ে চলে যায়। গোটা টিম শোকস্তব্ধ হয়ে বসেছিল সে দিন। সব চেয়ে যন্ত্রণাবিদ্ধ ছিল ছেলেরাই। কিন্তু তার পরেও কী ভাবে টিমটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেখুন। এত বড় একটা আঘাতের পরেও ওয়েস্ট ইন্ডিজে এসে এখন পর্যন্ত সব ক’টা ম্যাচ জিতেছে। আপাতত টি-টোয়েন্টি এবং ওয়ান ডে মিলিয়ে স্কোরলাইন ৫-০। পাঁচে পাঁচ। বিশ্বকাপে স্বপ্নভঙ্গের কথা বলছেন তো? স্বপ্নভঙ্গটা সব চেয়ে বেশি করে ছেলেদের। আমাদের ক্রিকেটারদের। তার পরেও ওরা আশ্রমিক সাধনায় নিজেদের ডুবিয়ে দিয়েছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজে এসে প্রতিপক্ষকে সম্মান দিয়ে তাদের হারিয়েছে। আর সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ওয়েস্ট ইন্ডিজ কিন্তু বেশ বিপজ্জনক টিম।

কোথায় দাঁড়িয়ে বিরাটদের গুরু


রবি শাস্ত্রী (২০১৭ থেকে চলছে)
• টেস্ট ২১
• জয় ১১
• জয়ের শতকরা হার ৫২.৩৮
ওয়ান ডে ৬০
• জয় ৪৩
• জয়ের শতকরা হার ৭১.৬৭ টি-টোয়েন্টি ৩৬
• জয় ২৫
• জয়ের শতকরা হার ৬৯.৪৪
প্রধান প্রাপ্তি: টেস্ট র‌্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বর হওয়া। অস্ট্রেলিয়ায় প্রথম বার টেস্ট সিরিজ জয়। ওয়ান ডে-তে ১০টি সিরিজে জয়, মাত্র ২টিতে হার। প্রথম বার দক্ষিণ আফ্রিকায় এক দিনের সিরিজ জয় (৫-১ ব্যবধানে), এশিয়া কাপ জয়, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজ়িল্যান্ডে ওয়ান ডে সিরিজ জয়।

অন্যরা
ডানকান ফ্লেচার (২০১১-২০১৫)
• টেস্টে জয়ের শতকরা হার ৩৭%
• ওয়ান ডে-তে জয়ের শতকরা হার ৫৬%
গ্যারি কার্স্টেন (২০০৮-২০১১)
• টেস্টে জয়ের শতকরা হার ৪৮%
• ওয়ান ডে-তে জয়ের শতকরা হার ৫৯%
জন রাইট (২০০০-২০০৫)
• টেস্টে জয়ের শতকরা হার ৪০%
• ওয়ান ডে-তে জয়ের শতকরা হার ৫২%

প্র: নতুন ইনিংস খেলতে নেমে ছেলেদের কী বলবেন?

শাস্ত্রী: বিশেষ কিছুই না। প্রক্রিয়া যেমন চলছে, চলবে। শুধু এটাই বলব যে, তোমরা এত দূর পর্যন্ত দারুণ করেছ। কিন্তু আমরা উঁচুতে উড়তে পারি। সকলে মিলে সেটাই চেষ্টা করতে হবে। কোথাও কোনও ভুল হলে এই টিম সবার আগে সেটা স্বীকার করবে। এবং, স্বীকার করে নিয়ে সেই খুঁত মেরামতের চেষ্টা করব। আমরা সব সময় অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে প্রস্তুত। কোথায় ভুল হয়েছে, সেগুলো চিহ্নিত করার প্রক্রিয়াও চলবে। একটা কথা আমি বলছি। এই দলটার ক্ষমতা আছে খেলাধুলোর ইতিহাসে সর্বকালের সেরা দলগুলির একটা হয়ে ওঠার।

প্র: মানে বিশ্বের সেরা ক্রিকেট টিমগুলোর একটা?

শাস্ত্রী: দাঁড়ান, দাঁড়ান। আমি শুধু ক্রিকেটের কথা বলছি না। সব মিলিয়ে ক্রীড়া দুনিয়ার বিচারে বলছি। সব খেলা মিলিয়ে সেরা দলগুলোর সমান হয়ে ওঠার দক্ষতা রয়েছে এই দলটার। এটাই বলতে চাইছি। বিদেশে যে ক’টা জায়গায় আমরা খেলতে গিয়েছি, সেখানকার ক্রিকেট ভক্তরা আমাকে এসে বলে গিয়েছে, এত আগ্রাসী আর তেজিয়ান ক্রিকেট আমাদের দেশে এসে কোনও দল খেলতে পারেনি। অস্ট্রেলিয়ায় প্রথম বার সিরিজ জেতার সময় সব মাঠে অস্ট্রেলীয় দর্শকেরা এসে বলে গিয়েছেন। দক্ষিণ আফ্রিকা আর ইংল্যান্ডে আমরা টেস্ট সিরিজ হেরে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেখানেও অনেকে এসে বলে যান, দারুণ লড়াই করেছে আপনাদের টিম। দুর্দান্ত ক্রিকেট উপহার দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। আমার মনে হয়, কয়েকটা জায়গা ঠিকঠাক করে নিতে পারলে এই টিম আরও বেশি করে ক্রীড়া বিশ্বের হৃদয় জিতে নিতে পারবে। তখন দেখবেন, আমার কথাই ঠিক হচ্ছে যে, খেলাধুলোর ইতিহাসে সর্বকালের সেরা দলগুলোর একটা হয়ে উঠেছে এই ভারতীয় ক্রিকেট দল। টেস্টে পঞ্চাশ শতাংশের উপর জয়ের হার। ওয়ান ডে-তে একাত্তর শতাংশ জয়ের হার। এমন সাফল্য খুব কম টিমের আছে।

প্র: যদি জানতে চাই, নতুন ইনিংসে কোন জিনিসটার দিকে আপনি বিশেষ ভাবে তাকিয়ে, কোন বিষয়টাকে বেছে নেবেন?

শাস্ত্রী: তরুণ আর তাজা যে সব রক্ত টিমে আসছে, তাদের দিকে। আমি উত্তেজিত নতুন এই সব প্রতিভাকে দেখে। ভারতীয় ক্রিকেটে আগামী দু’বছর খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা সময়। অনেক নতুন মুখ আমরা দেখতে পাব। তাদের একদম তৈরি করে ফেলতে হবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মঞ্চের জন্য। আর যে সব প্রতিভা আমি ইতিমধ্যেই চারদিকে দেখতে পাচ্ছি, সোনার সংসার অপেক্ষা করছে। আমরা একটা বিশ্বকাপ ফেলে এসেছি। সামনে আরও তিনটে আছে। পরের বছর অস্ট্রেলিয়ায় একটা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। ২০২১-এ আর একটা কুড়ি ওভারের বিশ্বকাপ ভারতে। আর একটা চালু হচ্ছে সামনের ওয়েস্ট ইন্ডিজ টেস্ট সিরিজ থেকে। টেস্টের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ। তিনটে নিয়েই আমাদের প্রকল্প চালু হয়ে গিয়েছে। আমরা এমন একটা দল, যারা টেস্ট ক্রিকেটকে সম্মান করি। আমাদের ক্যাপ্টেনকে দেখুন। বিশ্বকাপের যন্ত্রণা ভুলে ওয়েস্ট ইন্ডিজে এসে একের পর এক কী সব ইনিংস খেলছে! অবিশ্বাস্য! তিনটে ফর্ম্যাটেই আমরা সর্বোচ্চ শৃঙ্গে আরোহণ করতে চাই।

প্র: টেস্ট ক্রিকেটের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ কতটা উদ্বুদ্ধ করছে?

শাস্ত্রী: আমরা ভীষণ ভাবেই তাকিয়ে আছি এই নতুন প্রতিযোগিতার দিকে। ধৈর্য ধরতে হবে। সীমিত ওভারের ফর্ম্যাটের মতো একটা প্রতিযোগিতাতেই এর ভাগ্য নির্ধারিত হবে না। তবে গত দু’বছরে আমাদের ছেলেরা যে ভাবে টেস্ট ক্রিকেট খেলেছে, তাতে টেস্টের বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ ওদের কাছে দারুণ আকর্ষণ নিয়ে উপস্থিত হচ্ছে। আর এটাও মনে রাখা দরকার যে, আমরা টেস্টের এক নম্বর টিম। এমনি-এমনি তো আর ছেলেরা সেই সম্মানটা পায়নি। সেই মুকুটটা ধরে রাখতে কে না চাইবে!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement