সৌজন্য: যুদ্ধ শুরুর আগে পুজারা এবং ঈশান। —নিজস্ব চিত্র
এই প্রজন্ম জানে না তিরিশ বছর আগের কথা। রঞ্জি ট্রফি জেতার উন্মাদনা কী রকম হতে পারে, উপলব্ধি করার কথাও নয় তাঁদের। শেষ সুযোগ এসেছিল ২০০৭-এ। সেই স্বপ্নপূরণে ব্যাঘাত ঘটায় মুম্বই। ১৩ বছর পরে জাতীয় ক্রিকেটের সব চেয়ে বড় সম্মানের দোরগোড়ায় বাংলা। বিপক্ষ সৌরাষ্ট্র।
বাংলার সমর্থকেরা নিশ্চয়ই চাইবেন, টাইম মেশিনে চড়ে সেই দিনে ফিরে যেতে। মনে রাখতে চাইবেন সেই মুহূর্ত, যখন কাপ হাতে তুলছেন বাংলার অধিনায়ক সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। এ রকম একটি দিন ফিরিয়ে আনা কি এতটাই কঠিন? পথ এতটাই কি দুর্গম? সেই ফাইনালের ম্যান অব দ্য ম্যাচ ও বর্তমান বাংলার কোচ অরুণ লাল বলে দিলেন, ‘‘কঠিন অবশ্যই। কিন্তু অসম্ভব নয়। প্রত্যেকে পরিশ্রমী। কাপ নিয়েই ফিরব।’’
গা গরম হয়ে গেল? বুক ফুলিয়ে বলতে ইচ্ছে করল, জয় বাংলা? এ ধরনের সাহস জোগানোর কেউ ছিল না বাংলা ক্রিকেটে! মনোজ তিওয়ারি, অভিমন্যু ঈশ্বরনদের প্রতিভা ভারতের কোনও ক্রিকেটারের চেয়ে কি কম? কিন্তু অভাব ছিল এক সাহসী গুরুর। যিনি শিষ্যের হাতে ব্যাট দিয়ে বলবেন, ‘‘যা, দেখিয়ে দে তোর ক্ষমতা।’’
আরও পড়ুন: ‘অক্ষর-ক্রুণালেরা ভারতের হয়ে খেলতে পারলে শাহবাজও তৈরি’
এ রকম সাহসী বাংলা দল শেষ কবে দেখা গিয়েছিল, অনেকেই মনে করতে পারবেন না। বিপক্ষে চেতেশ্বর পুজারা আছেন জেনেও নির্দ্বিধায় উত্তর উড়ে আসছে, ‘‘শুরুতেই আউট হয়ে যাবে।’’ ৬৫ উইকেট পাওয়া জয়দেব উনাদকাটকে সমীহ করলেও পাল্টা প্রশ্ন ফিরে আসছে, ‘‘কত ওভার আর বল করবে?’’ এটাই বাংলা। শক্তিশালী প্রতিপক্ষ যাদের দমিয়ে দিতে পারে না। যারা হার মানে না হারের আগে।
তিরিশ বছর আগে সেই ম্যাচে অভিষেক হয়েছিল এক তরুণ বাঁ-হাতির। যাঁকে ক্রিকেটবিশ্ব পরে চিনেছিল সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় নামে। সোমবার সেই পথেই হাঁটছে বাংলা শিবির। রঞ্জির ফাইনালে সৌরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অভিষেক হতে চলেছে নৈহাটির সুদীপ ঘরামির। ২২ বছরের ওপেনার সুযোগ পাচ্ছেন অভিষেক রামনের পরিবর্তে। বাবা রাজমিস্ত্রি। ছোটবেলা থেকে অনেক কষ্টে ক্রিকেট শিখেছেন। অনূর্ধ্ব-২৩ ওয়ান ডে-তে বাংলার সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। জাতীয় স্তরে দ্বিতীয়। দ্রুত রান করার ক্ষমতা আছে তাঁর। সৌরাষ্ট্রের ব্যাটিং সহায়ক পিচে সুদীপের ব্যাট থেকে নতুন রূপকথার আশায় বাংলা শিবির। কিন্তু বিপক্ষে যে উনাদকাট, চেতন সাকারিয়া, চিরাগ জানিরা অপেক্ষায়। চেতেশ্বর পুজারা তো বলেই দিলেন, ‘‘বাংলার দুর্বলতা কোথায়, তা নিয়ে আমাদের মধ্যেও আলোচনা হয়েছে। দেখা যাক কী হয়!’’ ৬৫ উইকেট পাওয়া উনাদকাটের রহস্য কী করে ভেদ করবেন মনোজ, অনুষ্টুপ মজুমদাররা? মনোজের উত্তর, ‘‘উনাদকাট পিচের কোণ দিয়ে বল করে। সুইং করে ভিতরে আসা বলের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হবে।’’ অনুষ্টুপের পরিকল্পনা, ‘‘অতিরিক্ত সম্মান দেওয়ার প্রয়োজন নেই।’’ ঋদ্ধি বলছিলেন, ‘‘উনাদকাট নয়। বলের মান অনুযায়ী খেলব।’’
কোচ যদিও নতুন ফর্মুলা নিয়ে হাজির। মেন্টর হিসেবে বাংলা দলে আসার পরে মনোজরা তাঁর নাম দিয়েছিলেন ‘ম্যাথস টিচার’। রবিবার সকালে অনুশীলন শুরু হওয়ার আগে টিম হাডলে বেশ কিছুক্ষণ সময় দিলেন। দূর থেকে একটি শব্দই আবিষ্কার করা গেল। ‘কভার ড্রাইভ’। কী বলছিলেন কভার ড্রাইভ নিয়ে? অরুণের উত্তর, ‘‘উপরের সারির ব্যাটসম্যানেরা কভার ড্রাইভ করতে গিয়েই উইকেট দিয়ে আসছে। সচিনের উদাহরণ দিয়ে বললাম, শুরুর দিকে কভার ড্রাইভ মারা বন্ধ করো। উনাদকাট ক্লান্ত হয়ে মিডল-লেগে বল করবেই। তখন রান করো।’’ যোগ করেন, ‘‘সিডনিতে সচিনের ডাবল সেঞ্চুরির কথা মনে আছে! একটিও কভার ড্রাইভ মারতে দেখেছিলেন?’’
বোলারদের জন্য না হয় পরিকল্পনা তৈরি। কিন্তু পুজারা? তাঁকে কী ভাবে আটকাবে বাংলা? রাহুল দ্রাবিড়ের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে তাঁকে চেনে ক্রিকেটবিশ্ব। ভারতীয় দলে তাঁর নাম ‘হোয়াইট ওয়াকার’। সহজে যাঁকে পরাস্ত করা যায় না। নিউজ়িল্যান্ডে ট্রেন্ট বোল্ট, কাইল জেমিসনরা ফাঁদ খুঁজে পেয়েছিলেন। ইনসুইংয়ে দুর্বল ভারতীয় তারকা। কিন্তু শনিবার পুজারা বলে দিয়েছিলেন, ‘‘এই পর্যায়ে ইনসুইং নিয়ে ভাবছি না।’’ যা শুনে মুকেশ কুমার বলে দিলেন, ‘‘হয়তো আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য এই কথা বলেছে। পুজারা আউট হবে। ইনসুইংয়েই ওকে আউট করব।’’
সেমিফাইনালের মতো তিন পেসার, দুই স্পিনার ছকেই নামছে বাংলা। অরুণের যুক্তি, ‘‘পাঁচ দিনের ম্যাচে চার বোলার নিয়ে নামা মানে বাড়তি ঝুঁকি। তা ছাড়া, বোলিং বিভাগ নিয়ে পরীক্ষা চাই না। একটি পরিবর্তন নিশ্চিত। শ্রীবৎসের পরিবর্তে ঋদ্ধি।’’
সূত্রের খবর, বুধবারই রাজকোট আসছেন বোর্ড প্রেসিডেন্ট সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। ম্যাচ শেষে বিজয়ী দলের অধিনায়কের হাতে তিনিই তুলে দেবেন ট্রফি। সৌরভের হাত থেকে ট্রফি তুলছেন অভিমন্যু। এই ছবি হয়তো টাঙানো থাকবে প্রত্যেক বাঙালির ড্রয়িং রুমে।
তা হলে সিট বেল্ট বেঁধে নিন। টেক অফ করার সময় হয়ে গিয়েছে। আসন ছেড়ে কেউ উঠবেন না। রঞ্জি ট্রফির ফাইনাল শুরু হচ্ছে যে!