.
লোকেশ রাহুলকে প্রথম দেখি বছর তিনেক আগে। আমি তখন ঘরোয়া ক্রিকেটে কমেন্ট্রি করছি। কর্নাটকের হয়ে সে দিন কার বিরুদ্ধে সেঞ্চুরি করেছিল, আজ আর মনে নেই। কিন্তু ওর সঙ্গে সে দিন ম্যাচের পর সাক্ষাৎকারটা আজও মনে আছে।
ছেলেটার সঙ্গে সে দিন কথাবার্তা বলে মনে হয়েছিল, ভীষণ শান্তশিষ্ট। যে কপিবুক ক্রিকেট খেলে রান করা ছাড়া আর কিছু বোঝে না। মাঠে ঝুঁকিহীন থাকে। লুজ বল পেলে শট নেয়। বল ছাড়তে জানে। সেঞ্চুরি করতে দু’শো-আড়াইশো বল নেয়। আবার কথাবার্তাও বলে খুব আস্তে। কেএল একবার বলেও ফেলেছিল যে, ও নাকি এ রকমই। লাজুক, মুখচোরা স্বভাবের।
ওহ, এখানেই একটা কথা বলে রাখি। ওর পদবীটা যতই আকর্ষক হোক, আমরা, কমেন্টেটররা কেউ ওকে ওই নামে ডাকি না। ঘরোয়া ক্রিকেটে কেএল বলেই ডাকাডাকি করা হয় ওকে। এর মানে ভাববেন না যে, ওকে ছোট করতে চাইছি। বরং আমি বলব, ঘরোয়া ক্রিকেটমহলে বহু দিন আগে থেকেই ওর টেম্পারামেন্ট, টেকনিক নিয়ে আলোচনা চলত। আমি, এলএস (লক্ষ্মণ শিবরামকৃষ্ণন), বিবেকরা (রাজদান) তখন বলাবলি করতাম, পূজারার পর এ রকম ক্রিজে পড়ে থাকার মতো টেস্ট প্লেয়ার আরও একজন এল। ছেলেটা টেস্ট ক্রিকেটের জন্য একদম টেলরমেড।
আজ মনে হয়, আমরা একটা ব্যাপার কেউ তখন ধরতে পারিনি। পরে কেএল-কে দেখে বারবার আমার মনে হয়েছে যে, এ হল আদতে একটা বিস্ময়ের প্যাকেজ, যে কিছু মাস পরপর আপনাকে হতবাক করে দিয়ে চলে যাবে। নিজেরই নেওয়া ওর একটা সাক্ষাৎকার দিয়ে লেখাটা শুরু করেছিলাম। আবারও একটা সাক্ষাৎকার দিয়েই তাই এই পরিবর্তনের কেএল-কে বোঝাচ্ছি। ওই সেঞ্চুরির ঠিক পরের বছর। বড়জোর ছ’মাসের তফাত। কোটলার উইকেটে দলীপ ট্রফিতে দক্ষিণাঞ্চল খেলছে। ম্যাচে কেএল ডাবল সেঞ্চুরি করল! বারোটা ছয় মারল! অথচ তার আগের বছরে গোটা রঞ্জি মরসুমে মাত্র ছ’টা ছয় মেরেছে। এখানে এক ম্যাচে বারোটা! আবারও ম্যাচ শেষে ওকে ইন্টারভিউ করতে গিয়েছি। দেখলাম, ছেলেটার ক্রিকেট যেমন বদলে গিয়েছে, কথাবার্তাও পাল্টেছে। আগে আমি দু’লাইনের প্রশ্ন করলে এক লাইনের উত্তর আসত। সে দিন দেখলাম, উত্তর দুই তো বটেই, তিন-চার লাইনও ছাড়িয়ে যাচ্ছে! বুঝতে পেরেছিলাম যে, ছেলেটা নিজেকে বদলাচ্ছে। ভিতরে। বাইরে।
বিশ্বাস করুন, যে দিন অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম টেস্টে ডাক পায়, অসম্ভব ভাল লেগেছিল। আসলে প্রথম থেকে কাউকে দেখলে একটা মমত্ব তৈরি হয়ে যায়। তা ছাড়া ও খুব ভদ্রও। পড়াশোনা জানে। দক্ষিণী ক্রিকেটাররা যে ঘরানায় বড় হয় সাধারণত, একদম সেই ধাঁচের। ভাল স্কুল-কলেজে পড়েছে। ক্রিকেটটা নিয়ে ভাবে। ভাবে, কী ভাবে নিজেকে টিমে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলবে।
কেএলের পরের বদলটা দেখেছিলাম শ্রীলঙ্কায়। অস্ট্রেলিয়া সফরের পর একটা বড় গ্যাপের পর শ্রীলঙ্কা সফরে ডাক পেয়েছে। টেস্ট সিরিজে আমার ভূমিকাও এক। কমেন্টেটর। দ্বিতীয় টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে ঋদ্ধিমানের লেগেছে। ওকে বলা হল, কিপ করতে। দেখলাম, দারুণ কিপ করে বেরিয়ে গেল! খেলা শেষে সে দিন ওকে বলেছিলাম যে, এটাই করে যাও। টিমের ব্যাটিং লাইন আপ তো দেখছ। এখানে ঢুকতে গেলে বাড়তি কোনও একটা ক্ষমতা থাকা ভাল। দুম করে কিপিংটা ছেড়ে দিও না।
ভাবিনি, আইপিএল নাইনে আরসিবি-র হয়ে গোটা টুর্নামেন্টটাই ও কিপ করে চলে যাবে!
বললাম না, কেএল বরাবর আমার কাছে বিস্ময়ের একটা প্যাকেজ। বেসিকস্ ঠিক রেখে যে নিজের খেলাকে ক্রমাগত পাল্টে গিয়েছে। আইপিএল নাইনে কেএলের ও রকম ধুমধাড়াক্কা ব্যাটিং দেখার পর একবার সন্দেহ হয়েছিল যে, এরপর টেস্ট ক্রিকেটের ব্যাটিংয়ের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে কি না। সাবাইনা পার্কে তার উত্তর কী ভাবেই না দিল! আসলে কোথাও গিয়ে আমার মনে হয়, বিরাট কোহালির সঙ্গে থাকাটা ওর খুব লাভ হয়েছে। এই যে, টেস্ট টিমে, আইপিএলে কোহালিকে যে কাছ থেকে ও পায়, তার একটা প্রভাব তো আছে। বিরাটকে পাঁচ বছর আগে আমরা জানতাম, ভাল ক্রিকেটার। এখন বলতে হয়, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ক্রিকেটার। কারণ, প্রতিভার সঙ্গে প্রবল খাটুনি মিশিয়ে নিজেকে এই জায়গায় নিয়ে এসেছে বিরাট। যা ওর আশেপাশে থাকা লোকজনকেও সমান চার্জর্ড করে দেয়। কেএলেরও মনে হয়, তাই হয়েছে। যখন ও দেখছে, স্রেফ খাটনিতে নিজেকে এই জায়গায় নিয়ে এসেছে বিরাট, ওর তো আপনাআপনিই মনে হবে যে তা হলে আমিও পারব না কেন?
পারছেও। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিয়ে কেএলের মাঠের বদলটা বোঝাই। শনিবার যখন ও আর পূজারা একসঙ্গে ব্যাট করছিল, পূজারাকে দেখে মনে হচ্ছিল যে, ডিফেন্স করতে পারলেই খুশি। কিন্তু কেএলের ছটফটানি বলছিল, ডিফেন্স করছে ভাল কথা। কিন্তু ডিফেন্স করে যদি একটা সিঙ্গলস ম্যানেজ করে নেওয়া যায়, তা হলে আরও ভাল! তিন বছর আগের কেএল কিন্তু ওই ডিফেন্স করেই খুশি থাকত। সিঙ্গলস নেওয়ার কথা ভাবত না।
আমি নিশ্চিত যে, ভবিষ্যতে আবারও কোনও না কোনও চমক নিয়ে হাজির হবে কেএল। ব্যক্তিগত ভাবে আমি একটা পরিবর্তন ওর থেকে পেতে চাই। তা হল ব্যাটিং গড়। সাবাইনা পার্কে সেঞ্চুরির পর সাইঁত্রিশে গিয়েছে। কিন্তু একটা সময় আট টেস্টে পঁচিশ ছিল। এমন নয় যে, তাতে কোনও সেঞ্চুরি ছিল না। দু-দু’টো সেঞ্চুরি ছিল। কিন্তু ওর সমস্যা হল, সেট হয়ে গেলে বড় রান করে। এমনি সময় ষোলো পেরোবে না। সেঞ্চুরি বাদ দিলে ওটাই কিন্তু টেস্টে ওর সর্বোচ্চ— ১৬। এটা কেন হবে? এখন মারাত্মক চোখে পড়ছে না। কিন্তু এ রকম চলতে থাকলে পরে মুশকিল হবে। আর চলবেও বা কেন? যে কেএল রাহুল বিদেশে তিনটে সেঞ্চুরি করেছে, যে কেএল রাহুল টেস্ট এবং টি-টোয়েন্টি দু’টোই খেলতে পারে অনায়াসে, তার নামের সঙ্গে এমন বদনামের ট্যাগলাইন থাকবে কেন?