১৪ গ্র্যান্ড স্ল্যাম চ্যাম্পিয়ন আর তাঁর কোচের অস্বস্তির মুহূর্ত
দ্রুত অতিক্রম করতে হবে আট ফুট। ডিএলটিএ টেনিস কমপ্লেক্সে ড্রেসিংরুমের সাইডের দরজা থেকে এক নম্বর কোর্টে যাওয়ার রাস্তা। ওইটুকু পার করাবার জন্য তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়ে গেল আট জন বাউন্সার। সেই প্রতিরক্ষাব্যুহকেও আক্রমণ করার কী মুহুর্মুহু চেষ্টা! রাশি রাশি সেলফি তোলার উদ্যোগ, গুঁতোগুঁতি। কাছে যাওয়ার চেষ্টা।
এটা যদি সকাল এগারোটার ছবি হয়, রাত ন’টার স্টেডিয়ামও এক। ইন্ডোর যে স্টেডিয়াম এতক্ষণ মনে হচ্ছিল ফাঁকা ফাঁকা, তারাই চিৎকারে উদ্বেল হয়ে গেল— রাফা রাফা। তরুণীরা বোর্ড ঝুলিয়ে ‘উই লাভ রাফা’।
রাত্তিরে লিখতে বসে বেশ গুলিয়ে যাচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল প্রিমিয়ার টেনিস লিগকে তা হলে কী চোখে দেখা উচিত? দিল্লিবাসী দ্বিতীয় বছরে উদ্যোগকে গ্রহণ করল না বর্জন?
এমনিতে রাজধানীর বুকে যে এত বড় টেনিস টুর্নামেন্ট হচ্ছে, অতিথি আগন্তুকের বোঝার কোনও উপায় নেই। দিল্লি বিস্তৃত শহর। অনেক কিছু একই সপ্তাহে ঘটে সব বোঝা গেল। কিন্তু রাজনৈতিক নেতা বা সিনেস্টারদের জন্য বরাদ্দ বিলবোর্ডের দশ ভাগের এক ভাগও যে মহেশ ভূপতির আইপিটিএল পায়নি সে তো সাদা চোখেই দেখা যাচ্ছে।
ইন্দিরা গাঁধী স্পোর্টস কমপ্লেক্সের কাছাকাছি অন্যতম স্পনসর কোকাকোলা কিছু বিলবোর্ড লাগিয়েছে। কিন্তু আর কোথায়? মুখ্য স্পনসর মাইক্রোম্যাক্স যথেষ্ট করেছে বলে একেবারই মনে হয় না। দর্শক প্রথম দিকে এত কম যে লিয়েন্ডার বলেই ফেললেন, একে ক্রিকেটের আইপিএল হতে হলে আরও লোক টানতে হবে। অথচ শনিবার এই শহরেই তো ভারতে প্রথম টেনিসের সেই শতাব্দী সেরা দ্বন্দ্বযুদ্ধটা ঘটছে! নাদাল বনাম ফেডেক্স!
অথচ রাফায়েল নাদালের জন্য অফুরন্ত আকর্ষণ। কী সকাল কী রাত। রাত ন’টা নাগাদ তিনি কোর্টে পা দেওয়া মাত্র যেন স্টেডিয়ামে অন্তত হাজার দুই লোক বাড়তি চলে এলো। চৌম্বকীয় আকর্ষণের একই ছবি তো সকালে।
দিল্লির খুদেদের নিয়ে কোচ কাকার সঙ্গে ক্লিনিক করতে গেলেন নাদাল। শেষ ভারতে এসেছেন পাঁচ বছর আগে। তখন তাঁর গ্র্যান্ড স্ল্যাম সংখ্যা রজার ফেডেরারের প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার মতো আদৌ হয়নি। বাচ্চারা ঘিরে ধরল তাঁকে। অফুরন্ত সই আর শুভেচ্ছা বিলোলেন। গায়ে রাফায়েল নাদাল লেখা টি শার্ট। টুপিটা সামান্য সাইড করে টানা। বলিষ্ঠ পা জোড়া পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে চার ফুট দূর থেকে। জকোভিচ উত্থানের আগে অবধি যে পা জোড়াকে বলা হত ‘ক্লান্তিহীন দক্ষতার মিনার’।
খুব রিল্যাক্সড ভঙ্গিতে সাংবাদিক সম্মেলনে এলেন নাদাল। এত ছোট ঘরে এত কাছ থেকে প্রেস কনফারেন্স কোনও গ্র্যান্ড স্ল্যাম কেন, ছোটখাটো টুর্নামেন্টেও হয় না। যে কোনও প্রশ্নই করা হচ্ছে যেন গায়ের ওপর থেকে এবং মাইক্রোফোন একটা থাকলেও তার কোনও দরকার নেই।
বৃহস্পতিবার দিল্লিতে। সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন।
এই নাদাল অনেকটা ২০০৬ সালের টেনিস এলবো সারিয়ে ফেরা সচিন তেন্ডুলকরের মতো। চোট থেকে ফিরেছেন বলে নিজেকে নিয়ে সামান্য অনিশ্চিত। চেষ্টা করছেন পরিশ্রম করে যাওয়ার। কিন্তু জানেন পরিশ্রমের বাইরেও আরও নানান কিছু ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়াতে পারে আর পাঁচ সপ্তাহ বাদে যখন মেলবোর্ন পার্কের খেতাব জেতার নতুন লড়াইয়ে নামবেন।
পাশে কাকা টনি। যিনি তিন বছর বয়স থেকে তাঁর কোচ। আজও যাঁকে রাফা ছাড়েননি। কাকা ছোটবেলায় কী টিপস দিয়ে আপনাকে এত বড় করে তুললেন? কাকার টিপসের রহস্যটা কী? এবিপির এই প্রশ্নে নাদাল খুব খুশি হয়ে জবাব দিলেন। ‘‘আমার ভাগ্য কাকাকে পাশে পেয়েছিলাম এত কম বয়সে। উঠে আসার সময় প্রত্যেকটা পর্যায়ের কোচিং দরকার হয়। খুব কম বয়সে। তার পর জুনিয়র পর্যায়ে। তার পর সিনিয়র লেভেলে। জীবনে তিনটে জিনিস বড় টেনিস প্লেয়ার হওয়ার জন্য চাই। এক, বড় স্বপ্ন দেখা। আমি যেমন বিছানায় শুয়েও দেখতাম রোলাঁ গারোতে খেলছি। উইম্বলডন জিতছি। এই সব আজকালকার ছেলেরা যা দেখে না। দুই, প্রচণ্ড পরিশ্রম করে যাওয়া। নতুন নতুন অস্ত্র তার মাধ্যমে যোগ করা। যাতে বিপক্ষ তোমায় ধরে ফেলতে না পারে। তিন, ঠিকঠাক পেশাদারদের নিজের পাশে রাখা। এটা ভীষণ ইম্পর্ট্যান্ট। আমার কাকা যেমন খুঁটিনাটি জানেন মডার্ন টেনিস কোন দিকে যাচ্ছে।’’
উদ্যোক্তারা এই সময় ঘোষণা করেছেন টেনিস অ্যাকাডেমি সংক্রান্ত কোনও প্রশ্ন ছাড়া করা যাবে না। নাদাল এমন খুশির মেজাজে সেটা অগ্রাহ্য করলেন। ‘‘না না, এনিথিং ইউ আস্ক।’’ তখন কে জানত এই সিদ্ধান্ত যে, ব্যাকস্পিন করে তাঁর কোর্টেই গিয়ে পড়বে।
হঠাত্ প্রশ্ন হল, আপনি পরের গ্র্যান্ড স্ল্যাম কবে জিতবেন? বেশ ব্যাঁকা ভাবে হল যেন সচিনকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, আপনার শততম সেঞ্চুরি কবে আসবে? সচিনের তখন মনে হত এরা এমন হাবভাব করছে যে আমার আগের ৯৯ সেঞ্চুরি নেই। এটাই হবে প্রথম হান্ড্রেড। নাদালেরও হয়তো তাই মনে হল যে এরা কী বলতে চাইছে, আমার চোদ্দো গ্র্যান্ড স্ল্যাম টাইটেল কি কিছুই নয়? বিরক্তি চেপে অবশ্য হাসিমুখে বললেন, ‘‘আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। চোট সারিয়ে তো উঠে দাঁড়িয়েছি। দেখা যাক সেটা কবে আসে। আদৌ আসে কি না।
এই হতে হতে তাঁর বিখ্যাত প্রতিদ্বন্দ্বী আলোচনায় চলে এলেন। শুক্রবার রাতে যিনি দিল্লি ঢুকে শনিবার রাত্তিরে নাদালের সঙ্গে এক সেটের সিঙ্গলস খেলবেন। রজার ফেডেরার। নাদাল বললেন, ‘‘দিল্লিবাসী যে আমাদের ম্যাচটা চোখের সামনে দেখতে পাবেন সেটা নিশ্চয়ই এ দেশে টেনিসপ্রেমীদের উত্সাহিত করবে।’’
আসলে ফেড-এক্স প্রসঙ্গ উত্সাহিত করল এক মহিলা সাংবাদিককে। ইনি টেনিস সার্কিটের বোধহয় নন। হলে প্রশ্নটা আরও মার্জিত ভাবে করতেন। বললেন, ‘‘ফেডেরার পরশু তাঁর দু’বছরের কোচ স্তেফান এডবার্গের সঙ্গে গাঁটছড়া ভেঙে দিয়েছেন। অথচ আপনি এক কাকাকে নিয়ে পড়ে আছেন। অনেকে তো বলছে ওঁর কোচিং পদ্ধতি ঠিক হচ্ছে না। তা হলে ওঁকে রেখেছেন কেন?’’
প্রশ্নটা শুনে নাদালের ক্ষুব্ধ, নীরব প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হল, শিবাজি পার্কে বসে তেন্ডুলকরকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে অজিত তেন্ডুলকরকে আপনি এত গুরুত্ব দেন কেন?
কাকা কোচ খুব বিড়ম্বনায় পড়ে গেলেন। টনি নাদাল বললেন, ‘‘আমায় ও কেন রেখেছে সেটা তো সত্যিই ও-ই বলতে পারবে। হয়তো কম টাকায় আমায় পাওয়া যায় বলেই।’’ নাদাল একটা কথাও না বলে সামনে ততক্ষণে ঝুঁকে পড়েছেন। কঠিন মুখ করে চেয়ে রয়েছেন ওই সাংবাদিকের দিকে। বোঝাই যাচ্ছে কোর্টে হলে আজ অবধারিত র্যাকেট ভাঙাভাঙির ব্যাপার হতে পারত। এখানে কোনওক্রমে নিজেকে সামলাচ্ছেন।
কাকার উত্তর শেষ হতেই উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে বলা হল লাস্ট কোয়েশ্চেন। কে করবে করতে করতেই নাদাল বললেন, ‘‘আর কিছু নয়।’’ ওই কঠিন মুখ নিয়েই বেরিয়ে গেলেন দিল্লিতে তাঁর প্রথম প্রেস কনফারেন্স থেকে। ভদ্র ভাষায় ওয়াক আউট করলেন কাকার প্রতি কটাক্ষে।
ভাবাই যায় না ছাব্বিশ বছর গাঁটছড়া থাকার পড়েও বিশ্বখ্যাত ছাত্রের গুরুর প্রতি কী একনিষ্ঠ শ্রদ্ধা থাকতে পারে! টপস্পিন আর ক্লে-কোর্টে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাঁর বল ফেরানো তো টিভিতে দেখা যায়। ক্যামেরার বাইরে এই শটটা যেন আরও ভাল!
ছবি: গৌতম ভট্টাচার্য।