ঐতিহাসিক: ব্রিসবেনে রুদ্ধশ্বাস টেস্ট জয়ের পরে ‘চ্যাম্পিয়ন্স’ ভারত। পিটিআই।
মাঠে হার-জিত থাকেই। কিন্তু হাল ছেড়ে দেওয়াটা আমাদের অভিধানে নেই। কে বললেন?
না, অস্ট্রেলিয়ায় সিরিজ জিতে ইতিহাস তৈরি করা দলের হেড কোচ রবি শাস্ত্রী। এক কথায়, এর চেয়ে ভাল ভাবে অস্ট্রেলিয়া সফরের এই অদম্য ভারতকে আর কেউ ব্যাখ্যা করতে পারেনি।
গ্যাবার দুর্গে ফাটল ধরিয়ে ২-১ সিরিজ জয়ের পরে শাস্ত্রীর চোখেও জল এসে গিয়েছিল। যাঁকে শক্ত চোয়ালের মানুষ বলেই এত দিন সকলে জেনে এসেছে। ‘‘আমি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি। সচরাচর যেটা হয় না,’’ ম্যাচের পরে ভার্চুয়াল সাংবাদিক সম্মেলনে স্বীকার করেন শাস্ত্রী। যোগ করেন, ‘‘ছেলেরা য করে দেখাল, অবিশ্বাস্য! ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্বসেরা সিরিজের মধ্যে ঢুকে থাকল এই টেস্ট দ্বৈরথ। কোভিডের মধ্যে খেলতে এসে এমন লড়াই দেখানো অবিশ্বাস্য!’’
খেলোয়াড়জীবনে নিজেও হার-না-মানা, আগ্রাসী ক্রিকেটার ছিলেন শাস্ত্রী। অ্যাডিলেডে ৩৬ অলআউট হওয়ার পরেও বিশ্বাস হারাননি। যখন বহির্জগতে অনেকে ধরে নিয়েছিল, ৪-০ হতে চলেছে, তিনি ছেলেদের শুধু একটাই কথা বলেছিলেন। রাতের অন্ধকারের পরেও আলোর রেখে দেয় ভোরের আকাশে। বলে দিচ্ছেন, ‘‘এটাই কঠিনতম সফর। কোভিড আতঙ্কের মধ্যে কঠোরতম নিভৃতবাস পর্ব মানা। তার পরে একের পর এক চোট। ৩৬ অলআউট। তার পরেও এমন দুর্ধর্ষ প্রত্যাবর্তনের দুঃসাহস দেখানোটা অভাবনীয়।’’ যোগ করছেন, ‘‘কী অবস্থায় টিমটা অস্ট্রেলিয়ায় এসেছিল, এক বার ভেবে দেখুন। চার-পাঁচ মাস ধরে ছেলেরা নিজেদের বাড়িতে লকডাউনে থেকেছে। তার পরে আইপিএল খেলতে গেল। সেখানে জৈব সুরক্ষা বলয়ের মধ্যে থেকে খেলেছে। সেখান থেকে অস্ট্রেলিয়ায় এসে অস্ট্রেলিয়াকে খেলার চ্যালেঞ্জ।’’ আবেগ ভিিড় করে শাস্ত্রীর গলায়, ‘‘এবং, প্রতি পদে প্রতিকূলতার সামনে পড়া। নিভৃতবাস মানো, একাকী ঘরে থাকো, ৩৬ অলআউট, একের পর এক চোট-আঘাত। অবিশ্বাস্য! অবিশ্বাস্য! আমি কী দেখলাম, এখনও ভাবতে পারছি না! যে অদম্য চরিত্র ছেলেরা তুলে ধরেছে, তার কোনও তুলনা হয় না।’’ জয়ের মুহূর্তে তিনি কী করছিলেন? শাস্ত্রী বলেন, ‘‘ঋষভ চার মেরে জয়ের জন্য দৌড় শুরু করতেই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম। চোখে জল এসে গিয়েছিল।’’
এই সাফল্যের দিনে তাঁর ভুমিকার কথাও উঠল। শাস্ত্রীর মন্তব্য, ‘‘কোচের কাজ ছেলেদের মানসিক ভাবে প্রস্তুত করা। ব্যাপারটা বেশি জটিল করতে নেই।আমারও সেটাই লক্ষ্য থাকে।’’ এমন একটা ঐতিহাসিক জয়ের দিনে ছেলেদের এগিয়ে দিয়ে নিজে পর্দার আড়ালেই থাকতে চাইলেন। বললেন, ‘‘কোচের আর কাজ কী? সে তো ড্রেসিংরুমে বসে থাকে। আসল কাজটা মাঠে নেমে করে ক্রিকেটারেরা। মাঠে খেলে দুরন্ত পারফরম্যান্স করেই তো যাবতীয় জবাব দেয় ওরা।’’
কিন্তু ভারতীয় দল সম্পর্কে অবহিত যে কেউ জানেন, গত চার-পাঁচ বছর ধরে ডাকাবুকো ভারতীয় দল তৈরি করার নেপথ্যে শাস্ত্রীর ভূমিকা কী। নতুন নতুন ছেলেদের তুলে আনা এবং তাঁদের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের আসরে নামিয়ে দেওয়ার সাহস দেখিয়ে গিয়েছেন ভারতের হেড কোচ। এই অস্ট্রেলিয়াতেই গত সফরে মায়াঙ্ক আগরওয়াল এবং হনুমা বিহারীকে দিয়ে ওপেন করিয়েছিলেন। এ বারে শুভমন গিলকে খেলানো। পিতৃবিয়োগের পরে মহম্মদ সিরাজকে সাহস দেওয়া যে, বাবা ঠিক দেখবেন, তাঁর আত্মা শান্তি পাবে তুমি ক্রিকেট মাঠে ভাল কিছু করতে পারলে। শার্দূল ঠাকুরকে অস্ট্রেলীয় দর্শকদের কথা বলে তাতিয়ে দেওয়া। অশ্বিনের চোট লাগা মাত্র ওয়াশিংটন সুন্দরকে তৈরি করতে শুরু করে দেন হেড কোচ। তা নিয়ে জানতে চাওয়া হলে শাস্ত্রী বলেন, ‘‘আমাদের কাছে আর কোনও বিকল্প ছিল না।’’ এই ওয়াশিংটনকে টি-টোয়েন্টি খেলিয়ে তৈরি করেছেন শাস্ত্রী এবং বোলিং কোচ বি অরুণ।
এ বারের জয়কে কেন গত বারের সিরিজ জয়ের চেয়েও উপরে রাখছেন, তা জানতে চাইলে শাস্ত্রীর জবাব, ‘‘২০১৮-১৯ সালে ভারতের যে দলটা অস্ট্রেলিয়াকে ২-১ সিরিজে হারিয়েছিল, সেই দলের কোনও বোলার কিন্তু শেষ টেস্টে খেলেনি। আত্মবিশ্বাসটা দলের মধ্যে ধরে রাখতে পারাটা একটা বড় কাজ।’’
তবে বিরাট কোহালির অবদানের কথাও মনে রাখতে বলেছেন তিনি। তাঁর মন্তব্য, ‘‘গত পাঁচ-ছয় বছর ধরে এই দলটা তৈরি হয়েছে। এই দলটা তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে বিরাট কোহালিরও একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। ওর মানসিক দৃঢ়তার প্রতিফলন দেখা গিয়েছে ছেলেদের মধ্যে।’’ পাশাপাশি রাহানেকে নিয়ে তিনি বলেন, ‘‘অজিঙ্ক খুব শান্ত মাথার ছেলে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে ও জয়ের জন্য সমান আগ্রাসী। সেঞ্চুরি করে মেলবোর্নে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিল।’’ যোগ করেন, ‘‘মাত্র তিন টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতা থাকা বোলিং আক্রমণ নিয়ে টেস্ট খেলতে নামা সহজ নয়। যে ভাবে অজিঙ্ক সব দায়িত্ব সামলেছে, অসাধারণ!’’
দলের তরুণ ক্রিকেটারদের সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে শাস্ত্রী বলেন, ‘‘ছেলেদের বলেছিলাম, মাঠের ভিতরে যখন ঢুকবে, মাথায় রাখবে, বুকে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের ব্যাজ লাগিয়ে খেলতে নেমেছ।’’
ঋষভ পন্থ সম্পর্কেও উচ্ছ্বসিত শাস্ত্রী। বলেন, ‘‘ও মন দিয়ে সব পরামর্শ শোনে। আগ্রাসনের সঙ্গে সতর্কতা একজনকে শিখিয়ে দিলে তার খেলায় ভারসাম্য আসে। সেই ঋষভকেই দেখছেন আপনারা।’’ যোগ করেন, ‘‘ও রান তাড়া করতেই ভালবাসে। এ দিন বার বার স্কোরবোর্ড দেখছিল। ও সাহসী ইনিংস খেলতে পারে বলেই বিদেশে ওকে আমাদের দলে চাই।’’ ক্রিকেটমহল অধিনায়ক রাহানেকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত হলেও তিনি নিজে দলকেই কৃতিত্ব দিচ্ছেন। তাঁর কথায়, ‘‘আমাকে স্বস্তিতে দেখাচ্ছে, তার কারণ দলের সদস্যরা প্রত্যেকে ভাল পারফরম্যান্স করেছে। দেশের নেতৃত্ব দেওয়াটা এতটা বড় ব্যাপার। ব্যক্তিগত সাফল্য বলে এই দলে কিছু নেই।’’