মেয়েটাকে দেখে কে বলবে একটা সুপার সিরিজ জেতার মুখে দাঁড়িয়ে!
যদিও সপ্তাহখানেক আগেই চিন ওপেন জিতেছে ও। সেটাই ওর প্রথম সুপার সিরিজ ট্রফি। কিন্তু সুপার সিরিজ সুপার সিরিজই। প্রত্যেক জায়গাতেই শূন্য থেকে শুরু করতে হয়। তবু টানা দু’নম্বর সুপার সিরিজ জেতার এক ধাপ দূরে দাঁড়িয়েও বাড়তি এক ফোঁটা উচ্ছ্বাস নেই আমাদের সিন্ধুর মধ্যে!
হংকংয়ে যে স্টেডিয়ামে সিন্ধু-সমীর বর্মারা খেলছে সেটার নাম হাং হোম কলোসিয়াম। কলোসিয়াম মানে ইউরোপের ইতিহাসে গ্ল্যাডিয়েটরদের যুদ্ধক্ষেত্র হলেও আজ অবশ্য ফাইনালে উঠতে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করতে হয়নি সিন্ধুকে।
সেমিফাইনাল শুরু হতে তখনও কয়েক ঘণ্টা বাকি। দুপুরে সিন্ধুর সঙ্গে কথা হচ্ছিল হোটেলে। স্ট্র্যাটেজি, প্ল্যানিং, টেকনিক নিয়ে। চিন আর এখানে সিন্ধুর কোচ হিসেবে লক্ষ্য করলাম, বিন্দুমাত্র টেনশনে বা চাপে নেই। আর সন্ধেতে কোর্টের ধারে বসেও লক্ষ্য করলাম ও ঠিক দুপুরের হোটেলের মেজাজেই আছে। সারাক্ষণ ঠান্ডা মাথায় গেমপ্ল্যানগুলো কাজে লাগিয়ে গেল চেউং নান ই-র বিরুদ্ধে। যেন কোনও তাড়াহুড়ো নেই। অযথা শটের প্রবণতা নেই। অপ্রয়োজনীয় আগ্রাসন নেই। কখনও অ্যাটাকিং, কখনও ডিফেন্স। যখন যেটা দরকার, সেটাই অ্যাপ্লাই করে স্ট্রেট গেমে (২১-১৪, ২১-১৬) ম্যাচটা জিতে নিল। রবিবার ফাইনালে সিন্ধুর সামনে তাইপের জু ইং-র চ্যালেঞ্জ। যে মেয়েটা কিনা চিন ওপেনের পর আজ হংকংয়েও বিশ্বের এক নম্বর, অলিম্পিক্স চ্যাম্পিয়ন ক্যারোলিনা মারিনকে হারিয়ে দিল!
এখানে স্টেডিয়ামের কাছেই একটা হোটেলে আমরা সবাই উঠেছি। নাম হারবার প্লাজা মেট্রোপলিস। হোটেলের কাছাকাছি একটা ভারতীয় রেস্তোরাঁয় সবাই মিলে খেতে যাই। সিন্ধু কিন্তু ওর প্রিয় ইওগার্ট ছাড়েনি। রিওর জন্য তৈরি হওয়ার সময় গোপীচন্দ এটা খাওয়া বন্ধই করে দিয়েছিল। ফিটনেস চরমে রাখার জন্য। মোবাইলটাও নিয়ে নিয়েছিল গোপী, যাতে সিন্ধুর ফোকাসটা একবিন্দুও নড়ে না যায়। এখন মেনুতে ইওগার্ট, হাতে মোবাইল ফিরেছে। বাবা রামানাও এখন মেয়ের সঙ্গে হংকংয়ে। তা বলে সিন্ধুর প্র্যাকটিস শিডিউলে ছিটেফোঁটা নড়চড় হয়নি। গোপীচন্দ হংকংয়ে টিমের সঙ্গে নেই। কিন্তু সিন্ধু ওর ভীষণ প্রিয় আইসক্রিমটা মেনুর বাইরেই রেখে দিয়েছে এখানে। এই সিন্ধু এখন অনেক পরিণত।
শনিবারের সেমিফাইনালের আগে যে হংকংয়ের এই মেয়েটাকে সিন্ধু হারায়নি তা নয়। দু’বার হারিয়েছে। তবে আজকের লড়াইটা ছিল অন্য রকম। একে ঘরের কোর্টে হংকংয়ের মেয়েটা ফর্মে। তার উপর আগের দিনই সাইনাকে হারিয়েছে। আত্মবিশ্বাসে ফুটছিল। সিন্ধুর চ্যালেঞ্জটা তাই সোজা ছিল না। ম্যাচটা ওর অনায়াসে জেতা দেখে কিন্তু তা মনে হল না।
আসলে অলিম্পিক্সের পর সিন্ধুর আত্মবিশ্বাস প্রচুর বেড়েছে। অনেকে বলতে পারেন, রিওর পরের তো দুটো টুর্নামেন্টে সিন্ধু সে ভাবে পারফর্ম করতে পারেনি। তার কারণটাও বলছি। অলিম্পিক্সের পর ও সে ভাবে প্র্যাকটিস করতে পারেনি। হয়তো সংবর্ধনা, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ব্যস্ততায়। তাই ফোকাসটা ফেরাতে একটু সময় লেগে গিয়েছে ওর। কিন্তু এক বার সেটা ফিরতেই সিন্ধু আবার সুপার সিন্ধু।
উন্নতিটা শুধু টেকনিক বা আত্মবিশ্বাসেই নয়। মানসিকতার দিক থেকেও। মানে বিপক্ষকে মেপে নিয়ে সেই অনুযায়ী কোর্টে নিজের সঠিক পারফরম্যান্সটা দেওয়া। ম্যাচ হারজিতের ক্ষেত্রে এটা পাঁচ শতাংশ হয়তো কাজে লাগে। কিন্তু দিনের শেষে ওই পাঁচ শতাংশটাই ফারাক তৈরি করে দেয়। ফিটনেসের ব্যাপারটাও তো আছে। টানা দু’সপ্তাহে দু’টো সুপার সিরিজ খেলার ধকল কিন্তু সিন্ধু দুর্ধর্ষ সামলাচ্ছে। এই পর্যায়ের ব্যাডমিন্টনে যেটা টপ ফিটনেস না থাকলে হয় না।
এর মধ্যে আরও একটা ভাল খবর, ছেলেদের সিঙ্গলসে আমাদের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন সমীরের ফাইনালে ওঠা। দু’বছর পর একটা সুপার সিরিজে দু’বিভাগেই ভারতের ফাইনালিস্ট!