যুগলবন্দি: রিও অলিম্পিক্সের সেই গর্বের ছবি। ছাত্রী সিন্ধুর সঙ্গে কোচ গোপীচন্দ। রুপো জেতেন সিন্ধু। ফাইল চিত্র
তাঁর অ্যাকাডেমির নামটাই পাল্টে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। অনেকে ডাকছেন ‘চ্যাম্পিয়ন মেকিং ফ্যাক্ট্রি’ বলে। রবিবার অস্ট্রেলিয়ান সুপার সিরিজ জিতে যিনি চাঞ্চল্য ফেলে দিলেন, সেই কিদম্বি শ্রীকান্তও তাঁর হাতে তৈরি। ভারতীয় খেলাধুলোয় তিনি সর্বকালের সেরা দ্রোণাচার্য— বললেও কি অত্যুক্তি করা হবে? কী ভাবে একের পর এক কৃতী ছাত্র-ছাত্রী উপহার দিচ্ছেন তিনি? মোবাইল ফোন থেকে পুল্লেলা গোপীচন্দ একান্ত সাক্ষাৎকারে নানা কৌতূহলের জবাব দিলেন আনন্দবাজার-কে।
প্রশ্ন: আরও এক ছাত্রের এই সাফল্যে আপনি কতটা আনন্দিত?
পুল্লেলা গোপীচন্দ: ভাল লাগছে। শ্রীকান্ত খুব ভাল খেলেছে। ভাল ভাল সব খেলোয়াড়কে হারাতে হয়েছে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য। তবে আমি সব চেয়ে খুশি ওর ধারাবাহিকতা দেখে। পর-পর তিনটে সুপার সিরিজে ও ফাইনাল খেলল। তার মধ্যে দু’টোতে চ্যাম্পিয়ন। বেশ কৃতিত্বের এই পারফরম্যান্স কারণ, কোনও সুপার সিরিজেই হাল্কা কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী ও পায়নি।
প্র: এটা কি ঠিক যে, শ্রীকান্ত খেলতেন ডাবলস? আপনি ওকে সিঙ্গলসে এনেছিলেন?
গোপীচন্দ: হ্যাঁ ঠিক। খুব অল্প বয়সে ওকে আমি প্রথম দেখেছিলাম। খুবই প্রতিভাসম্পন্ন ছিল। ওকে দেখে আরও একটা জিনিস মনে হয়েছিল যে, খুব বুদ্ধিমান একটা ছেলে আমার কাছে এসেছে। সেটা আমাকে বিশেষ ভাবে আকৃষ্ট করেছিল। আর অসামান্য প্রতিভা দেখে মনে হয়েছিল, এ ছেলে সিঙ্গলসে সফল হতে পারবে। দরকার ছিল স্ট্যামিনা গড়ে তোলা।
প্র: কোচ হিসেবে আপনার সাফল্যের রহস্য কি এটাই যে, এত ডিটেলে ছাত্র-ছাত্রীদের দেখেন? শ্রীকান্ত যে বুদ্ধিমান একটা ছেলে সেটাও আপনার নজর এড়ায়নি।
গোপীচন্দ: সেই অভ্যেস আমার একটু আছে। গভীর ভাবে না দেখলে বুঝব কী করে কার কতটা দক্ষতা? আর দেখুন, কোচকে শুধু খেলার দিকটা দেখলেই তো হয় না, সব মিলিয়ে চরিত্রটাও পর্যবেক্ষণ করতে হয়। না হলে কাকে কী ভাবে গাইড করব, সেটা ঠিক করা যায় না। সকলের জন্য তো এক প্রেসক্রিপশনে কাজ না-ও হতে পারে। তাই কোনও ছাত্র বা ছাত্রী আমার অ্যাকাডেমিতে এলে তাকে সবার প্রথমে খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করি।
প্র: শ্রীকান্তের খেলার দিকটা কী ভাবে বিশ্লেষণ করবেন?
গোপীচন্দ: স্পিড আছে। আর ওর শক্তি হচ্ছে, দারুণ স্ট্রোকমেকার।
প্র: শ্রীকান্তের অস্ট্রেলিয়া-জয়কে কী ভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
গোপীচন্দ: আমার মনে হয়, শ্রীকান্তের কেরিয়ারের জন্য দারুণ একটা জাম্প। এই জয় ওকে অনেক আত্মবিশ্বাসী করে তুলবে। বিশ্ব মঞ্চে সেরা খেলোয়াড়দের হারিয়ে খেতাব জেতার অনুভূতিটাই আলাদা। প্রত্যেক খেলোয়াড়ের জীবনেই এমন এক-একটা সন্ধিক্ষণ লাগে যখন তার মনে হতে থাকবে যে, এখন আমি যে কাউকে হারাতে পারি। শ্রীকান্ত এখন সেই অধ্যায়টায় ঢুকে পড়বে।
প্র: ফাইনালে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন এবং অলিম্পিক্স চ্যাম্পিয়ন চেন লং-কে হারানো। আপনি কতটা এই পারফরম্যান্স প্রত্যাশা করেছিলেন?
গোপীচন্দ: শ্রীকান্ত যে কাউকে হারাতে পারে, এই বিশ্বাস আমার ছিল। অলিম্পিক্স চ্যাম্পিয়নকে হারানোটা নিশ্চয়ই স্পেশ্যাল। চেন লং খুব ভাল খেলোয়াড়ও। খুব ধারাবাহিক। কিন্তু শ্রীকান্তের ওকে হারানোটা মোটেও অপ্রত্যাশিত কিছু নয়। শ্রীকান্তও খুব ভাল এক জন খেলোয়াড় যে নিজের দিনে যে কোনও চ্যাম্পিয়নকে হারাতে পারে।
প্র: ছাত্র-ছাত্রীদের মনে কী ভাবে এই বিশ্বাসটা আপনি ঢোকান যে, তুমি যে কাউকে হারাতে পারো?
গোপীচন্দ: আমি প্রথম চেষ্টা করি ওদের খেলাটায় উন্নতি ঘটাতে। যদি স্কিল না বাড়ানো যায়, যদি বড় মঞ্চে সাফল্য না আসে, তা হলে এই বিশ্বাস আনা কঠিন। প্র্যাকটিস যেমন পারফেকশন আনে, তেমনই সাফল্য আনে বিশ্বাস। অস্ট্রেলিয়ায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আগের দু’টো সুপার সিরিজেও ফাইনালে উঠেছে শ্রীকান্ত। সেই ধারাবাহিক ভাবে ভাল খেলে যাওয়াটাই ওর মধ্যে বিশ্বাসটা এনে দিয়েছিল যে, অলিম্পিক্স চ্যাম্পিয়নকেও আমি হারাতে পারি। আমি কোচ হিসেবে ইতিবাচক তরঙ্গ দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি যে, ইউ আর ক্লোজ। না জিতলেও জেতার কাছাকাছি এসে গিয়েছ। হয়তো আর একটা ল্যাপ যাওয়াই বাকি। একটা কাজ আমি করতে পারব তখনই যখন আমি নিজে মানসিক ভাবে বিশ্বাস করব যে, আমি এটা পারব। সেটাই ছাত্র-ছাত্রীদের বোঝানোর চেষ্টা করি।
প্র: গুরু গোপীর সাফল্যের মন্ত্র কী?
গোপীচন্দ: আমি পরিশ্রমে বিশ্বাসী। যে কারণে আমার অ্যাকাডেমিতে জায়গা পেতে গেলে পরিশ্রম-বিমুখ হলে চলবে না। আর আমার মনে হয় কোচিংয়ের মূলমন্ত্র হচ্ছে, সহজ জিনিসগুলোকে ঠিকঠাক ভাবে করে যাও। অহেতুক জটিল করে দেখার দরকার নেই। আমি সেটাই চেষ্টা করি। ডু দ্য সিম্পল থিঙ্গস কারেক্ট। আর একটা ব্যাপার হচ্ছে, কোচকে সাহসী হতে হয়। যেটা করলে ভাল বলে নিজের মনে হচ্ছে, সেটা করার সাহস থাকতে হবে। তা সে যতই অন্যরা উল্টো কথা বলুক। ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য যেটা ঠিক মনে করি, সেটা করতে আমি ভয় পাই না।
প্র: আপনি খুব কঠোরও। হেডমাস্টারের মতো অনুশাসন জারি করেছেন অ্যাকাডেমিতে। এটার কি কোনও বিশেষ কারণ আছে?
গোপীচন্দ: অনুশাসন ছাড়া চ্যাম্পিয়ন তৈরি হয় না। আমি ছাত্র-ছাত্রীদেরও বোঝাই যে, এই অনুশাসনটা কেন দরকার। দিনের শেষে ওরাই পোডিয়ামে দাঁড়াবে। সেটা ওরা বোঝে। তাই নিয়মগুলো মানতেও রাজি হয়।
প্র: সিন্ধুর থেকে আপনি মোবাইল কেড়ে নিয়েছিলেন অলিম্পিক্সের সময়। আপনার অ্যাকাডেমিতে ভোর চারটের সময় ক্লাসের রোল-কল হবে। কেউ দেরিতে আসা মানে বাদ।
গোপীচন্দ: একদম ঠিক। দেরিতে আসাটা শৃঙ্খলাভঙ্গ। সেটাকে আমি প্রশ্রয় দেব না। নিয়মকানুন, শৃঙ্খলা আমার অ্যাকাডেমিতে সব চেয়ে অগ্রাধিকার পেয়েছে এবং পাবে।
প্র: এমন কোনও দিক আছে, যেটা খেলোয়াড় হিসেবে আপনি পাননি বলে কোচ হয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের বিশেষ ভাবে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন?
গোপীচন্দ: আমার সময়ে পেশাদারিত্ব খুব একটা ছিল না। ‘হিট অ্যান্ড রান’ গোছের পদ্ধতি ছিল। কোচ হয়ে তাই বিজ্ঞানসম্মত ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেছি। এখন খেলাধুলোয় ট্রেনিং খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা দিক। ইনজুরি ম্যানেজমেন্ট আর একটা ব্যাপার। এখন সব ব্যাপারে নিখুঁত হওয়াটা জরুরি।
প্র: প্রকাশ পাডু়কোনের পর আপনি এসেছিলেন। কিন্তু তার পর ভারতীয় ব্যাডমিন্টন মানেই হয়ে পড়েছে দুই ‘এস’। সাইনা, সিন্ধু। মেয়েদের একচেটিয়া রাজ থেকে কি এ বার ভারতের ছেলেরাও বিশ্ব মঞ্চে মাথা তুলে দাঁড়াতে প্রস্তুত?
গোপীচন্দ: অবশ্যই। পুরুষদের বিভাগেও এ বার ভারতীয় ব্যাডমিন্টনে সোনার দিন আসছে। অনেক ভাল ভাল খেলোয়াড় উঠে এসেছে। শ্রীকান্ত তো আছেই, কাশ্যপ, প্রণয়, সাই প্রণীত। এরা প্রত্যেকেই বেশ ভাল এবং বিশ্বমানের টুর্নামেন্ট জেতার ক্ষমতা রাখে।
প্র: শ্রীকান্ত ফিরলে কী বলবেন?
গোপীচন্দ: মনে করিয়ে দেব যে, সামনেই বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ রয়েছে। বড় প্লেয়ার হতে গেলে ওটা জিততে হবে। অস্ট্রেলিয়াতে সুপার সিরিজ জিতে থামলে চলবে না। পরের লক্ষ্যের জন্য তৈরি হতে হবে। বলব, ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ মেডেল— ওয়াও! বুঝতে পারছ কত দামী একটা মেডেল তোমার কাছে সেটা!
প্র: মানে সারা দেশকে গর্বিত করা বিজয়ী ছাত্রকে স্বাগত জানাতেও থাকছে স্যারের সেই কঠোর অধ্যবসায় আর অনুশাসন?
গোপীচন্দ: হুঁ।