তাগিদই তো দেখলাম না

এ প্রসঙ্গে নিজের ফুটবলার জীবনের একটা ঘটনা উল্লেখ করছি। চুয়াত্তরে মোহনবাগানে সই করার পর প্রত্যেক দিন ক্লাবে গেলেই শুনতাম, উনসত্তর সালের সেপ্টেম্বর মাসের পর ইস্টবেঙ্গলকে আমরা হারাতে পারিনি।

Advertisement

সুব্রত ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৩:৪২
Share:

চতুর্থীর সন্ধ্যায় মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচটা দেখে মনটা খারাপ-ই হয়ে গেল। কারণ, খেলাটা ড্র হওয়ায় এ বারও কলকাতা লিগ এল না আমার প্রিয় মোহনবাগানে।

Advertisement

ম্যাচের পর কয়েকটা পুজো উদ্বোধনে গিয়েছিলাম। সেখানেই এক ইস্টবেঙ্গল সমর্থক এগিয়ে এসে বলল, ‘‘দাদা, কলকাতা লিগ আট বার হয়ে গেল আমাদের। আপনার মোহনবাগান কী করছে?’’

টানা আট বার কলকাতা লিগ জিতে ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা আনন্দ করবে তা স্বাভাবিক। আমার প্রশ্ন, মোহনবাগান জার্সি গায়ে অরিজিৎ বাগুই, নিখিল কদমদের রবিবার মাঠে নামার আগে কেউ কি বলেছিল—তোমার ক্লাব এই লিগটা সাত বছর জেতেনি। দুর্গাপুজোর আগে এই ট্রফিটা পেলে সমর্থকরা তোমাদের মাথায় তুলে নাচবে।

Advertisement

এ প্রসঙ্গে নিজের ফুটবলার জীবনের একটা ঘটনা উল্লেখ করছি। চুয়াত্তরে মোহনবাগানে সই করার পর প্রত্যেক দিন ক্লাবে গেলেই শুনতাম, উনসত্তর সালের সেপ্টেম্বর মাসের পর ইস্টবেঙ্গলকে আমরা হারাতে পারিনি। পঁচাত্তরের জানুয়ারিতে দিল্লিতে ডুরান্ড কাপে যখন ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে নামছি, সেই সকালে আমাদের টিম হোটেলে ফোন করেছিলেন ধীরেনদা (প্রয়াত ধীরেন দে)। মজা করে বলেছিলেন, ‘‘এই ম্যাচটা না জিতলে সবাইকে তাড়িয়ে দেব।’’ এই একটা কথাতেই তেতে গিয়েছিলাম প্রসূন, আমি, দিলীপ পালিত-রা। ইস্টবেঙ্গলকে হারিয়ে ফিরেছিলাম আমরা।

ঘটনাটা বললাম এই কারণেই যে ম্যাচ জিতলেই যখন চ্যাম্পিয়ন, তখন মোহনবাগান গোল বাঁচানোর জন্য বাড়তি সতর্ক হবে না কেন? জেতার জন্য মোহনবাগানের সেই মরিয়া মনোভাবটাই তো দেখলাম না।

প্রথমার্ধের একদম শেষ দিকে মোহনবাগান ১-০ এগিয়ে। তখন ইস্টবেঙ্গলের গ্যাব্রিয়েলের ফ্রি-কিক চুলোভা বক্সে নামিয়ে দিল। তখন ও অরক্ষিত। লালডানমাওয়াইয়া রালতে যখন বল মোহনবাগান গোলে ঠেলছে, তখনও কেউ ওকে নজরে রাখল না!

দ্বিতীয়ার্ধে যে পেনাল্টি থেকে ২-২ করল ইস্টবেঙ্গল, তখনও মোহনবাগান মিডফিল্ডার রেনিয়ার ফার্নান্দেজ বক্সের মধ্যে অকারণ ফাউলটা করল। ওই সময় ও প্লাজাকে ব্লক করে দিলেই সমস্যা মিটে যায়।

দ্বিতীয়ার্ধে ২-১ এগিয়ে থাকার সময় কামো যে ভাবে একের বিরুদ্ধে এক পরিস্থিতিতে গোলটা মিস করল, চোখে দেখা যায় না। কে বোঝাবে ওকে, বড় ম্যাচে একটা হাফ চান্সেও গোল করতে হবে। নিজে ওই সবুজ-মেরুন জার্সিটা পরে অল্পস্বল্প ঘাম-রক্ত ঝরিয়েছি বলে বুঝতে পারছিলাম, জিততেই হবে এই তাগিদটা টিমের মধ্যে কোথায় যেন অদৃশ্য। কামোদের দেখে মনে হচ্ছিল, এই ম্যাচটা যেন আর চার-পাঁচটা ম্যাচের মতোই।

ভাবছিলাম, এই প্রজন্ম তো মহম্মদ হাবিবকে দেখেনি বড় ম্যাচের আগে। সুভাষ ভৌমিককেও নয়। আমার জমানায় ফেডারেশন কাপে একটা আইটিআই ম্যাচে কোচ প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ঝামেলাই হয়ে গিয়েছিল হাবিবদা আর ভৌমিকের মধ্যে। ম্যাচটা চার গোলের ব্যবধানে জিততে হতো। কোচ টেনশন করছিলেন। ওরাই টেবল চাপড়ে বলে গিয়েছিল, ‘‘চুপ করুন তো। ছ’গোল দিয়ে ফিরবো।’’ এই শরীরী ভাষা বা নেতৃত্ব মোহনবাগানে কাউকে দিতে দেখলাম না। অথচ ক্লাবে সাত বছর কলকাতা লিগ নেই।

আর ভাগ্যের পরিহাস এটাই যে শঙ্করলালের দলে একটা মজিদ, চিমা বা ব্যারেটো নেই। বদলে যত লম্ফঝম্প কামো-ক্রোমার মতো এই তৃতীয় সারির বিদেশিদের। খালি শরীর কাজে লাগিয়ে ধাক্কাধাক্কির ফুটবল। এদের না আছে বল কন্ট্রোল। না আছে শুটিং, ড্রিবল, পাসিং বা একার ক্ষমতায় ম্যাচ জেতানোর দক্ষতা। কিন্তু নাটকে অদ্বিতীয়। মহমেডান ম্যাচের পর আনন্দবাজার-এ পড়লাম, কামো ‘ড্যাব ড্যান্স’ করছে। ক্রোমা আবার বালোতেল্লি সাজতে চায়। কথায় তো খই ফুটছে। কেবল প্রচারমাধ্যমের আলোচনায় থাকার প্রয়াস।

ম্যাচ ২-২ এই পরিস্থিতিতে দেখলাম কামো একটা বল এমন রিসিভ করল তা ওর পা থেকে বেরিয়ে গিয়ে জমা পড়ল কেভিন লোবোর পায়ে। কলকাতা ময়দানে টিকে থাকতে গেলে ওর উচিত ড্যাব ড্যান্স বন্ধ করে প্রত্যেক দিন মোহনবাগান মাঠে পাঁচশো করে বল রিসিভ অনুশীলন করা।

এর পরে আই লিগ। তখন হয়তো গোটা দলটা অনেকটাই বদলে যাবে। মোহনবাগান হয়তো ভবিষ্যতে ডার্বি জিতবে। কিন্তু শারদীয়ার আবহে আট বছর কলকাতা লিগ না আসার যন্ত্রণা আপাতত বিঁধবে সবুজ-মেরুন সমর্থকদের বুকে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement