গুরু-শিষ্য: মাঠে এবং মাঠের বাইরে পিকে-র জীবনদর্শনই আরও পরিণত করেছিল ভাইচুংকে। ফাইল চিত্র
প্রদীপ কুমার (পিকে) বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রয়াণের খবর শোনার পর থেকেই অস্থির হয়ে পড়েছেন ভাইচুং ভুটিয়া। সিকিমে থাকায় প্রাক্তন গুরুকে শেষ শ্রদ্ধাও জানাতে আসতে পারেননি প্রাক্তন ভারত অধিনায়ক।
শুক্রবার বিকেলে সিকিম থেকে টেলিফোনে ভাইচুং বললেন, ‘‘প্রদীপদার ঋণ আমি কখনও শোধ করতে পারব না। আমি এই জায়গায় পৌঁছতে পেরেছি ওঁর জন্যই। প্রদীপদার কোচিংয়েই জীবনের অন্যতম সেরা ম্যাচ খেলেছিলাম। এখনও আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল ১৯৯৭ সালে ফেডারেশন কাপ সেমিফাইনালে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে সেই ম্যাচ।’’
সেই ডায়মন্ড ম্যাচ: আর এক কিংবদন্তি প্রয়াত অমল দত্তের কোচিংয়ে মোহনবাগান তখন অশ্বমেধের ঘোড়ার গতিতে ছুটছে। অমলদার ডায়মন্ড সিস্টেম তখন সব দলের কাছে আতঙ্ক। প্রদীপদা ছিলেন ইস্টবেঙ্গলের টেকনিক্যাল ডিরেক্টর। এই ম্যাচটাকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা চরমে পৌঁছেছিল। সকলেই ধরে নিয়েছিল, ইস্টবেঙ্গলের পক্ষে ফেডারেশন কাপ সেমিফাইনালে জেতা অসম্ভব। এই পরিস্থিতিতে উত্তাপ আরও বাড়িয়ে দেন মোহনবাগান কোচ। হঠাৎই আমাকে, স্যামি ওমোলো, সোসোকে আক্রমণ করলেন অমলদা। আমার নাম দিলেন ‘চুংচুং’। ওমোলোকে ডাকলেন ‘ওমলেট’ বলে। ‘শসা’ বললেন সোসোকে। পাল্টা জবাব দিলেন প্রদীপদাও। দুই কিংবদন্তি কোচের বাগ্যুদ্ধে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি। তা সত্ত্বেও প্রদীপদাকে কখনও দেখিনি, থমথমে মুখে ঘুরতে। প্রতিকূল পরিস্থিতিও সব সময় মুখে হাসি লেগে থাকত। আমরা অবাকই হতাম ওঁকে দেখে। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতাম, এত চাপের মধ্যেও কী ভাবে এ রকম থাকতে পারেন প্রদীপদা? আসলে প্রদীপদা জানতেন, কোচ হয়ে তিনি যদি স্বাভাবিক না থাকেন, তা হলে চাপে পড়ে যাবে ফুটবলারেরা। তাই কাউকে বুঝতে দিতেন না তাঁর মনের মধ্যে কী রকম ঝড় বয়ে যাচ্ছে।
এখনও মনে আছে সে দিন যুবভারতীতে ম্যাচ শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই গ্যালারিতে মোহনবাগান সমর্থকেরা উৎসব শুরু করে দিয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের ড্রেসিংরমে সেই সময় একটা পিন পড়লেও যেন শব্দ শোনা যেত। থমথমে পরিবেশ। কেউ কথা বলছে না। ঝড়ের আগের আবহ। যে প্রদীপদা তাঁর বিখ্যাত ভোকাল টনিকে ফুটবলারদের তাতিয়ে দিতেন, তিনিও সে দিন খুব কম কথা বলেছিলেন। মাঠে নামার আগে শুধু বলেছিলেন, গত কয়েক দিন ধরে অনেক বিদ্রুপ ও কটাক্ষের তোমাদের শুনতে হয়েছে। এই ম্যাচটাই জবাব দেওয়ার শেষ সুযোগ। তোমরাই ঠিক করো কী করবে? মানুষ বিজয়ীদেরই শুধু মনে রাখে।’’ তার পরের ঘটনা তো ইতিহাস। হিরের দর্পচূর্ণ করে ৪-১ জিতেছিলাম আমরা। হ্যাটট্রিক করেছিলাম আমি। আমার ফুটবল জীবনের সেরা ডার্বি। ম্যাচ শেষ হওয়ার পরেই আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন প্রদীপদা। তখন বুঝতে পেরেছিলাম, এই নিয়ে কতটা উদ্বিগ্ন ছিলেন তিনি। এত খুশি হয়েছিলেন, আমাকে নৈশভোজে নিমন্ত্রণও করেছিলেন।
অনুপ্রেরণা পিকে: প্রদীপদার খেলা দেখার সৌভাগ্য হয়নি। তবে ওঁর উত্থানের কাহিনি যে কোনও ক্রীড়াবিদের কাছেই অনুপ্রেরণা। ইস্টার্ন রেলের হয়ে খেলে জাতীয় দলের অধিনায়ক হয়েছেন। একেবারে রূপকথা। কোচ হিসেবেও অসাধারণ ছিলেন প্রদীপদা। ফুটবলারদের কাছ থেকে কী ভাবে সেরাটা বার করে আনতে হয়, ওঁর চেয়ে কেউ ভাল জানতেন বলে মনে হয় না। প্রদীপদা শুধু কোচ নন, ছিলেন দলের নেতা। খুঁটিনাটি সব ব্যাপারে নজর থাকত। ফুটবলারদের সঙ্গে মিশতেন বন্ধুর মতো। বাবার মতো। পরিবারের এক জন সদস্যের মতো। খোলাখুলি বলতেন, অনুশীলন ও ম্যাচের সময় আমি শুধু তোমাদের কোচ। বাকি সময়টা আমি তোমাদের পরিবারের এক জন। আমাকে তোমরা মনের সব কথা নির্ভয়ে বলতে পারো। আমরাও প্রদীপদার কাছে মনখুলে কথা বলতাম। অনেক সময় তর্কও করেছি। প্রদীপদা কখনও রাগ করেননি। ভাবতেই পারছি না প্রদীপদা আর নেই।