পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের চিফ এগজিকিউটিভ ওয়াসিম খান। —ফাইল চিত্র।
ক্রিকেটেও বহিরাগত!
আর তা ওয়াঘার ওপারে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডে। পিসিবি-র চিফ এগজিকিউটিভ ওয়াসিম খানকে নিয়ে চলছে তুমুল সমালোচনা। নিয়োগের প্রায় দু’বছর কেটে গেলেও যা থামার লক্ষণ নেই এখনও।
ষাটের দশকে ওয়াসিম খানের বাবা-মা চলে এসেছিলেন ইংল্যান্ডে। বার্মিংহ্যামে থাকতেন তাঁরা। সেখানেই জন্ম ওয়াসিমের। বাবা-কাকাদের মুখে রাতের পর রাত পাকিস্তান ক্রিকেটের গল্প, তারকাদের কাহিনি শুনে বড় হওয়া। নিজের অজান্তেই কখন যেন পাকিস্তান ক্রিকেটের সমর্থকে পরিণত হয়েছিলেন ওয়াসিম। এমনকি, ইংল্যান্ডের অনূর্ধ্ব-১৯ দলে ব্যাটিং দক্ষতায় জায়গা করে নেওয়ার পরও সেই প্রেমে চিড় ধরেনি। পাক বংশোদ্ভূত তিনিই প্রথম ব্রিটিশ, যিনি সে দেশের পেশাদার ক্লাব ক্রিকেটে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন। খেলা ছাড়ার পর লেস্টারশায়ার কাউন্টি ক্রিকেট ক্লাবের চিফ এগজিকিউটিভ হন তিনি। এতেও নজির স্থাপন করেন তিনি। কারণ, কোনও বড় পেশাদার ব্রিটিশ স্পোর্টস টিমে এর আগে অশ্বেতাঙ্গ কেউ এই পদে বসেননি।
২০১৮ সালে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের মুখ্য কার্যনির্বাহী হওয়ার প্রস্তাবে তাই দ্বিতীয় বার ভাবতে হয়নি। সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যান তিনি। পেশাদার হিসেবে আকর্ষণ তো ছিলই, কোথাও একটা ব্যক্তিগত তাগিদও ছিল। দেশে ফিরে যাওয়ার নাড়ির টান অগ্রাহ্য করার প্রশ্নই ছিল না। নিজের লোকেদের সঙ্গে থাকা, সকালে উঠে প্রার্থনার সুরে দিন শুরু করা— অনেক স্বপ্ন দেখেছিলেন ওয়াসিম খান।
বাস্তবের রুক্ষ জমিতে সেই স্বপ্ন এখন খানখান!
বাবা-মায়ের জন্মস্থানে ফেরা থেকে পাকিস্তান ক্রিকেটকে নতুন দিশা দেখানো, সব চেতনা, ভাবনা, রোম্যান্সই কর্পূরের মতো উবে গিয়েছে। ৪৯ বছর বয়সি বরং ইংল্যান্ডে ফিরে মুক্তির শ্বাস নিচ্ছেন। পাকিস্তানে যে দমবন্ধ করা পরিস্থিতিতে যুঝতে হচ্ছিল দিনের পর দিন!
আরও পড়ুন: অলিম্পিকে সোনা জেতাই লক্ষ্য, এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারে বললেন পিভি সিন্ধু
দেড় বছর আগে পাকিস্তান ক্রিকেটের সদর দফতর যেখানে, সেই লাহৌরকে নিজের নতুন ঠিকানা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন ওয়াসিম। কিন্তু, তাঁর সংস্কারের পথ হয়ে ওঠে ক্রমাগত সমালোচনার শিকার। কর্মপদ্ধতিই শুধু নয়, তাঁর সবকিছুই হয়ে ওঠে সমালোচনার বিষয়। ইউরোপীয় ঘরানায় বেড়ে ওঠার জন্য যে উচ্চারণে তিনি কথা বলেন, তা নিয়েও চলতে থাকে সমালোচনা। তবে সবচেয়ে বেশি তোপের মুখে পড়তে হয়েছে ‘যথেষ্ট’ পাকিস্তানি না হওয়ার জন্য। যে কাজের দায়িত্ব এক জন পাকিস্তানির পাওয়া উচিত, তা বাইরে থেকে আমদানি করা কেউ করছেন, এটাই মেনে নিতে পারেনি পাক ক্রিকেটমহল।
অর্থাৎ, সেই বহিরাগত তত্ত্ব! যার ফলে ভুগতে হয়েছে ওয়াসিম খানকে। স্বয়ং তাঁর কথায়, “যে প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল, তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। একদম শুরু থেকেই ওরা আমাকে ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়েছিল।”
পিসিবি চেয়ারম্যান এহসান মানির সঙ্গে প্রচারমাধ্যমের মুখোমুখি ওয়াসিম খান। —ফাইল চিত্র।
এই ‘ওরা’ কারা? তাঁরা হলেন পাক বোর্ডের সদস্যরা। এবং অবশ্যই প্রাক্তন ক্রিকেটাররা। এই পদে তিনি নিযুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বোর্ডের কর্তাদের একটা অংশ প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিল। তাঁরা ওয়াক-আউট করেন। সাংবাদিক বৈঠকও করেন তাঁরা। ওয়াসিম খানকে চিহ্নিত করা হয় ‘বহিরাগত’ হিসেবে। তাঁর বেতনের অঙ্ক ফাঁস হয়ে যায় এবং তা নিয়ে চলতে থাকে তর্ক-বিতর্ক। ছড়াতে থাকে গুজব। বলা হতে থাকে যে, পাকিস্তানের বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক ও অধুনা প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সঙ্গে যোগসূত্রের কারণেই এই পদে এসেছেন তিনি।
প্রাক্তন অধিনায়ক জাভেদ মিয়াঁদাদ এই ইস্যুতে হয়ে ওঠেন সোচ্চার। ইউটিউবে এক ভিডিয়োতে তিনি তীব্র আক্রমণ করেন একদা সতীর্থ ইমরানকে। যাতে দেখা যায় চিৎকার করে প্রশ্ন করছেন মিয়াঁদাদ, “নিজের দেশে কি এই পদের জন্য যোগ্য ব্যক্তি কম পড়েছিল যে বাইরে লোক থেকে আনতে হল?” পরে অবশ্য মিয়াঁদাদ এই বক্তব্যের জন্য ক্ষমা চেয়েছিলেন। তবে ওয়াসিম খানের মোবাইলে থাকা এই ভিডিয়ো প্রতি মুহূর্তে তাঁকে মনে করিয়েছে সামনের চ্যালেঞ্জের কথা, রাস্তায় পড়ে থাকা কাঁটার কথা।
সমস্যা হল, অন্য পেশাদার খেলাধূলার সঙ্গে পাকিস্তান ক্রিকেটের চিফ এগজিকিউটিভ পদের তুলনা করলে চলে না। এখানে নিরন্তর আতসকাচের তলায় ফেলে পর্যালোচনা চলে। প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে ডজন খানেক টিভি চ্যানেল, উত্তেজিত প্রাক্তন ক্রিকেটার থেকে ধারাভাষ্যকার, এমনকি রাস্তায় কচিকাঁচাদের সঙ্গে খেলতে থাকা মধ্যবয়সি, বাদ যান না কেউই। তার উপর ওয়াসিম খান হেঁটেছেন সংস্কারের পথে। যা আরও ক্ষিপ্ত করে তুলেছে সংশ্লিষ্টদের।
পাকিস্তান ক্রিকেট নিয়ে বই লেখা সাংবাদিক ওসমান সামিউদ্দিনের কথায়, “আবেগতাড়িত হয়ে পাকিস্তানে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ওয়াসিম। ভেবেছিলেন, সব কিছু দারুণ হতে চলেছে। কিন্তু ফিরে বাস্তবতা আঘাত করল তাঁকে। ভাবতে বাধ্য হলেন যে, হয়ত এই কাজটা নেওয়া তাঁর ঠিক হয়নি!”
ভয়াবহ সব স্মৃতি ঘিরে ধরে ওয়াসিমকে। যে ভাবে তাঁর নিয়োগ আটকাতে ব্যর্থ হওয়া বোর্ড কর্তারা ওয়াকআউট করেছিলেন, তড়িঘড়ি সাংবাদিক বৈঠক ডেকে উগরে দিয়েছিলেন রাগ, তা মনে পড়লে এখনও ক্ষতবিক্ষত হতে হয়। মনে পড়ে যায়, ভীত স্ত্রী সালমার ফোনের কথা। ওয়াসিমের কথায়, “কাঁদতে কাঁদতে আমাকে ফোন করেছিল ও। বলেছিল, সব টিভি চ্যানেলেই দেখাচ্ছে যে আমার চাকরি আর থাকছে না। আমি বলেছিলাম, চিন্তা করো না, সব ঠিক হয়ে যাবে।”
যদিও কিছুই ঠিক হয়নি!
আসলে যে সংস্কারের পথে তিনি চলতে চেয়েছেন, তা আঘাত হেনেছিল দেশের ক্রিকেট-সংস্কৃতিতে। পাকিস্তান ক্রিকেটে স্বজনপোষণ একটা স্বাভাবিক শব্দ। প্রাক্তনদের আত্মীয়রা, প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা সুযোগ-সুবিধা পান। সেখানে আঘাত তাই বরদাস্ত করা হয়নি।
আরও পড়ুন: ইস্টবেঙ্গলে কোচিং করাতে আগ্রহী বিখ্যাত স্পেনীয় কোচ, পাঠালেন জীবনপঞ্জী
ওয়াসিম আক্রমের কথায়, “আপনারা সুপারিশ শব্দের অর্থ জানেন?” আক্রম আসলে বোঝাতে চেয়েছেন এই শব্দের সঙ্গে পাক ক্রিকেটের যোগাযোগের কথা। একদা বিশ্বের এক নম্বর পেসার বলেছেন, “আমাদের বরং ওয়াসিম খানের মতোই কাউকে প্রয়োজন ছিল। যিনি নিরপেক্ষ। যিনি অন্য চোখে সবকিছু দেখবেন।” আক্রম অতি অবশ্যই ব্যতিক্রম। বাকি প্রাক্তনরা অবধারিত ভাবেই মিয়াঁদাদের সুরে বিশ্বাসী। তফাত হল, সমালোচনার মাত্রায় তাঁরা সবাই একে অপরকে ছাড়িয়ে যেতে মরিয়া!
২০ কোটি মানুষের এই দেশে ক্রিকেটের চেয়ে বড় উন্মাদনা নেই। বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়কের প্রধানমন্ত্রী হওয়া, প্রধানমন্ত্রীর ক্রিকেট বোর্ডের প্যাট্রন ইন চিফ উপাধি এরই উদাহরণ। ব্রিটেনের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে উচ্চশিক্ষিত ইমরান শুধু নিজের দেশেই নয়, ক্রিকেটবিশ্বেরই ঘরে ঘরে উচ্চারিত। ২০১৮ সালের অগস্টে প্রধানমন্ত্রী হয়ে সেই তিনিই পাকিস্তানের ক্রিকেট কাঠামো ঢেলে সাজতে চেয়েছিলেন। প্রতিভা যাতে ঠিকঠাক বিকশিত হয়, যথাযথ লালন-পালন ঘটে, তার জন্য ক্লাব ক্রিকেটের পরিকাঠামো বদলে ছয় আঞ্চলিক দলকে নিয়ে আসা হয়েছিল। আর এই বদলের নেপথ্যে যতই ইমরান খান থাকুন না কেন, এর মুখ ছিলেন ওয়াসিম খান। এ হেন সংস্কারে পেশাদার ক্রিকেটারাদের সংখ্যা কমে। এ রকম গল্পও ছড়িয়ে পড়ে যে, প্রাক্তনদের অনেককেই নাকি জীবিকার জন্য ট্যাক্সি বা রিকশা চালাতে হচ্ছে। যার ফলে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে ইমরান-ওয়াসিম জুটিকে।
মির্জা ইকবাল বেগ নামে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রবল জনপ্রিয় এক ব্রডকাস্টার টুইট করেছিলেন, “ওয়াসিম খানকে ইংল্যান্ড থেকে আমদানি করে আনা হয়েছে। তিনি কখনও পাকিস্তানে থাকেননি। পাক ক্রিকেট সম্পর্কেও ধ্যান-ধারণা তাঁর নেই।”
ওয়াসিম অবশ্য আশাবাদী যে নতুন সিস্টেম সুফল আনবেই। তা ছাড়া, প্রধানমন্ত্রী যেখানে পরিবর্তনের হাওয়া তুলছেন, সেখানে গা ভাসাতে তো হবেই। অবশ্য, বিশ্ব পর্যায়ে র্যাঙ্কিংয়ে যেখানে অবস্থান, তাতে বদল আনতেই হত। টেস্টে সাতে পাকিস্তান, ওয়ানডে ক্রিকেটে এক ধাপ উঠে এখন ছয়ে। ওয়াসিমের কথায়, “পরিসংখ্যান মিথ্যে বলে না। আমাদের পরিকাঠামো যে ঠিক নেই, তা এতেই প্রমাণিত।” কিন্তু মিয়াঁদাদের মতো প্রাক্তনরা তা মানবেন কেন!
সমস্যাটা ঠিক কোথায়, সেটাই তুলে ধরেছেন সামিউদ্দিন। বলেছেন, “ওয়াসিম খান পাকিস্তানকে বোঝে, একই ভাষায় কথা বলে, কিন্তু ও তাঁদের কেউ নয়। ওঁরা দেখাবে যে ওয়াসিম ওদেররই এক জন, কিন্তু পুরোপুরি গ্রহণ করবে না।”
সপ্তাহ তিনেকের জন্য ইংল্যান্ডে ফিরে তাই স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়েছেন ওয়াসিম। বলেছেন, “ওই শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেয়ে যেন খোলা আকাশে শ্বাস নিতে পারছি।” তাঁর কাছে এখন জ্বলন্ত প্রশ্ন অনেকগুলো। কোনটা স্বদেশ, কোনটা বাড়ি, কোনটা নিজের জায়গা, আর কে বহিরাগত!