চিন্নাস্বামীতে বিরাট। ছবি: বিসিসিআই
ইডেনে সে দিন ম্যাচ শেষ হওয়ার পর দেখা হয়েছিল বিরাটের সঙ্গে। ওকে জিজ্ঞাসা করি, পরের ম্যাচে খেলতে পারবে? যে ভাবে অনায়াসে বলে দিল, ‘অবভিয়াসলি’, তার পর আর বুধবারের ম্যাচে ওর খেলা নিয়ে আমার মনে কোনও সন্দেহ ছিল না। আর বুধবার ৫০ বলে ওর ১১৩-র ইনিংসটা দেখেও অবাক হইনি। কারণ নিজেকে ক্রমশ যে অমানুষিক জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে বিরাট কোহালি, তাতে এখন থেকে প্রতি ম্যাচে ওকে এই মূর্তিতেই দেখার আশা নিয়ে বসব আমরা।
স্যর ডন ব্র্যাডম্যানকে দেখিনি। স্যর গ্যারি সোবার্সকেও না। তাঁরা ছিলেন টেস্ট ক্রিকেটের কিংবদন্তি। মাঠে তাঁদের পারফরম্যান্স যত না অসাধারণ ছিল, তার চেয়েও বেশি ছিল সমাজে তাঁদের প্রভাব। এক-একটা প্রজন্মকে তাঁরা ক্রিকেটে টেনে নিয়ে এসেছিলেন। ওই সময় স্যর ডন, স্যর গ্যারিদের ‘ইমপ্যাক্ট’ ছিল মারাত্মক। আমাদের উপর যেমন প্রভাব পড়েছিল সুনীল গাওস্কর, কপিল দেবদের। আমরা ওঁদের দেখেই ক্রিকেটের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম। সেটা ওয়ান ডে যুগ। তার পর সচিন তেন্ডুলকর, রাহুল দ্রাবিড়রা সেই ব্যাটন হাতে নিল। এখন টি-টোয়েন্টির যুগে সেই দায়িত্ব নিয়েছে এই বিরাট কোহালি।
এই টিভি, স্মার্টফোন, কম্পিউটার, প্লে স্টেশনের প্রজন্মকে ক্রিকেটে টেনে আনছে এই একটাই ছেলে, বিরাট কোহালি। এত বড় প্রতিযোগিতায় জিততে গেলে ওকে তো অমানুষিক কাণ্ডকারখানা করতেই হবে।
হ্যাঁ, সত্যিই অমানুষিক। বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল আর তর্জনির মাঝের অংশটাতে যদি কারও সাত-আটটা সেলাই পড়ে তা হলে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ব্যাটটা ঠিক মতো ধরাই যায় না, তা নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে বলতে পারি। ব্যাট ধরাটা যেমন কঠিন, তেমন শট নেওয়ার সময় ওই জায়গাটাতে যে জার্ক হয়, তার ব্যথা সহ্য করতে যে কতটা মনের জোর দরকার হয়, তা বলার ক্ষমতা আমার নেই। কারণ নিজে ওই জায়গায় কখনও পড়িনি। কিন্তু এটুকু বলতে পারি, মানসিক কাঠিন্যটা অমানুষিক পর্যায়ের না হলে ওই চোট নিয়ে এ রকম ব্যাটিং করা সম্ভব নয়।
বিরাট কী করল? ফিল্ডিং করতে গিয়ে ওই জায়গাটা ফেটে যাওয়ার পরই ও ব্যাট করতে নেমে পড়ল! অপরাজিত ৭৫ রান করে দলকে জেতালও। তখনও হাতে সেলাই পড়েনি। আর বুধবার ওখানে সেলাই থাকা অবস্থায় যে ব্যাটিংটা করল, তা স্রেফ অতিমানবীয়।
কোনও কোচিং এক জন ক্রিকেটারকে এই অবস্থায় আনতে পারে না। কোচেদের অশ্রদ্ধা করছি না, কারও মনে কোনও আঘাত করার ইচ্ছাও নেই। কিন্তু এটুকু জোর দিয়েই বলব, জিনিয়াসরা নিজেদের এই জায়গায় নিয়ে আসে নিজেরাই। দেখা যায় বেশিরভাগই নিজেদের প্রতিভার কিছু অংশ ব্যবহার করতে পারে। বিরাট কিন্তু ওর প্রতিভার পুরোটাই কাজে লাগাচ্ছে। আর এটা করার জন্য নিজেকে ও নিজেই তৈরি করেছে। কেউ ওকে তৈরি করে দেয়নি।
বিরাট কোহালিরা এ রকমই হয়। আমার বিশ্বাস যে ভাবে নিজেকে ও নিজে মোটিভেট করে, যে ভাবে নিজের স্ট্যান্ডার্ড নিজেই বাড়িয়ে নিয়ে চলেছে ও, তা দেখে ওর সমসাময়িক ক্রিকেটাররাও নিজেদের মোটিভেট করতে পারবে। এবং সত্যিই তা যদি হয়, তা হলে তো সাময়িক ভাবে এই প্রজন্মের ক্রিকেটের মানই অনেক বেড়ে যাবে।
তাই বলতেই হচ্ছে, বিরাট কোহালি শুধু নিজেকে এভারেস্টের উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে না। খেলাটাকেও নিয়ে যাচ্ছে একটা অসাধারণ জায়গায়, যা এর আগে স্যর ডন, স্যর গ্যারি, সচিনরা করতেন। ওদের পাশে বিরাটকেই বা জায়গা দেওয়া যাবে না কেন?