চিরকালীন: লর্ডসে সেই রাজকীয় সেঞ্চুরির পরে সৌরভ। ফাইল চিত্র
হোটেলের ল্যান্ডলাইনে ফোন করলাম। ১৯ জুনের সকাল। ও পার থেকে ভেসে এল বন্ধুর কণ্ঠ— ‘‘চলে আয়, আমি খেলছি।’’
সেই সময়ে মাইনর কাউন্টি খেলছি ইংল্যান্ডে। লন্ডনে নয়, অন্য জায়গায় রয়েছি। কিন্তু ও রকম শুভসংবাদ শোনার পরে আর দ্বিতীয় বার ভাবার জায়গা নেই। সোজা বেরিয়ে পড়লাম লন্ডনের উদ্দেশে। আমার সঙ্গী বাংলার আর এক প্রাক্তন ক্রিকেটার জয়দীপ মুখোপাধ্যায়। আমরা দু’জনে চব্বিশ বছর আগে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই মহারাজকীয় অভিষেকের সময়ে সপরিবার ইংল্যান্ডে ছিলাম। সৌরভই আমাদের টিকিট দিয়ে বলেছিল, ‘‘এত ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে আছি। আমি অভিষেক টেস্ট খেলছি, তোরা দেখতে আসবি না?’’
তখনকার দিনে ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটের কাঠামো এত শক্তিশালী হয়নি। আইপিএল নামক কোনও মহাযজ্ঞের জন্ম হয়নি। আমরা অনেকেই ইংল্যান্ডে ক্লাব ক্রিকেট খেলতাম। একটা সময়ে সৌরভও খেলেছে। ক্রিকেট মাঠে সৌরভের সঙ্গে আমার পথ চলা প্রায় হাত ধরাধরি করে। একসঙ্গে অনূর্ধ্ব পনেরো ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলেছি। সেখানে পাটিয়ালার বিশাল মাঠে ডিপ কভার আর ডিপ পয়েন্টের মধ্যে দিয়ে দু’ওভারে পাঁচটা বাউন্ডারি মারতে দেখেছি। এত বড় মাঠ যে, নভজ্যোৎ সিংহ সিধু আসত ছক্কা মারা প্র্যাক্টিস করতে। সেখানে অনূর্ধ্ব পনেরো একটি ছেলের ও রকম টাইমিং আর ব্যাট হাতে শিল্পীর মতো তুলির টান দেখেই, বুঝতে বাকি ছিল না যে, নতুন প্রতিভা এসে গিয়েছে। আমরা দু’জনে একসঙ্গে কৈলাস ঘাটানির দলের হয়ে ইংল্যান্ড সফরেও গিয়েছি। তখনও সৌরভ পনেরো হয়নি। সেই দলে ছিলাম আমি, সৌরভ, সচিন আর বিনোদ কাম্বলি।
আরও পড়ুন: মুলারদের লিগে ভারতীয় ছোঁয়া, কীর্তি সরপ্রীতের
ব্রিসবেনে মাত্র একটা ওয়ান ডে খেলিয়ে ওকে জাতীয় দল থেকে ব্রাত্য করে দেওয়া হল। সেই দীর্ঘ উপেক্ষাতেও কখনও মনোবল হারাতে দেখিনি। প্রবল দুর্যোগের মধ্যেও এই ইতিবাচক থাকতে পারাটা সৌরভের বড় শক্তি। ১৯ জুন, বন্ধুর ফোনটা পেয়ে লন্ডন যাওয়ার পথে সে সবই ভাবছিলাম। চার বছর বাতিল থাকার পরেও যার সঙ্কল্পে চিড় ধরেনি, তার সাধনা তা হলে মর্যাদা পাচ্ছে।
হোটেল ডানুবিয়ুস। রুম নম্বর ৪০৭। এখনও মনে আছে, সেখানেই অভিষেক টেস্টের সময় ছিল সৌরভেরা। লর্ডসের লাগোয়া সেন্ট জনস উডসেই ছিল সেই হোটেল। আসার পথে একটু ভয়-ভয় করছিল। খবরটা এর মধ্যে পাল্টে-টাল্টে গেল না তো? দল নির্বাচনের ব্যাপার। কখন, কী হয় কে বলতে পারে! হোটেলে পৌঁছে প্রথমেই তাই নিশ্চিত হয়ে নিলাম। সৌরভ আশ্বস্ত করল, ‘‘আমাকে বলে দিয়েছে, কনফার্ম। আমি খেলছি।’’ একটু পরে দেখলাম, অজয় জাডেজা, অনিল কুম্বলে এসে অভিনন্দন জানিয়ে গেল। ভাবলাম, এর পরে নিশ্চয়ই লর্ডস টেস্ট নিয়ে অনেক আলোচনা হবে। প্রতিপক্ষ বোলারদের মধ্যে ডমিনিক কর্ক, ক্রিস লিইউস, অ্যালান মুলালিরা। ইংল্যান্ডের পরিবেশে খুব ভাল সুইং বোলিং বিভাগ। কিন্তু টেস্টের আগের সন্ধ্যার দীর্ঘ আড্ডায় সৌরভের মুখে এক বারও ক্রিকেটের নামগন্ধ শুনলাম না। বলাবলি হচ্ছিল যে, এটাই প্রথম ও শেষ সুযোগ। হয় নিজেকে প্রমাণ করো, নয়তো আবার নিক্ষিপ্ত হও অবজ্ঞার অন্ধকূপে। কিন্তু চব্বিশ বছর আগে ১৯ জুনের সেই সন্ধ্যায় উদ্বিগ্ন সৌরভ নয়, হাসিখুশি সৌরভকেই দেখেছিলাম। আমার মনে হয়, সেটা ওর অভিষেক-সাফল্যের বড় কারণ। এমনিতেই কলকাতা যদি ঘর হয়, লন্ডন বরাবর ওর কাছে ‘সেকেন্ড হোম’। কৈলাস ঘাটানির দলের সঙ্গে সফরের সময় থেকেই দেখেছি, ইংল্যান্ডের পরিবেশে দারুণ মানিয়ে নিতে পারছে সৌরভ। লর্ডসে ব্যাট হাতে নেমে অনেকের বুক কাঁপে। ওর চোয়াল আরও শক্ত হয়। হোটেলে গিয়েছিলাম ভয়ে-ভয়ে, ফিরে এলাম আশ্বস্ত হয়ে।
আরও পড়ুন: ইডেনে সচিনের রুদ্ররূপ ভোলেননি ইরফান
২০ জুন, টেস্টের প্রথম দিনে ইংল্যান্ড ব্যাট করল। অভিষেক সেঞ্চুরির জোয়ারে অনেকেই হয়তো মনে রাখেনি বোলার সৌরভের কামাল। নাসের হুসেন আর গ্রেম হিকের মতো দু’টো বড় উইকেট তুলেছিল ও। দ্বিতীয় দিন, ২১ জুন, তিন নম্বরে ব্যাট করতে নেমে দিনের শেষে ২৬ নট আউট। সেই রাতে আত্মবিশ্বাসী শোনাল ওকে। বলেছিল, ‘‘শুরুর দিকটা চিন্তায় ছিলাম, কিন্তু আর অসুবিধা হচ্ছে না।’’ শুনেই মনে হয়েছিল, ভিতরে-ভিতরে বড় কিছু করার জন্য তৈরি হচ্ছে।
২২ জুন সেই ঐতিহাসিক লগ্ন। লর্ডসে অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরি পূর্ণ করে সৌরভের দু’হাত তুলে উচ্ছ্বাসের ছবি ক্রিকেটভক্তদের মনে অমর হয়ে রয়েছে। সেদিনের খেলা শেষে যখন কথা হল ওর সঙ্গে, ১৩১ রানের পরিতৃপ্তির চেয়েও বেশি করে ফুটে উঠছিল চ্যালেঞ্জ জয়ের আনন্দ। ‘‘আমি পেরেছি,’’ বলে উঠেছিল বাচ্চা ছেলের মতো। তার পরেই যেন সামনের দীর্ঘ অভিযানের শপথ নিতে শুনলাম। ‘‘আমি যে এই পর্যায়ের ক্রিকেটের উপযুক্ত, তা বুঝতে পারলাম। এটাই বড় আনন্দ রে!’’
দীর্ঘ অপেক্ষা, উপেক্ষার পরে অভিষেক টেস্ট খেলতে নেমেই প্রথম সেঞ্চুরি! প্রথম রেলগাড়ি দেখতে পাওয়ার মতোই অচেনা আনন্দ যে!