কীর্তি: কনিষ্ঠতম হিসাবে ব্রোঞ্জ জয় আমনের। ছবি: পিটিআই
আইফেল টাওয়ারের পাশে ঐতিহাসিক হয়ে থাকতে পারত ভারতের কুস্তির মঞ্চ। বিনেশ ফোগতের ১০০ গ্রাম ওজন বেড়ে যাওয়ায় যা অভিশপ্ত হয়ে উঠেছিস, সেখানেই ব্রোঞ্জ জিতে কিছুটা স্বস্তি দিলেন আমন শেরাওয়াত। যাঁর এটাই প্রথম অলিম্পিক্স ছিল এবং অভিষেকেই নজির গড়ে ফেললেন। ভারতের সর্বকনিষ্ঠ প্রতিযোগী হিসেবে অলিম্পিক্সে পদক জিতলেন। এর আগে এই কীর্তি ছিল পি ভি সিন্ধুর।
২১ বছর বয়সি আমন কুস্তিতে পদক জেতার পরম্পরা ধরে রাখলেন, যা বিনেশ বাতিল হয়ে যাওয়ার পরে থেমে যাওয়ার মুখে দাঁড়িয়েছিল। ২০০৮ বেজিংয়ে সুশীল কুমার ব্রোঞ্জ জেতার পর থেকে প্রত্যেক বার অলিম্পিক্স কুস্তিতে পদক জিতেছে ভারত। আমন বললেন, ‘‘আমি দেশবাসীকে বলতে চাই যে, প্যারিসে ব্রোঞ্জ জিতলাম, পরের বার ২০২৮-এ সোনা আনব।’’ খুব ছোটবেলায় বাবা-মাকে হারান তিনি। দাদু বড় করে তুলেছেন। অলিম্পিক্সে ভারতের সাফল্যের তালিকায় তিনি আর এক অনুপ্রেরণামূলক কাহিনি হয়ে থাকলেন। কুস্তিতে সুশীল কুমারের দুটি পদক রয়েছে। আমন প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, সেই সুশীলকে স্পর্শ করার, ‘‘সুশীল পালোয়ানজি দুটো পদক জিতেছিলেন। আমি তিনটি জিততে চাই। ২০২৪-এ পারলাম। ২০৩২ এবং ২০৩৬-এও জিততে চাই,’’ উত্তেজিত হয়ে বললেন তিনি।
পদক জয়ের পরে আমন আবার জানিয়ে যান, বৃহস্পতিবার লড়াইয়ের পরে তাঁর শরীরের ওজনও বেড়ে গিয়েছিল ৪.৬ কেজি। সেই ওজন কমানোর জন্য সময় পেয়েছিলেন মাত্র ১০ ঘণ্টা। সেই সময়ের মধ্যে ওজন ৫৭ কেজিতে নামিয়ে এনে ব্রোঞ্জ জিতে দেশকে আরও এক বার সম্মানিত করলেন। এর পরেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, আমন যদি এতটা ওজন কামাতে পারেন, তা হলে বিনেশ কেন মাত্র ১০০ গ্রাম ওজন কমাতে পারলেন না? তা হলে এর জন্য দায়ী কে? বিনেশের ব্যক্তিগত টিম না কি ভারতীয় অলিম্পিক্স দলের সঙ্গে আসা চিকিৎসকদের দল?
আমনের হাত ধরে এই অলিম্পিক্সে ভারতের মোট পদক দাঁড়াল ছয়। এ বার অলিম্পিক্স শুরু হওয়ার আগে চর্চা শুরু হয়েছিল, পদক সংখ্যা দুই অঙ্ক ছোঁবে। এখনও পর্যন্ত সংখ্যাটা ছয়। লন্ডনে ২০১২ সালের পদক সংখ্যা স্পর্শ করেছে যা। শেষ বার টোকিয়োয় মোট পদক ছিল সাতটি। আর কোনও পদক আসবে কি না, তা নিয়ে রয়েছে সংশয়। যদি আন্তর্জাতিক ক্রীড়া আদালতের রায়ে বিনেশ রুপো পান, তা হলে টোকিয়োর মতো এ বারও হবে সাতটি পদক। তবে পার্থক্য একটাই। টোকিয়োয় সোনা জিতেছিলেন নীরজ, এ বার সেটাও নেই।
অলিম্পিক্সের তালিকায় উপরের দিকে থাকার শর্ত কোন দেশ কটি সোনা জিতেছে তার উপরে। জ্যাভলিনে নীরজ রুপো জেতায় ভারতের দৈন্য দশা খানিকটা কেটেছে, তবে এখনও সেটা দূরবীন দিয়ে দেখতে হবে।
এ দিন ছেলেদের ৫৭ কেজি ফ্রিস্টাইলে ব্রোঞ্জ জয়ের পরে দুই কোচ জগমন্দার সিংহ এবং বীরেন্দ্র দাহিয়া ফাঁস করলেন, মাত্র দশ ঘণ্টার মধ্যে তাঁরা কী অসাধ্য সাধন করেছেন। সারা রাত ধরে নানা ধরনের কসরত করিয়ে আমনকে তৈরি করে দেন। প্যারিসের সময় অনুযায়ী সন্ধে ৬.৩০ মিনিটে লড়াই শেষ হওয়ার পরেই দুই কোচ এক মিনিটও সময় নষ্ট করেননি। গেমস ভিলেজে ফিরেই ওজন কমানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। দুই কোচের সঙ্গে দেড় ঘণ্টা দাঁড়িয়ে কুস্তির মহড়া দেন আমন। তার পরে এক ঘণ্টা ধরে চলে হট বাথ। রাত ১২.৩০ পর্যন্ত জিম করার পরে টানা এক ঘণ্টা আমন ট্রেড মিল করেন। প্রবল ঘামের জন্য আমনের ওজন অনেকটাই কমে যায়। তার পরে তিরিশ মিনিটের বিরতি নিয়ে পাঁচটি পর্বে পাঁচ বার সনা বাথ নিতে হয়েছিল আমনকে।
এর পরেও দেখা যায়, আমনের ওজন ৯০০ গ্রাম বেশি রয়েছে। তখন শুরু হয় হাল্কা জগিং। সেটা শেষ হতেই শুরু হয় ১৫ মিনিটের দৌড়। এই টানা প্রক্রিয়ার মধ্যে আমন খেয়েছিলেন সামান্য মধু মেশানো গরম জল এবং কফি। স্থানীয় সময় ভোর ৪.৩০ মিনিটে দেখা যায়, আমনের ওজন কমে দাঁড়িয়েছে ৫৬.৯ কেজি। ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়ে দুই কোচের। এমন টানা অনুশীলনের এক মুহূর্তের জন্য চোখে ঘুম ছিল না দুই কোচ এবং ছাত্রের। তারই সুফল মিলল ম্যাটে।
পদক জিতে আমন বললেন, ‘‘সারা রাত ঘুমাইনি। কুস্তির ভিডিয়ো দেখেছি এবং নিজেকে তৈরি করে গিয়েছি।’’ কোচ দাহিয়া বলেছেন, ‘‘আমরা প্রত্যেক ঘণ্টায় আমনের ওজন খতিয়ে দেখছিলাম। সারা রাত আমরা কেউই ঘুমাইনি। এমনকি, সকালেও চোখ বন্ধ করতে পারিনি। এখন স্বস্তি পেলাম।’’
দাহিয়া আরও বলেছেন, ‘‘কুস্তিতে ওজন মাপা একটা সাধারণ নিয়মের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু আমরা খুব চিন্তায় ছিলাম। বিনেশের সঙ্গে যা হয়েছিল, তার পরে আমাদের উদ্বেগের শেষ ছিল না। আমরা তাই কোনও ধরনের ঝুঁকি নিতে রাজি ছিলাম না। সব ধরনের উপায় প্রয়োগ করেছি আমনের ওজন কমানোর জন্য।’’
আমন বলে গেলেন, “বাবা-মা এবং দেশবাসীকে এই পদক উৎসর্গ করতে চাই। সেমিফাইনালে জাপানের রেই হিগুচির বিরুদ্ধে রণকৌশল কাজে লাগেনি। কিন্তু এ দিন প্রতিপক্ষকে শুরু থেকেই আক্রমণ করি।” আরও বলেন, “আমি সেমিফাইনালের হার ভুলে গিয়েছিলাম। শুধুমাত্র ব্রোঞ্জের দিকে নজর ছিল। এ ভাবে পদক জেতার আলাদা একটা তৃপ্তি রয়েছে।”
অভিনন্দন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেন, ‘‘ভারতীয় কুস্তিগিরদের অনেক অভিনন্দন।’’ অভিনন্দন জানিয়েছেন বীরেন্দ্র সহবাগ এবং বজরং পুনিয়া।