Paris Olympics 2024

এক হুটারে শেষ দেড় যুগ! শ্রীজেশকে বিদায়বেলায় কুর্নিশ সতীর্থদের, কাঁধে তুলে নিলেন হরমনপ্রীত

পূর্ব ঘোষণা মতোই আন্তর্জাতিক হকি থেকে অবসর নিলেন শ্রীজেশ। প্যারিসে ব্রোঞ্জ পদকের ম্যাচ খেলেই প্রাক্তন হয়ে গেলেন তিনি। বিদায়ের মুহূর্তে তাঁকে কাছছাড়া করতে চাইছিলেন না সতীর্থেরা।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ অগস্ট ২০২৪ ২০:৪৩
Share:

গোলপোস্টের উপর পিআর শ্রীজেশ। ব্রোঞ্জ জয়ের পর। ছবি: পিটিআই।

আকাশের দিকে মুখ। দু’হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছেন পিআর শ্রীজেশ। তাঁর সামনে বাকি সতীর্থেরা। মাথা নিচু করে তাঁরা কুর্নিশ জানাচ্ছেন দলের সবচেয়ে সিনিয়র সদস্যকে।

Advertisement

শ্রীজেশ আর ভারতীয় দলের সাজঘরে থাকবেন না। হরমনপ্রীত সিংহেরা পাবেন না তাঁর মূল্যবান পরামর্শ। অলিম্পিক্স শুরুর আগেই সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলেছিলেন শ্রীজেশ। বৃহস্পতিবার সকালে সমাজমাধ্যমে আবার সে কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন হকিপ্রেমীদের।

১৮ বছরের আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়জীবনের ম্যাড়ম্যাড়ে সমাপ্তি চাননি শ্রীজেশের সতীর্থেরা। হরমনপ্রীতেরা চেয়েছিলেন দেশের হয়ে শেষ ম্যাচ খেলার পর সোনার পদক গলায় ঝুলিয়ে টার্ফ ছাড়ুন শ্রীজেশ। সেমিফাইনালে জার্মানির কাছে হারে সেই ইচ্ছা পূরণ হয়নি। তাই বলে খালি হাতে বিদায় নেবেন বিশ্বের অন্যতম সেরা হকি গোলরক্ষক! স্পেনের বিরুদ্ধে জয় ছাড়া কিছু ভাবেননি হরমনপ্রীতেরা। শ্রীজেশের অবসরের মুহূর্ত স্মরণীয় করে রাখতে ভারতের হকি খেলোয়াড়েরা নিজেদের যান লড়িয়ে দিয়েছিলেন ব্রোঞ্জ পদকের ম্যাচে। অলিম্পিক্সের প্রতিটি ম্যাচে ভারতীয় দলের দুর্গ আগলেছেন শ্রীজেশ। দেওয়ালের মতো দাঁড়িয়ে থেকেছেন গোল আটকে। ‘বল দেখ, গোল বাঁচাও’ — শ্রীজেশের এই মন্ত্র সাফল্য দিয়েছে। স্বপ্ন দেখিয়েছে দেশকেও।

Advertisement

সতীর্থদের ভালবাসায় আপ্লুত শ্রীজেশ এক লাফে চড়ে বসলেন গোল পোস্টের উপর। ঠিক যেমন টোকিয়ো অলিম্পিক্সেও ব্রোঞ্জ পদক ম্যাচে জার্মানিকে হারানোর পর করেছিলেন। শ্রীজেশকে ছাড়তে চাইছিলেন না হার্দিক সিংহ, মনপ্রীত সিংহ, অমিত রুইদাসেরা। ঘিরে রাখতে চাইছিলেন প্রিয় প্রাক্তন অধিনায়ককে।

শ্রীজেশও হয়তো চাইছিলেন না সতীর্থদের থেকে দূরে থাকতে। এক লাফে নেমে পড়লেন গোল পোস্টের উপর থেকে। কিন্তু চাইলেই কি নামা যায়। নিজের কাঁধ এগিয়ে দিলেন অধিনায়ক হরমনপ্রীত। শুনলেন না শ্রীজেশের আপত্তি। ৯০ কিলোগ্রামের শরীরটা তুলে নিলেন হরমনপ্রীত। অধিনায়কের কাঁধে চড়ে মাঠ প্রদক্ষিণ শুরু হল শ্রীজেশের। দর্শক গ্যালারির উচ্ছ্বাসও থামছিল না। শ্রীজেশের নামে জয়ধ্বনি দিয়েই যাচ্ছিলেন সমর্থকেরা। প্রবীণ গোলরক্ষক দেখছিলেন মাঠের চার পাশ। সতীর্থদের। দলের সঙ্গে থাকা বাকিদের। তাঁর জন্য, শুধু তাঁর জন্য এ বার প্যারিসে পদক জিততে মরিয়া ছিলেন হরমনপ্রীতেরা। প্রিয় গোলরক্ষককে খালি হাতে অবসরজীবনে পা রাখতে দিতে চাননি কেউ।

পদক জয়ের উচ্ছ্বাস, আনন্দের মধ্যেও মিশে যাচ্ছিল বিষাদ। মন খারাপের সুর। শ্রীজেশ শুধু অবসর নিলেন না। একই সঙ্গে শেষ হল ভারতীয় হকির একটা যুগ। থুরি দেড়টা যুগ। ২০০৬ থেকে ২০২৪। হুটারের একটা শব্দে শেষ হয়ে গেল। এই যুগ তো যেমন তেমন যুগ নয়। ভারতীয় হকির সোনালি যুগ অতীত হয়েছে আগেই। ফিরিয়ে আনা হয়েছে ব্রোঞ্জ যুগ। যে প্রত্যাবর্তনের অন্যতম কান্ডারি শ্রীজেশ। টোকিয়ো অলিম্পিক্সে ভারত পদক জিতেছিল চার দশক পর। এ বার আবার। পর পর দু’বার। ভারতীয় হকি নতুন গতি পেয়ে গেল বোধহয়। রকেটের গতির পিছনে যেমন থাকে আগুন, তেমনই ভারতীয় হকির এ উত্থানের পিছনে অনস্বীকার্য শ্রীজেশের অবদান। গত ১৮ বছরে ভারতীয় খেলোয়াড়েরা যত গোল করেছেন, তার কয়েক গুণ বেশি গোল বাঁচিয়েছেন শ্রীজেশ। নানা দেশের তাবড় স্ট্রাইকারেরা শ্রীজেশের সামনে ব্যর্থ হয়েছেন।

শ্রীজেশ নিজে এগিয়ে রাখছেন টোকিয়োর ব্রোঞ্জকে। ম্যাচের পর তিনি বললেন, ‘‘ভারত অলিম্পিক্সে হকিতে পদক জিততে পারে এই বিশ্বাসটাই হারিয়ে গিয়েছিল। টোকিয়ো আস্থা ফিরিয়েছিল। কয়েক দশকের অপ্রাপ্তি দূর করেছিল। তাই এ বারের ব্রোঞ্জের থেকে আগের বারের মূল্য বেশি। এ বারের পদক ফিরে আস্থাকে আরও পোক্ত করল।’’ শ্রীজেশের চোখে যখন ভারতীয় হকির উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ, সে সময় উৎসব শুরু হয়ে গিয়েছে তাঁর কোচির বাড়িতেও। ঘরের ছেলের অবসরের মুহূর্তের সাফল্যে মেতে উঠেছিলেন পরিবারের সকলে। আসতবাজির আলোয় একটু বেশিই ঝলমল করছিল শ্রীজেশের ঘর।

শ্রীজেশ ঠিকই বলেছেন। টোকিয়োয় যে তিন দল পদক জিতেছিল, তাদের মধ্যে এক মাত্র ভারতই এ বার প্রথম তিনে থাকল। শ্রীজেশের জন্যই থাকল। গোলের নিচে তাঁর দুরন্ত পারফরম্যান্সের জন্য থাকল। তাঁর জন্য দলের বাকিদের মরিয়া লড়াইয়ের জন্য থাকল। অবসর নিয়ে আক্ষেপ নেই শ্রীজেশের। কোচির ৩৬ বছরের যুবক বললেন, ‘‘একটা সময় সিদ্ধান্ত নিতেই হয়। এই সিদ্ধান্তটা কঠিন ছিল। তবে শেষটা এত ভাল হওয়ায় ভীষণ ভাল লাগছে। আমার খলোয়াড়জীবনের শেষটা সুন্দর করার জন্য দলের প্রত্যেক সদস্যের অক্লান্ত পরিশ্রম রয়েছে। সে খেলোয়াড় হোক বা সাপোর্ট স্টাফ। ভারতীয় অলিম্পিক্স অ্যাসোসিয়েশন, হকি ইন্ডিয়ার কর্তাও খুব আন্তরিক ছিলেন। সবাইকে ধন্যবাদ এমন একটা মুহূর্ত উপহার দেওয়ার জন্য।’’

ধন্যবাদ আসলে শ্রীজেশের প্রাপ্য। তাঁর ত্যাগের জন্য। রিয়ো অলিম্পিক্সে অধিনায়ক শ্রীজেশের দল আট নম্বরে শেষ করেছিল। দুর্গ সুরক্ষিত করতে নেতৃত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন। এ বার হকিকেই বিদায় জানিয়ে দিলেন ভারতীয় হকির ‘দ্য গ্রেট ওয়াল’। শ্রীজেশ বিশ্বাস করেন, তাঁর অবসরে ভারতীয় হকির দুর্গ আদৌ অসুরক্ষিত হবে না। পর পর দুই অলিম্পিক্সের পদক আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে দলকে। শুধু তিনি আর পথ হাঁটবেন না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement