বিনেশ ফোগট। (উপরে) গত বছর প্রতিবাদের সময় এবং মঙ্গলবার চার বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন সুসাকিকে হারানোর পর। ছবি: এক্স (টুইটার)।
বিনেশ ফোগট প্যারিস থেকে পদক নিয়ে দিল্লি ফেরার পর কী করবেন দিল্লি পুলিশের সেই কর্মীরা? যাঁরা যন্তর মন্তর থেকে প্রতিবাদী বিনেশকে প্রায় পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে গিয়ে আটক করেছিলেন! ২৯ বছরের কুস্তিগিরের সঙ্গে একটা নিজস্বী তুলে রাখতেই পারেন।
সর্বভারতীয় কুস্তি সংস্থার প্রাক্তন সভাপতি ব্রিজভূষণ শরণ সিংহের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অন্যতম প্রধান মুখ ছিলেন বিনেশ। তিনিই আবার প্যারিস অলিম্পিক্সে ভারতীয় কুস্তিরও অন্যতম প্রধান মুখ। কুস্তি ঠান্ডা ঘরে হয় না। ম্যাটে লড়াই করতে হয়। প্রস্তুতি নিতে হয় আখড়ায়। ভারতীয় কুস্তিতে হরিয়ানার ফোগট পরিবারের অবদান কম নয়। কাকা মহাবীর সিংহ ফোগট প্রাক্তন কুস্তিগির। বিনেশের প্রথম কোচ তিনিই। তাঁর বাবা রাজপাল ফোগটও প্রাক্তন কুস্তিগির। গীতা ফোগট এবং ববিতা ফোগট তাঁর তুতো বোন। আমির খানের ছায়াছবি ‘দঙ্গল’ তুলে ধরেছিল ফোগট বোনেদের কুস্তিগির হয়ে ওঠার লড়াইয়ের কাহিনি। সংগ্রামের কাহিনি। গ্রাম, সমাজের কটাক্ষ উপেক্ষা লড়াইটা ঢুকিয়ে দিয়েছিল ফোগট বোনেদের মজ্জায়। কুস্তিতে হাতেখড়ির সময়েই।
সব নেতিবাচক ঘটনার আড়ালেই হয়তো একটা ইতিবাচক দিকও থাকে। কুস্তি শেখার প্রাথমিক পর্বে সেই কটাক্ষগুলিই ফোগট বোনেদের তৈরি করেছে অন্য ধাতুতে। লড়াই, লড়াই এবং লড়াই। লড়াইয়ের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত হাল ছাড়তে শেখেননি ফোগটেরা। শেখেননি বলেই জাপানের ইউ সুসাকিকে অলিম্পিক্সের প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালের শেষবেলায় হারিয়ে দিয়েছেন পিছিয়ে থেকেও। কে এই সুসাকি? মহিলাদের ৫০ কেজি বিভাগে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। টোকিয়ো অলিম্পিক্সে সোনাজয়ী সুসাকি মঙ্গলবারের আগে কখনও আন্তর্জাতিক ম্যাচ হারেননি। বিশ্বের এক নম্বর যে অপরাজিত নন, প্যারিসে প্রমাণ করে দিয়েছেন বিনেশ।
এর আগে বিনেশের সামনে কখনও পড়েননি সুসাকি। কারণ মহিলাদের কুস্তির ৫০ কেজি বিভাগ তাঁর ইভেন্ট নয়। তাঁর আসল ইভেন্ট ৫৩ কেজি বিভাগ। আগেই অলিম্পিক্সের ৫৩ কেজি বিভাগে যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন অন্তিম পাঙ্ঘাল। বিনেশকে তাই বেছে নিতে হয়েছিল ৫০ কেজি বিভাগ। ৫৩ কেজি বিভাগে নামার চেষ্টা করেছিলেন বিনেশ। কিন্তু অলিম্পিক্সের আগে ট্রায়ালে জিততে পারেননি। কুস্তির দক্ষতা, অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে পিছিয়ে থাকা বিনেশ লড়াইয়ের প্রায় শেষ দিকে এক প্যাঁচে জয় ছিনিয়ে নিয়েছেন। সেমিফাইনালেও কিউবার প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করেছেন অনায়াসে। রুপো নিশ্চিত। লড়াই এ বার সোনার পদকের জন্য।
বিনেশের পূর্ব অলিম্পিক্স অভিজ্ঞতা ভাল নয়। রিয়ো এবং টোকিয়োয় ৫৩ কেজি বিভাগে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। দু’বারই হেরে যান কোয়ার্টার ফাইনালে। রিয়ো থেকে দেশে ফিরেছিলেন হাঁটুর লিগামেন্টে গুরুতর চোট নিয়ে। সে সময় তাঁর কুস্তিজীবন শেষ হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। আর টোকিয়ো থেকে ফিরেছিলেন নিলম্বিত (সাসপেন্ড) হয়ে। গেমস ভিলেজে ভারতের অন্য কুস্তিগিরদের সঙ্গে অনুশীলন করতে অস্বীকার করায় এবং ভারতীয় দলের অনুশীলন জার্সি ব্যবহার না করায় শাস্তি পেয়েছিলেন। শৃঙ্খলাভঙ্গের করে নিলম্বিত করেছিল সর্বভারতীয় কুস্তি ফেডারেশন।
এ বারও প্রথম থেকে তাঁকে পছন্দের ৫৩ কেজি বিভাগে অংশগ্রহণে বাধা দিয়েছিলেন ফেডারেশন কর্তাদের একাংশ। তবু দমে যাননি বিনেশ। নিজেকে তৈরি করেছেন ৫০ কেজি বিভাগের জন্য। শরীরের ওজন ৩ কিলোগ্রাম কমাতে হয়েছে সক্ষমতা অটুট রেখে। সে জন্য বদলাতে হয়েছে খাদ্যাভ্যাস। আন্দোলনের জন্য দীর্ঘ দিন অনুশীলনের মধ্যে ছিলেন না। খেলোয়াড়দের জীবনের অনুশাসনের মধ্যে রাখতে পারেননি নিজেকে। সেই খামতিও মেটাতে হয়েছে বাড়তি অনুশীলন করে।
৪০ দিনের আন্দোলন অনেকটা পিছিয়ে দিয়েছিল বিনেশকে। সতীর্থদের সঙ্গেও লড়াইয়ে হেরে যাচ্ছিলেন। কিন্তু যাঁর রক্তে কুস্তি তাঁকে রোখে কে! সুসাকিও পারলেন না। খেলা শেষ হওয়ার ১০ সেকেন্ড আগে ০-২ ব্যবধানে পিছিয়ে থাকা বিনেশ জয় ছিনিয়ে নিয়েছেন ৩-২ ব্যবধানে। বিনেশের প্যাঁচে কাহিল সুসাকিও ম্যাচ শেষে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। ছোট থেকে বহু ঝড়ঝাপটা সামলে পথ চলা বিনেশের সামনে কোয়ার্টার ফাইনালে দাঁড়াতে পারেননি ইউক্রেনের ওকসানা লিভাচও। বিনেশ জেতেন ৭-৫ ব্যবধানে। শেষ দিকে মরিয়া লড়াই করে লিভাচ ২ পয়েন্ট পেলেও আগেই জয় এক রকম নিশ্চিত করে ফেলেছিলেন ভারতীয় কুস্তিগির।
গত বছর ভারতীয় কুস্তির অবস্থা ছিল টালমাটাল। ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে আন্দোলনের কারণে অলিম্পিক্সের আগের বছর প্রস্তুতির অনেকটা সময় নষ্ট হয়েছিল। অবশেষে ব্রিজভূষণ ইস্তফা দেন এবং নতুন করে নির্বাচন হয়। সেই নির্বাচনে সভাপতি নির্বাচিত হওয়া সঞ্জয় সিংহকে নিয়েও খুশি ছিলেন না বিনেশরা। তবু অলিম্পিক্সকে অগ্রাধিকার দিয়ে আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। বিনেশ প্রস্তুতি নিতে যান বিদেশে কোচ ওলার অ্যাকোসের কাছে।
বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ, এশিয়ান গেমস, কমনওয়েলথ গেমস, এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে পদক রয়েছে বিনেশের। বাড়ির ট্রফি ক্যাবিনেটে নেই অলিম্পিক্স পদক। সেই পদকের জন্যই বেছে নেন প্যারিসকে। দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করেছেন। এই পদকের জন্যই তো বছরের পর বছর প্রস্ততি। নিজেকে উন্নত করার অবিরাম প্রচেষ্টা। চোট-আঘাত সামলে বার বার উঠে দাঁড়িয়েছেন। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে যেমন ভয় পাননি, তেমনই বিভাগ বদলেও পিছিয়ে যাননি। ভাগ্যিস যাননি। তা হলে প্যারিস অলিম্পিক্সে ভারতকে গর্বিত করার সুযোগ পেতেন না। তাঁর লড়াইয়ে গর্বিত প্রতিবাদের সঙ্গী বজরং পুনিয়া, সাক্ষী মালিকেরাও।
দিল্লি পুলিশ কি মনে রেখেছে সেই এফআইআরের কথা? মহিলাদের ৫০ কেজি বিভাগে চার বারের বিশ্বজয়ী সুসাকিকে হারানোর পরই মনে করিয়ে দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস। সমাজমাধ্যমে তৃণমূলের পোস্টে রাজনীতির খোঁচা রয়েছে নিশ্চয়ই। আলাদা তাৎপর্যও রয়েছে। কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন দিল্লি পুলিশই তো টেনে-হিঁচড়ে বিনেশকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল যন্তর মন্তর খালি করার জন্য। সুসাকিকে হারানোর পর প্যারিসের ম্যাটে শুয়ে বিনেশের কান্না দেখেছে দেশ। দলা পাকিয়ে যাওয়া কন্ঠস্বর কিছু একটা বলতে চাইছিল। লুটিয়েন্স দিল্লির নর্থ ব্লকে এই শব্দ পৌঁছয়নি নিশ্চিত। যন্তর মন্তরের সেই শব্দ পৌঁছাতেই তো প্রশাসনিক সময় লেগেছিল।
বিতর্ক, আন্দোলন, আটক অতীত। বিনেশ প্রমাণ করে দিয়েছেন, যে পারে সে সব জায়গায় লড়তে পারে। দিল্লির রাজপথেও পারে। প্যারিসের ম্যাটেও পারে।