গর্জন: পঞ্চম বার উইম্বলডন জেতার উচ্ছ্বাস জোকোভিচের। রবিবার। এপি
হতাশ! প্রায় পাঁচ ঘণ্টা টেনিসের সর্বোচ্চ পর্যায়ের লড়াই দেখার পরে এই শব্দটা ছাড়া আর কিছু মাথায় আসছে না। শুধু সেন্টার কোর্টেই নয়, টিভির সামনে যাঁরা ছিলেন তাঁরাও বোধহয় এক বারও সিট ছেড়ে উঠতে পারেননি। এতটাই রুদ্ধশ্বাস ছিল লড়াইটা।
শুধু আমি কেন গোটা বিশ্বের টেনিসপ্রেমীদের অধিকাংশই বোধহয় চেয়েছিল রবিবার উইম্বলডনে নোভাক জোকোভিচকে হারিয়ে রজার ফেডেরার জিতুক। পরের মাসেই ৩৮ বছর বয়সে পড়া এক জন খেলোয়াড় তার চেয়ে ছ’বছরের জুনিয়র প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে টেনিসের ইতিহাসে সব চেয়ে বেশি বয়সে গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয়ের সামনে থাকলে সবাই যে সেটাই চাইবে তাতে আর আশ্চর্য কী!
কিন্তু ফেডেরার পারল না। উইম্বলডনের ইতিহাসে প্রথম বার পুরুষদের সিঙ্গলস ফাইনাল পঞ্চম সেট টাইব্রেকে ফয়সলা হওয়ার ম্যাচে ৪ ঘণ্টা ৫৭ মিনিটের লড়াই হেরে গেল। ফল জোকোভিচের পক্ষে ৭-৬ (৭-৫), ১-৬, ৭-৬ (৭-৪), ৪-৬, ১৩-১২ (৭-৩)। এগারো বছর আগে উইম্বলডনে ফেডেরার-নাদালের ৪ ঘণ্টা ৪৮ মিনিটের ফাইনালকেও ছাপিয়ে গিয়েছিল আজকের ফাইনাল।
কেন পারল না ফেডেরার?
পারল না বিপক্ষে জোকোভিচের মতো দুর্ধর্ষ কাউন্টার পাঞ্চার ছিল বলে। জোকোভিচকে বলা হয় মাকড়সা। কোর্টে যার দিকে যে কোনও দিক থেকে যে রকমই শট মারা হোক না কেন, ঠিক বিপক্ষের দিকে ফিরে আসে। তাই ওর দুর্বলতা খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন। রবিবার সেন্টার কোর্টে প্রায় পাঁচ-সাত বার ফেডেরার জেতার কাছাকাছি চলে আসলেও প্রত্যেক বার ফিরে এসেছে জোকোভিচ। এমনকী পঞ্চম সেটে দু’টো ম্যাচ পয়েন্ট বাঁচিয়েও ফেডেরারকে হারিয়ে দিল। নিজের ষোলো নম্বর গ্র্যান্ড স্ল্যাম আর পাঁচ নম্বর উইম্বলডন জিতল।
ফেডেরার ঠিক স্ট্র্যাটেজিই নিয়েছিল জোকোভিচের বিরুদ্ধে। জোকোভিচকে র্যালি করতে না দিয়ে ছোট ছোট পয়েন্টে খেলা। আর জোকোভিচের ব্যাকহ্যান্ডে স্লাইস করে যাওয়া ক্রমাগত। যাতে বল জোকোভিচের কাছে পৌঁছনোর পরে নিচু হয়ে যায় আর ও পাল্টা শট মারতে গিয়ে ভুল করে বসে।
এই স্ট্র্যাটেজিতে গোটা ম্যাচেই ফেডেরারের দাপট বেশি ছিল। ইন্টারনেটে দেখছিলাম, ২৫টা ‘এস’ মেরেছে ফেডেরার। জোকোভিচের ‘এস’ সেখানে ১০টা। সার্ভিস ছাড়াও পাঁচটা সেটেই ফেডেরার ফোরহ্যান্ড, নেট প্লে, কোর্ট কভারেজ, ব্যাকহ্যান্ড সব কিছুতেই জোকোভিচকে পিছিয়ে দিয়েছিল। মোট পয়েন্ট জেতার দিক থেকেও এগিয়ে ছিল ফেডেরার। তবুও হল না। আসলে সত্যিকারের চ্যাম্পিয়ন ঠিক সময়ে, বড় মঞ্চে জ্বলে ওঠে। অনেকটা ক্রিকেটে ফাইনালে সেঞ্চুরি করার মতো। সেন্টার কোর্টে ফেডেরারের পক্ষে প্রবল জনসমর্থনকে সামলেও জোকোভিচ সেটাই করে দেখিয়েছে। চতুর্থ সেটের আগে এক বারও সেন্টার কোর্টে ‘নোভাক-নোভাক’ চিৎকার শুনিনি। প্রতি বারই যখন ফেডেরার পয়েন্ট জিতেছে উল্লাসে ফেটে পড়েছে দর্শকরা।
আসলে ফেডেরার এ বার উইম্বলডনে যে রকম খেলেছে তাতে ওর ২১ নম্বর গ্র্যান্ড স্ল্যামের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল সবাই। দুর্ধর্ষ ছন্দে থাকা রাফায়েল নাদালকে সেমিফাইনালে স্ট্রেট সেটে হারানোর পরে সেই প্রত্যাশা আরও বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল।
কিন্তু ফাইনালে প্রথম সেট থেকেই কেউ কাউকে কোনও সুযোগ দিচ্ছিল না। ফেডেরারের পরিকল্পনা ছিল প্রথম সেট যে ভাবে হোক দখল করতে হবে। সেই জন্য জোকোভিচকে শুরু থেকেই চাপে রাখতে শুরু করে। জোকোভিচও জানত, ফেডেরারের আক্রমণের জবাবে পাল্টা আক্রমণ করলে হবে না। ওকে ধৈর্য ধরতে হবে। র্যালি করে যেতে হবে। সেই পরিকল্পনা ধরে রাখতেই তিনটে সেট টাইব্রেকে নিয়ে যেতে পেরেছে ও। তার পরে টাইব্রেকে পাল্টা আক্রমণ করেছে। সেটা তিন বারই ফেডেরার সামলাতে পারেনি।
তবে প্রথম আর তৃতীয় সেট জেতার পরে জোকোভিচের ফোকাস বোধ হয় একটু নড়ে গিয়েছিল। সেই সুযোগে ফেডেরার ম্যাচে ফিরে আসে। সঙ্গে আরও একটা ব্যাপার দেখলাম। চাপে পড়লেই ফেডেরার আরও বেশি করে নেটে উঠে আসছে। জোকোভিচেরও পাল্টা চাল ছিল র্যালি করে যাওয়া। তাতেও খুব একটা সুবিধে যে প্রত্যেক বার করতে পেরেছে তা নয়। প্রথমে একটা ২১ শটের র্যালি হল। জিতল জোকোভিচ। এর পরে ২৬ শটের একটা র্যালি হল। সেটা ব্যাক হ্যান্ড উইনারে জিতল ফেডেরার। পঞ্চম সেটে ৩৫ শটের একটা লড়াইও ফেডেরার একই ভাবে জেতে।
তাই বলছি ফেডেরার এই বয়সেও যে লড়াইটা দেখিয়েছে তাতে বলতে হচ্ছে জোকোভিচ ট্রফি জিতলেও আসল চ্যাম্পিয়ন ফেডেরারই।