আমার ক্যাপ্টেন চিরকাল থাকবে আমার সঙ্গেই

রঞ্জিতে অভিষেক ম্যাচে অজিত ওয়াড়েকর আমার ক্যাপ্টেন ছিলেন। ইন্ডিয়া ক্যাপ পাওয়ার সময়ও নেতা সেই তিনিই। তাই আমার কাছে চিরকালই উনি ‘ক্যাপ্টেন’।

Advertisement

সুনীল গাওস্কর

শেষ আপডেট: ১৭ অগস্ট ২০১৮ ০৪:৫২
Share:

অতীত: তাঁর অধিনায়ক অজিত ওয়াড়েকরের সঙ্গে সানি। ফাইল চিত্র

‘সুনীল, দুঃখিত ও আর নেই।’

Advertisement

এই কয়েকটা শব্দেই ভেঙেচুরে গেলাম। আমার ক্যাপ্টেন আর নেই! কিছুক্ষণ আগেই ওঁকে একটা গাড়িতে তোলার কাজে হাত লাগিয়েছিলাম। যাতে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে পাঠানো যায়। অ্যাম্বুল্যান্স আসতে আরও মিনিট পনেরো লেগে যেত। অবশ্য তখনই ওঁকে দেখে মনে হয়েছিল, এই যুদ্ধে বোধহয় আর জেতা যাবে না!

রঞ্জিতে অভিষেক ম্যাচে অজিত ওয়াড়েকর আমার ক্যাপ্টেন ছিলেন। ইন্ডিয়া ক্যাপ পাওয়ার সময়ও নেতা সেই তিনিই। তাই আমার কাছে চিরকালই উনি ‘ক্যাপ্টেন’।

Advertisement

শিবাজি পার্ক জিমখানা থেকে উঠে এসেছিলেন ওয়াড়েকর। আমি দাদার ইউনিয়ন স্পোর্টিং ক্লাবে। এই দু’দলের সাংঘাতিক আকচা-আকচি। কিন্তু তবুও সবার আগে আমি ওঁর একজন ভক্ত ছিলাম। তখন সপ্তাহান্তে এমন একটা দিনও পাইনি যখন কাগজে ওয়াড়েকরের সেঞ্চুরির খবর পাইনি।

ঘরোয়া ক্রিকেট আর রঞ্জি ছিল ওঁর দক্ষতা দেখানোর উর্বরতম জমি। অথচ কী আশ্চর্য, ওঁকে ভারতীয় দলে ডাকা হল অনেক পরে সেই ১৯৬৬ সালে গ্যারি সোবার্সের ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে!

মজা হচ্ছে, তার ঠিক পাঁচ বছর পরে সোবার্সের দলের বিরুদ্ধেই ওঁকে দেখা গেল অধিনায়কের ভূমিকায়। এবং কে না জানে, সে বারই প্রথম ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে বিদেশে সিরিজ জিতল ভারত।

তার কয়েক মাস পরেই ইংল্যান্ড সফর। আবার আমরা সিরিজ জিতলাম। এ বার ইংল্যান্ডে প্রথম বার তাদের হারানোর নজির সৃষ্টি হল।

কেন জানি না, ওকে বলা হত লাকি ক্যাপটেন। আমার চোখে সেটা খুবই নির্মম একটা মন্তব্য। আসলে মনসুর আলি খান পটৌডির হাত থেকে ওয়াড়েকরের হাতে নেতৃত্ব যাওয়াটা হজম করতে পারেনি যারা, তারাই সেটা বলত। তখন নিবার্চন কমিটির চেয়ারম্যান কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান বিজয় মার্চেন্ট। তাঁকেও ছাড়া হয়নি। কারণ, মার্চেন্টের কাস্টিং ভোটেই ওয়াড়েকর অধিনায়ক হয়েছিলেন।

বিদেশে এই জোড়া জয়ের পরে ভারত নিজের মাঠেও একটা সিরিজ জিতেছিল। অথচ কী আশ্চর্য, এ হেন হ্যাটট্রিকের পরেও ওদের প্রাপ্য প্রশস্তি জোটেনি।

ওয়াড়েকর হঠাৎই টেস্ট ক্রিকেট থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। ঘটনাটা ঘটেছিল, দলীপ ট্রফির পশ্চিমাঞ্চল দল থেকে অন্য আর এক বড় মাপের ভারতীয় ক্রিকেটার পলি উম্রিগর ওঁকে বাদ দেওয়ার পর পরই। তখন থেকে উনি নিজের ব্যাঙ্কিংয়ের পেশা নিয়ে মেতে উঠলেন। সঙ্গে মুম্বই ক্রিকেট সংস্থার প্রশাসনিক কাজেও।

নব্বইয়ের দশকে ভারতীয় দলের কোচ কাম ম্যানেজারের ভূমিকাতেও কিন্তু যথেষ্ট উজ্জ্বল ছিলেন ওয়াড়েকর। যখন আমাদের মধ্যে কেউ কেউ জমি নিয়ে একটা অ্যাপার্টমেন্ট করতে মহারাষ্ট্র সরকারের দ্বারস্থ হয়, তখনও উনিই সেই নেতার ভূমিকা নেন। সেই সোসাইটিতে উম্রিগরও ছিলেন। ছিলেন, কারণ, ওয়াড়েকর কখনও ওঁর সিনিয়রদের প্রতি অসম্মান দেখাননি। ওয়াড়েকরই সেই অ্যাপার্টমেন্টের প্রোমোটর ছিলেন। অথচ উনি শেষে কিনা একেবারে উপরের তলার একটা ফ্ল্যাট পান। আমি আবার তার ঠিক নীচের তলাতেই থাকতাম। ওয়াড়েকর তাই মজা করে বলতেন, ‘‘আমিই একমাত্র লোক যে সানিরও উপরে।’’

হালফিলের এই ব্যস্ত সময়ে আমাদের বলতে গেলে দেখাই হত না। কিন্তু কচ্চিৎ কখনও দেখা হলেই, আগের মতো সেই আস্তে আস্তে কথা বলে হাল্কা মজা করতে ভুলতেন না।

একটা সময় ছিল যখন প্রায় প্রতিদিন দেখা হলেই অন্তত এক বার উনি বলতেন, ‘আরে কেয়া রে’। শুধু আমি না, সচিন তেন্ডুলকরও আমাকে বলেছে, ওরও সেই একই অভিজ্ঞতা।

আজ আমার ক্যাপ্টেন আর নেই। কিন্তু যখনই আমি বলব ‘আরে কেয়া রে’ তখনই উনি আমার মনের ভিতরে জেগে উঠবেন।

ক্যাপ্টেন, তোমার আত্মার শান্তি কামনা করি! (পিটিআই)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement