হাঁপানিকে জয় করেই সাতটি মহাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ চড়েছেন সত্যরূপ

শুধু মাত্র মেক্সিকোর পিকো দে ওরিজ়াবা ও অ্যান্টার্কটিকার মাউন্ট সিডলির চূড়া অতিক্রম করতে পারলেই বিশ্বরেকর্ড গড়বেন। কী সেই বিশ্বরেকর্ড? না, সব চেয়ে কমবয়সি পর্বত আরোহী হিসেবে সাতটি মহাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ও সাতটি আগ্নেয় পর্বত পার করার নজির।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০১৮ ০৪:০৫
Share:

প্রত্যয়ী: বিশ্বরেকর্ডেই চোখ সত্যরূপের। নিজস্ব চিত্র

ছোটবেলা থেকে হাঁপানির জন্য ফুটবল নিয়ে মাঠে নামার স্বাদ পাননি। নিয়মিত খেলতে পারেননি ক্রিকেটও। যেখানেই যেতেন, তাঁকে সঙ্গ দিত ‘ইনহেলার’ (হাঁপানি থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য যা ব্যবহার করা হয়)। কিন্তু এই হাঁপানিকে জয় করেই সাতটি মহাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ অতিক্রম করে ফেলেছেন। তারই সঙ্গে ছুঁয়ে ফেলেছেন পাঁচটি আগ্নেয় পর্বতের চূড়া। তিনি পর্বত আরোহী সত্যরূপ সিদ্ধান্ত।

Advertisement

শুধু মাত্র মেক্সিকোর পিকো দে ওরিজ়াবা ও অ্যান্টার্কটিকার মাউন্ট সিডলির চূড়া অতিক্রম করতে পারলেই বিশ্বরেকর্ড গড়বেন। কী সেই বিশ্বরেকর্ড? না, সব চেয়ে কমবয়সি পর্বত আরোহী হিসেবে সাতটি মহাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ও সাতটি আগ্নেয় পর্বত পার করার নজির। যে রেকর্ড এত দিন ধরে রেখেছেন অস্ট্রেলিয়ার ড্যানিয়েল বুল। ৩৬ বছর বয়সে এই নজির গড়েন ড্যানিয়েল। সত্যরূপের পরিকল্পনা অনুযায়ী মাউন্ট সিডলিতে পৌঁছনোর সময় তাঁর বয়স দাঁড়াবে ৩৫ বছর ১২৮ দিন। আগামী বৃহস্পতিবারই এই স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে মেক্সিকো রওনা দিচ্ছেন তিনি।

বহরমপুরে জন্মেছিলেন। সেখানেই বড় হয়ে ওঠা সত্যরূপের। ট্রেকিং অথবা অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস সম্পর্কে কোনও ধারণাই ছিল না। ২০০১ সালে সিকিমে পড়াশোনা করতে গিয়ে হাঁপানির জন্য প্রাণ হারাতে বসেছিলেন তিনি। সত্যরূপ বলছিলেন, ‘‘এক দিন ক্লাস থেকে বেরিয়ে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। পকেটে হাত দিয়ে দেখি ইনহেলার নিয়ে বেরোইনি। তখনই মাটিতে আছড়ে পড়ি। মনে হচ্ছিল, এখনই প্রাণ বেরিয়ে যাবে। সেখান থেকে বেরিয়ে আসার পর থেকেই মনে জেদ চেপে যায়। ঠিক করি, যে ভাবেই হোক হাঁপানি সারাতেই হবে। এবং সেটা ওষুধে নয়। স্বাভাবিক ভাবে।’’

Advertisement

২০০৮ সালে তামিলনাড়ুতে প্রথম ট্রেকিং করতে গিয়েছিলেন। সে বারই প্রথম ইনহেলার ব্যবহার করার প্রয়োজন পড়েনি সত্যরূপের। তখনই ঠিক করে নেন, সমতল নয়, পাহাড়কেই নিজের বন্ধু বানাবেন। সোমবার কলকাতায় একটি অনুষ্ঠানে এসেছিলেন সত্যরূপ। একটি বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে স্পনসর পান সত্যরূপ। অনুষ্ঠানের শেষে আনন্দবাজারকে সত্যরূপ বললেন, ‘‘পাহাড়ই প্রথম আমাকে হাঁপানি সারানোর তাগিদ দিয়েছিল। অনুপ্রেরণা পেয়েছিলাম বিভূতিভুষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের চাঁদের পাহাড় পড়ে। সেখানেই প্রথম মাউন্ট কিলিমাঞ্জারো সম্পর্কে জানতে পারি। প্রতিজ্ঞা করি, এক দিন তার চূড়ায় পৌঁছতেই হবে।’’

সব শৃঙ্গের সেরা শৃঙ্গ এভারেস্ট জয়ও করে ফেলেছেন সত্যরূপ। ২০১০ সালে প্রথম বার মাউন্ট এভারেস্টের বেস ক্যাম্পে গিয়েছিলেন। ফিরে আসার সময় এভারেস্টের চূড়া দেখে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, খুব দ্রুত ফিরে আসবেন। বেশি দেরি করেননি। ২০১৬ সালের মধ্যেই বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গের চূড়ায় দাঁড়িয়ে ভারতীয় পতাকা হাতে তুলে কেঁদে ফেলেছিলেন। কারণ, কোনও রকমে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছিলেন। সেই ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সত্যরূপ বলছিলেন, ‘‘এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছনোর ঠিক আগে আমার অক্সিজেন সিলিন্ডার কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল। প্রায় আধ ঘণ্টা কোনও রকমে সহ্য করেছি। তখন কষ্টটা কিছু মনে হয়নি। কারণ এই শ্বাসকষ্ট নিয়েই তো এত দিন বেঁচেছি। সেটাই আমার জীবনে স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল।’’

কিন্তু এর থেকেও ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যে পড়েন ২০১৪ সালে উত্তর আমেরিকায় মাউন্ট ডেনালি পর্বত আরোহণের সময়। সত্যরূপের কথায়, ‘‘চারিদিকে জঙ্গল, তার মধ্যে বরফ। উচ্চতা ৬১৯০ মিটার। সেখানে উঠতে গিয়ে হঠাৎ পায়ের নীচের বরফে ঢাকা মাটি ভেঙে পড়ে খাদে। কোমরে দ়ড়ি থাকার জন্য কোনও রকমে ঝুলে থাকি। সকালে সূর্য ওঠার পরে আমাকে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখে সতীর্থরা উদ্ধার করে।’’

তাঁর লক্ষ্য শুধুমাত্র সাতটি সামিট (মহাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ) ও আগ্নেয় পর্বত পার করা নয়। সঙ্গে উত্তর মেরু ও দক্ষিণ মেরুতে স্কিইং করা। তা হলেই ‘এক্সপ্লোরার্স গ্র্যান্ড স্ল্যাম’ মুকুটটি বসবে মাথায়। বিশ্বে মাত্র ১৫ জনের আছে এই কৃতিত্ব। সত্যরূপ বলেন, ‘‘হাঁপানিকে হার মানিয়ে এত কিছু যখন করে ফেলেছি, তখন এটাও করে দেখাব। কিন্তু স্পনসর না পেলে কোনও স্বপ্নই পূরণ হবে না। এখনও ৪১ লক্ষ টাকার দেনা রয়েছে। তার মধ্যে এই স্বপ্নগুলো কী ভাবে পূরণ করব জানি না। আজ একটি বেসরকারি সংস্থা আমার পাশে দাঁড়িয়েছে। আমি চাইব আরও বেসরকারি সংস্থা আমাদের অভিযানকে যোগ্য মর্যাদা দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসুক।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement