নায়ক: হ্যাটট্রিকের হুঙ্কার ফ্রান গঞ্জালেসের (মাঝখানে)। শুক্রবার কল্যাণী স্টেডিয়ামে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
ফুটবল না বাস্কেটবল? শুক্রবার কল্যাণী স্টেডিয়ামে নেরোকা এফসির বিরুদ্ধে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকা স্কোরলাইন দেখে গুলিয়ে ফেলেছিলেন সমর্থকেরা।
অথচ ম্যাচ শুরুর আগে আবহ সম্পূর্ণ অন্য রকম ছিল। এক বছর আগে পুলওয়ামা কাণ্ডে নিহত জওয়ানদের শ্রদ্ধা জানাতে বিশেষ ‘টিফো’ নিয়ে মাঠে আসেন সমর্থকেরা। এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। সেই পরিবেশ বদলে গেল মোহনবাগানের দুরন্ত ফুটবলের সৌজন্যে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন— ‘‘আহা, আজি এ বসন্তে এত ফুল ফোটে/এত বাঁশি বাজে/এত পাখি গান গায়।’’ ফ্রান গঞ্জালেস, ফ্রান মোরান্তেরাও ফুল ফোটালেন। বসন্তের প্রথম বিকেলে নেরোকাকে গোলের মালা পরালেন। মোহনবাগান কোচ কিবু ভিকুনার প্রথাগত ছকের প্রতি আদৌ আস্থা নেই। তিনি চান, দলের আক্রমণে যেমন সকলে অংশ নেবেন, তেমনই বিপক্ষকে আটকাতে সবাই ঝাঁপাবেন। তাঁর দর্শন যে ফুটবলারদের ভাবনায় প্রভাব ফেলেছে, তা নওরেমদের খেলা থেকেই স্পষ্ট।
রক্ষণের অন্যতম ভরসা ড্যানিয়েল সাইরাস চোটে বাইরে। তাঁর জায়গায় কিবু মিডফিল্ডার ফ্রান গঞ্জালেসকে খেলাচ্ছেন ঠিকই। কিন্তু কেউ যদি প্রথমবার মোহনবাগানের খেলা দেখতে বসেন, বুঝতেই পারবেন না কে স্ট্রাইকার? কে মিডফিল্ডার? রক্ষণেই বা খেলছেন কে? বিপক্ষের ফুটবলারেরাও ধাঁধায় পড়ে যাচ্ছেন।
ম্যাচের ১১ মিনিটে বেইতিয়ার কর্নারে মাথা ছুঁইয়ে বল জালে জড়ান গঞ্জালেস। দু’মিনিটের মধ্যে ফের বেইতিয়া কর্নার তোলেন। কোমরন তুর্সুনভের ভলি গোলে ঢোকার আগে মাথা ছুঁইয়ে বলের গতিপথ বদলে ব্যবধান বাড়ান ডিফেন্ডার মোরান্তে। ২৪ মিনিটে বেইতিয়া-গঞ্জালেস যুগলবন্দিতে গোল। এর দু’মিনিটের মধ্যেই পেনাল্টি পেয়েছিল মোহনবাগান। কিন্তু গঞ্জালেসের শট আটকান নেরোকা গোলরক্ষক মার্ভিন ফিলিপ। যে ভাবে বারবার বিপক্ষের বক্সে হানা দিচ্ছিলেন গঞ্জালেস, মোরান্তেরা, তাতে তাঁদের স্ট্রাইকার বলে ভ্রম হতেই পারে।
৩৭ মিনিটে ৪-০ করলেন পাপা বাবাকর জিয়োহারা। ৪১ মিনিটে নেরোকার ফিলিপ আজা গোল করে ব্যবধান কমান। কিন্তু চার মিনিটের মধ্যেই হ্যাটট্রিক সম্পূর্ণ করলেন গঞ্জালেস। নেপথ্যে সেই বেইতিয়া। প্রথমার্ধের সংযুক্ত সময়ে নেরোকার হয়ে গোল সুভাষ সিংহের। কিন্তু তত ক্ষণে ম্যাচের ভবিষ্যৎ লেখা হয়ে গিয়েছে। লাল কার্ড দেখে ধনচন্দ্র সিংহ বেরিয়ে যাওয়ার পরে শেষ তিরিশ মিনিট মোহনবাগান যে দশ জনে খেলছে, বুঝতে দেননি বেইতিয়ারা। ৬৯ মিনিটে নামা জেসুরাজের পায়ের প্রথম স্পর্শেই বল জড়িয়ে যায় জালে।
নেরোকার বিরুদ্ধে বেইতিয়া-গঞ্জালেস যুগলবন্দি, পাপার অনবদ্য গোল, শেখ সাহিল, সুহের ভি পি-র মতো তরুণদের লড়াইয়ের নেপথ্যে রয়েছে পরিকল্পনা ও অক্লান্ত অনুশীলন। এ দিন ছ’টি গোলের মধ্যে পাঁচটিই সেট-পিস থেকে। প্রত্যেক দিন অনুশীলনে দীর্ঘ ক্ষণ সেট পিসের মহড়া দেন কিবু। তরুণ ফুটবলারদের আলাদা করে বিশেষ অনুশীলন করান। ১২ ম্যাচে ২৯ পয়েন্ট নিয়ে খেতাবি দৌড়ে অশ্বমেধের ঘোড়ার গতিতে ছুটে চলা মোহনবাগানের সাফল্যের নেপথ্যে আরও এক জন আছেন। তিনি, সহকারী কোচ রঞ্জন চৌধুরী। আই লিগে খেলা এগারোটি দলের সব ফুটবলারদের শক্তি ও দুর্বলতার যাবতীয় তথ্য তাঁর কাছে রয়েছে। ম্যাচের দু’তিন দিন আগে থেকেই কোচকে তিনি তা জানাতে থাকেন। কিবু অবশ্য যাবতীয় কৃতিত্ব ফুটবলারদেরই দেন। বলেন, ‘‘ফুটবলারেরাই সাফল্যের আসল কারিগর। আমরা শুধু সাহায্য করি।’’
মোহনবাগান কোচ সব ব্যাপারেই নির্লিপ্ত। ম্যাচের পরে ড্রেসিংরুমে যখন ভ্যালেন্টাইন্স ডে উপলক্ষে ফুটবলারদের স্ত্রী ও বান্ধবীদের ভিডিয়ো বার্তা স্ক্রিনে দেখানো হচ্ছিল, চুপ করে বসেছিলেন তিনি। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আগাম উৎসব শুরু করে দিয়েছেন সমর্থকেরা। কিবুর তাতেও উৎসাহ নেই। তাঁর পাখির চোখ চার্চিল ব্রাদার্স ম্যাচ। শুক্রবার ম্যান অব দ্য ম্যাচ গঞ্জালেসকে পাশে বসিয়ে বললেন, ‘‘এখনও অনেক পয়েন্ট পেতে হবে। আরও উন্নতি করতে হবে।’’ হ্যাটট্রিকের নায়ক গঞ্জালেস ম্যাচের পরে দর্শকদের সঙ্গে উৎসবে গা ভাসালেও সাংবাদিক বৈঠকে উচ্ছ্বাসহীন। পুলওয়ামার শহিদদের জয় উৎসর্গ করে বললেন, ‘‘হ্যাটট্রিক করে দারুণ খুশি। ভ্যালেন্টাইন্স ডে উপলক্ষে ড্রেসিংরুমে আমাদের ভিডিয়ো দেখানো হয়েছে। এই হ্যাটট্রিকটা বান্ধবীকেই উৎসর্গ করছি।’’
চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আগে উৎসব থেকে দূরে থাকাই যেন মন্ত্র কিবু-বাহিনীর।
মোহনবাগান: শঙ্কর রায়, আশুতোষ মেহতা, ফ্রান মোরান্তে, ফ্রান গঞ্জালেস, ধনচন্দ্র সিংহ, সুহের ভি পি (ব্রিটো), জোসেবা বেইতিয়া, শেখ সাহিল, নংদম্বা নওরেম (রোমারিয়ো জেসুরাজ, কোমরন তুর্সুনভ (গুরজিন্দর সিংহ) ও পাপা বাবাকর জিয়োহারা।