বিরাট কোহলি (বাঁ দিকে) ও রোহিত শর্মা। —ফাইল চিত্র।
আর কত দিন খেলবেন বিরাট কোহলি ও রোহিত শর্মা? সমালোচনা প্রবল হচ্ছে। অনেকেই দুই ক্রিকেটারকে এ বার সরে দাঁড়াতে বলছেন। কিন্তু তাঁদের অভাব মেটানোর মতো ক্রিকেটার কি রয়েছে ভারতীয় দলে? তাঁদের জুতোয় পা গলাবেন কারা?
ভারতীয় দলে ২০০৮ সাল থেকে খেলছেন কোহলি। এই ১৭ বছরে ভারতের হয়ে ১২৩টি টেস্ট, ২৯৫টি এক দিনের ম্যাচ ও ১২৫টি টি-টোয়েন্টি খেলেছেন কোহলি। তিন ফরম্যাট মিলিয়ে ৫৪৩টি আন্তর্জাতিক ম্যাচে মোট ২৭,৩২৪ রান করেছেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কোহলির শতরানের সংখ্যা ৮১। সচিন তেন্ডুলকরের পরে সর্বাধিক। এক সময় তিনটি ফরম্যাটেই ৫০-এর উপর গড় ছিল তাঁর।
টেস্টে ততটা না হলেও সাদা বলের ক্রিকেটে রোহিতের রেকর্ডও ঈর্ষনীয়। কোহলির থেকে এক বছর আগে অভিষেক হয়েছিল তাঁর। ১৮ বছরের কেরিয়ারে দেশের হয়ে ৬৭টি টেস্ট, ২৬৫টি এক দিন ও ১৫৯টি টি-টোয়েন্টি খেলেছেন তিনি। তিন ফরম্যাট মিলিয়ে ৪৯১টি আন্তর্জাতিক ম্যাচে মোট ১৯,৩৯৮ রান করেছেন তিনি। মোট ৪৫টি শতরান। রোহিতই একমাত্র ক্রিকেটার যাঁর এক দিনের ক্রিকেটে তিনটি দ্বিশতরান রয়েছে। সর্বাধিক ২৬৪ রানও তাঁর দখলে। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে সর্বোচ্চ রান তাঁর। দেশকে গত বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপও জিতিয়েছেন অধিনায়ক রোহিত।
দুই ক্রিকেটারের পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে, তাঁদের অভাব মেটানো কঠিন। তবে অসম্ভব নয়। তার প্রধান কারণ, ভারতের ক্রিকেটের পরিকাঠামো। দীর্ঘ দিন ধরে একটি নির্দিষ্ট সিস্টেমে ক্রিকেটার উঠে আসছেন। ঘরোয়া ক্রিকেটে ভাল খেললে সেখান থেকে জাতীয় দলে সুযোগ পান ক্রিকেটারেরা। পাশাপাশি আইপিএলের মতো প্রতিযোগিতাও রয়েছে। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি হওয়ার পরে ঘরোয়া ক্রিকেটে জোর দিয়েছিলেন। সৌরভ চলে গেলেও সেই প্রথা থেকে গিয়েছে। নির্বাচক প্রধান অজিত আগরকর, প্রধান কোচ গৌতম গম্ভীর প্রত্যেকে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলার দিকে নজর দিচ্ছেন। তাই ক্রিকেটার উঠে আসার পথ বন্ধ হবে না ভারতীয় ক্রিকেটে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ক্রিকেটার হলেই কি কোহলি, রোহিতের মতো হওয়া সম্ভব? তাঁদের ‘জেনারেশনাল ক্রিকেটার’ বলা হয়। অর্থাৎ, যে ক্রিকেটার কয়েক বছর নয়, প্রজন্ম ধরে খেলছেন। কয়েক প্রজন্মকে উৎসাহিত করেছেন। দীর্ঘ দিন ভারতীয় ক্রিকেটকে সাফল্য এনে দিয়েছেন। টানা ১৭ বা ১৮ বছর ধরে খেলছেন তাঁরা। এত বছর ধরে খেলা মুখের কথা নয়। এখন যাঁরা তরুণ ক্রিকেটার, তাঁরা কি তত বছর ধরে একটানা খেলতে পারবেন? সেই প্রশ্ন উঠছে।
ভারতীয় দলের দিকে তাকালে দুই ক্রিকেটারের দিকে সকলের আগে নজর যায়। এক জন শুভমন গিল। দ্বিতীয় জন যশস্বী জয়সওয়াল। শুভমন ভারতীয় দলে নিজের জায়গা পাকা করার পরে তাঁকে কোহলির বিকল্প হিসাবে ধরা হচ্ছিল। তার কয়েকটি কারণ রয়েছে। শুভমনও কোহলির মতো টপ অর্ডারে খেলেন। তাঁদের খেলার ধরন অনেকটা একই। কভার ড্রাইভে সাদৃশ্য রয়েছে। কোহলিকে যেমন অনেক অল্পবয়স থেকেই ভারতের অধিনায়ক ধরা হচ্ছিল, শুভমনকেও তাই। একটা সময় তিন ফরম্যাটেই জায়গা পাকা ছিল এই ডানহাতি ব্যাটারের। কিন্তু সময় বদলেছে। দিন দিন খারাপ হচ্ছে শুভমনের খেলা। ধারাবাহিকতা নেই। অফ স্টাম্পের বাইরের বলে কোহলির মতোই তাঁর দুর্বলতা রয়েছে। শুভমন দেশের মাটিতে ভাল খেলেন। কিন্তু বিদেশে গাব্বায় ৯১ রান ছাড়া মনে রাখার মতো ইনিংস খেলতে পারেননি তিনি।
যশস্বী অবশ্য দিন দিন পরিণত হচ্ছেন। তিনি দলে ঢুকেই ওপেনার হিসাবে শুভমনের জায়গা নিজের করে নিয়েছেন। তিন ফরম্যাটেই ভারতের প্রথম পছন্দ হয়ে উঠেছেন। তাঁর খেলার ধরন আক্রমণাত্মক। তবে প্রয়োজনে পরিস্থিতি বুঝেও যে যশস্বী খেলতে পারেন তা সদ্যসমাপ্ত বর্ডার-গাওস্কর সিরিজ়ে দেখা দিয়েছে। প্রথম বার অস্ট্রেলিয়ায় খেলতে গিয়ে ভারতের হয়ে সর্বোচ্চ রান করেছেন তিনি। রোহিতের বিকল্প হিসাবে যশস্বীকে ভাবা হচ্ছে। বিদেশের মাটিতে রোহিতের থেকেও ভাল রেকর্ড তাঁর। তবে যশস্বীর কেরিয়ার সবে শুরু। রোহিতের জুতোয় পা গলাতে হলে আরও অনেক বছর একই রকম ধারাবাহিকতা দেখাতে হবে তাঁকে।
ভারতীয় ক্রিকেট একটা বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এই দৃশ্য আগেও দেখা গিয়েছে। যখন সচিন, সৌরভ, রাহুল দ্রাবিড়েরা অবসর নিয়েছিলেন, তখনও ভারতের ব্যাটিং অর্ডার নতুন করে সাজাতে হয়েছিল। সেই সময়ই কোহলি, রোহিতদের পদার্পণ। কোহলি কিন্তু সচিনের অভাব পূরণ করেছেন। দলকে ভরসা দিয়েছেন। বাকিদের অভাবও পূরণ হয়েছে। গত বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতে কুড়ি-বিশের ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়েছেন রোহিত, কোহলি। সেখানে তাঁদের অভাব মেটানো কঠিন নয়। কারণ, ছোট ফরম্যাটে এখন ভারতীয় দলে প্রচুর ক্রিকেটার। আইপিএল এই সুবিধা করে দিয়েছে। কিন্তু বড় ফরম্যাটে? এক দিন ও টেস্ট ক্রিকেটে কি রোহিত, কোহলির অবাব আদৌ মেটানো যাবে?
ইতিবাচক কথা বলেছেন অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন ক্রিকেটার ড্যারেন লেম্যান। দু’টি বিশ্বকাপজয়ী এই অলরাউন্ডারের মতে, কারও জন্য কিছু থেমে থাকে না। কেউ জায়গা ছেড়ে দিলে সেই জায়গা ভরাট হবেই। বিশেষ করে ভারতীয় ক্রিকেটে কোনও সমস্যা হওয়া উচিত নয় বলেই মত লেম্যানের। তিনি বলেন, “ভারতীয় ক্রিকেটে গত কয়েক বছরে প্রচুর নতুন ক্রিকেটার এসেছে। তারা যথেষ্ট প্রতিভাবান। ভারতীয় ক্রিকেটে এখন অনেক বিকল্প। তাই আমার মনে হয় না রোহিত, কোহলির অভাব মেটাতে সমস্যা হবে।”
এই রকম সুযোগই তো একজন তারকা তৈরি করে। দায়িত্ব পেলে তবেই তো ভরসার দাম দেওয়া যায়। সেই সুযোগটা নতুনদের দিতে হবে, এমনটাই মনে করেন লেম্যান। তিনি বলেন, “সচিন অবসর নেওয়ার পর কোহলির কাঁধে সেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বলেই তো ও করে দেখিয়েছে। নতুনদেরও সেই দায়িত্ব দিতে হবে। সময় দিতে হবে। আমি বলছি না, রোহিত, কোহলির মতো সাফল্য বাকিরাও তাড়াতাড়ি পাবে। কিন্তু ওদের উপর ভরসা রাখতে হবে। যশস্বী, শুভমনদের নিয়ে আমি আশাবাদী।”
২০২৪ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতলেও গত কয়েক বছরে ব্যাট হাতে ফর্মে নেই রোহিত, কোহলি। বর্ডার-গাওস্কর সিরিজ়ে সেটা আরও ভাল ভাবে চোখে পড়েছে। কোনও কোনও সময় তাঁদের দলের বোঝা বলে মনে হচ্ছে। এখনই তাঁদের অবসর নেওয়া উচিত, এমন দাবিও শোনা গিয়েছে। দুই ক্রিকেটার অবশ্য অবসর নিয়ে কোনও আগ্রহ দেখাননি। বরং তাঁদের দেখে মনে হয়েছে, আরও কয়েক বছর খেলতে চান। দুই ক্রিকেটারেরই বয়স হয়েছে। এখন না- হলেও কয়েক বছরের মধ্যে অবসর তাঁদের নিতেই হবে। তখন তাঁদের অভাব কি যশস্বী, শুভমনেরা পূরণ করতে পারবেন? দায়িত্ব কঠিন। চ্যালেঞ্জও কঠিন। অবশ্য কঠিন চ্যালেঞ্জই তো ক্রিকেটার তৈরি করে। ভারতীয় ক্রিকেট তা বার বার দেখেছে। আরও এক বার কি সেই ছবি দেখা যাবে?