ইতিহাসের অপেক্ষায়। শুক্রবার ইস্টবেঙ্গল প্র্যাকটিসে র্যান্টি মার্টিন্স। ছবি: উৎপল সরকার।
দু’হাত শূন্যে ছুড়ে গ্যালারির দিকে উর্ধ্বশ্বাস দৌড় র্যান্টি মার্টিন্সের। জাতীয় লিগ তথা আই লিগ ইতিহাসে গোলের ‘ডাবল সেঞ্চুরি’ করার উৎসব।
কিন্তু হাতহালি কোথায়...!
মুম্বই এফসিকে হারিয়ে আই লিগে জয়ের ‘ডাবল সেঞ্চুরি’ করে ফেলল ইস্টবেঙ্গল।
কিন্তু হাততালি কোথায়...!
উপরের দু’টো ঘটনাতেই পাঠকের চমকে ওঠার দরকার নেই। শুক্রবার র্যান্টির ইস্টবেঙ্গল কোনও ম্যাচ খেলেনি।
কিন্তু শনিবার যুবভারতীতে দু’টো দৃশ্যই দেখা যেতে পারে। র্যান্টি আর ইস্টবেঙ্গল, দু’জনই ‘ডাবল সেঞ্চুরি’র মাইলফলক ছুঁতেই পারে। কিন্তু সেই ঐতিহাসিক মাহেন্দ্রক্ষণের কোনও সাক্ষী থাকবে না দানবাকার যুবভারতীর গ্যালারিতে! লাল-হলুদ সমর্থকদের উৎসব হবে না। জয়ধ্বনি উঠবে না ইস্টবেঙ্গলের নামে। র্যান্টির সমর্থনে স্লোগান শোনা যাবে না।
কেন? ১৯৯ আই লিগ গোল করা র্যান্টি আর ১৯৯ আই লিগ ম্যাচ জেতা ইস্টবেঙ্গল যে শনিবার ঘরের মাঠে খেলতে নামছে কলকাতা পুরভোটের দিনে! যার ধাক্কায় লাল-হলুদকে এমন সম্ভাব্য ঐতিহাসিক ম্যাচও খেলতে হবে পুলিিশ ফতোয়ায় সম্পূর্ণ ফাঁকা গ্যালারির সামনে!
হয়তো সেই যন্ত্রণাতেই এ দিন বিকেলে প্র্যাকটিসের পরে র্যান্টি বললেন, ‘‘কালও গোল করতে চাই। তবে এটা ভেবে এখনই খুব খারাপ লাগছে যে, সেই গোলের কোনও মর্যাদা থাকবে না। মাইলস্টোন ছুঁতে পারলে সবারই ভাল লাগে। কিন্তু সেটা ফাঁকা গ্যালারির সামনে ঘটলে মন খুলে উৎসব করতে পারব কি!’’
মাইলফলকের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কাউকে এত বিষণ্ণ মুখে আগে সম্ভবত দেখা যায়নি। শুধুই কী র্যান্টি? আই লিগে নতুন অক্সিজেন পেয়ে যাওয়া গোটা লাল-হলুদ শিবিরেও যেন একটা বিষণ্ণতার ছায়া। টুর্নামেন্টে সম্ভাব্য জয়ের হ্যাটট্রিকের সামনে দাঁড়িয়েও। অধিনায়ক হরমনজ্যোৎ সিংহ খাবরা বলছিলেন, ‘‘আমার ক্যাপ্টেন্সিতে যদি আই লিগে দু’শো ম্যাচ জেতে ইস্টবেঙ্গল, তা হলে সেটা আমার জীবনের একটা বড় প্রাপ্তি হবে। কিন্তু এটাও ভাবছি, তার পরে মাঠে উৎসবটা করব কাদের সঙ্গে। সমর্থকরাই তো সব।’’
ইস্টবেঙ্গল ফুটবলারদের কথা শুনে মনে হতেই পারে, শনিবারের ম্যাচে তাদের বিপক্ষ মুম্বই এফসির চেয়েও বেশি—যুবভারতীর গ্যালারি। যে নজিরহীন বোঝা পরের দু’টো ম্যাচেও বইতে হবে লাল-হলুদকে। যেটা ভাল খেলা আর সহজে জেতার সামনে যে অবশ্যই একটা ভাল রকমের মানসিক চাপ, লিখতে দ্বিধা নেই। এ রকম পরিস্থিতিতে ফুটবলাররা কী ভাবে নিজেদের মোটিভেট করতে পারেন?
ভাইচুং ভুটিয়া বললেন, ‘‘মাত্র কুড়ি-তিরিশ জন দর্শকের সামনে খেলার অভিজ্ঞতা আমার আছে। কিন্তু একেবারে ফাঁকা স্টেডিয়ামে কখনও খেলিনি। যে কোনও স্পোর্টসম্যানের আসল মনোবল হল সমর্থকরা। ওরা না থাকলে ফোকাস পুরোপুরি ধরে রাখা সত্যিই কঠিন। এক-এক সময় মনে হতেই পারে, দুর! কার জন্য খেলব। এখানেই টিমকে তাতিয়ে রাখাটা কোচের কাছে পরীক্ষা।’’
ইস্টবেঙ্গল কোচ এলকো সতৌরি অবশ্য আগাম সতর্ক। ড্রেসিংরুমে তো বটেই, প্র্যাকটিসেও ফুটবলারদের ‘ভোকাল টনিক’ দিয়ে চলেছেন ডাচ কোচ। যার মর্মার্থ— ‘‘যার উপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই, সেটা নিয়ে চিন্তা করেও লাভ নেই। তার বদলে নিজেদের খেলায় আরও বেশি করে মনোযোগ দিলে টিমেরই ভাল।’’ এলকোর বরং চিন্তা তাঁর গোলকিপার নিয়ে। কুঁচকির চোটে মুম্বই ম্যাচে নেই অভিজিৎ মণ্ডল। তাঁর বদলে লাল-হলুদের শনিবার শেষ প্রহরী লুই ব্যারেটো। বাকি দশ জন আগের পুণে ম্যাচেরই থাকছেন। পাশপাশি তিন দিন আগেই এএফসি কাপে যে স্বদেশি-ব্রিগেড খেলেছিল, তার বেশ কয়েক জন ফুটবলার শনিবারও রিজার্ভ বেঞ্চে থাকবেন।
ইস্টবেঙ্গলই একা নয়। ফাঁকা গ্যালারিতে খেলতে হবে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীকেও। তবে লিগ টেবলে শেষের সরণিতে থাকা মুম্বইয়ের আসল সমস্যা অন্যত্র— চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে এক জোড়া বড় ধাক্কা খেয়েছে তারা।
কোচ আর অধিনায়ক দু’জনই নির্বাসিত। শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে খালিদ জামিল চার ম্যাচ। ডোপিংয়ের দায়ে ডেন পেরেরা অনির্দিষ্টকাল। সঙ্গে যোগ করুন, শেষ ছয় ম্যাচে জয়হীন তারা। তা সত্ত্বেও এই ইস্টবেঙ্গলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ফুটবলার মেহতাব বলছিলেন, ‘‘ইস্টবেঙ্গলকে দেখলেই কিন্তু অন্য টিমগুলো আরও বেশি তেতে যায়।’’
তবু মেহতাব যাই বলুন, তাঁর টিমের মার্কি ফুটবলার লিও বার্তোসও সম্প্রতি নিজের জাত চেনাতে ফের শুরু করে দিয়েছেন। কিছু দিন গোল-খরায় ভোগা ডুডুও শেষ দু’ম্যাচে তিন গোল করে বসে আছেন। কোচ এলকো নাকি মুম্বই ড্রেসিংরুমের অস্থিরতাকেই মাঠে নিজের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছেন।
তাই র্যান্টির ইস্টবেঙ্গলের জোড়া মাইলফলক ছোঁয়ার সম্ভাবনা শনিবার যতটা সহজ, ততটাই বোধহয় কঠিন লাল-হলুদের ফাঁকা গ্যালারির বিষণ্ণতা সামলানো!
শনিবার আই লিগে
ইস্টবেঙ্গল : মুম্বই এফসি (যুবভারতী, বিকেল ৪-৩০)
মোহনবাগান : রয়্যাল ওয়াহিংডো (শিলং, বিকেল ৪-৩০)