নবদম্পতি। শান্তিপুরে। নিজস্ব চিত্র।
বৌভাতের পর দিনই নতুন বৌ কিনা বলছেন, “মোহনবাগানের লোকগুলোই আসলে এমন। সবেতেই লেগ-পুল করা স্বভাব।” তার পর কিছুটা শাসানির ভঙ্গিতে বলেন,“সময় আমারও আসবে। সে দিন দেখে নেব!” পাশেই বসে নতুন বর তখন মিটিমিটি হাসছেন। যিনি কিনা কট্টর মোহনবাগান সমর্থক। শান্ত গলায় মুচকি হেসে তিনি বলছেন, “সে সময় কি আদৌ কোনও দিন আসবে?” উত্তরে কপট রাগ দেখিয়ে ইস্টবেঙ্গল সমর্থক নববধূ বলছেন,“সে দেখা যাবে। সে দিন সামলে নিয়ো।”
যুযুধান দুই পক্ষের এ হেন কাণ্ড দেখে হেসে ফেলেন পরিবারের অন্যরা। বলে ওঠেন,“থাম বাবা। এ বার তোরা একটু রেহাই দে আমাদের। আর নেওয়া যাচ্ছে না তোদের ঝগড়া!”
তবে এই ঝগড়া আজকের নয়। প্রায় বারো বছর ধরে চলে আসছে। ইস্টবেঙ্গল বা মোহনবাগানের খেলা থাকলে সেটা আরও বেড়ে যায়। আর ডার্বি ম্যাচ থাকলে তো কথাই নেই। কারণ, বিয়ের কনে কৃষ্ণনগরের পাশের দেপাড়ার বাসিন্দা প্রিয়াঙ্কা বিশ্বাস ও তাঁর পরিবার মনেপ্রাণে ইস্টবেঙ্গল সমর্থক। উল্টো দিকে পাত্র রথীক বিশ্বাসের পরিবারের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে মোহনবাগান। দুই ভিন্ন ক্লাবের সমর্থক বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হয়েছেন ঠিকই কিন্তু সেই বারো বছর ধরে চলে আসা গন্ডগোল কি এত সহজে মেটে?
বিতর্কের শুরু কনেপক্ষের হাত ধরেই। মোহনবাগানি বরযাত্রীদের পাতে তুলে দিয়েছিল ইলিশ মাছ। নেহাতই বিয়ের অনুষ্ঠান। তাই কেউ কিছু বলেননি। শুধু কি তাই? মণ্ডপ থেকে শুরু করে কনের শাড়ি পর্যন্ত লাল-হলুদ। বাড়ির বড়রা গজগজ করতে করতে বলেছিলেন, “মুখের উপরে জবাবটা কিন্তু দেওয়া চাই।” যেমন ভাবনা, তেমনই কাজ। পাত্রপক্ষের বিয়েবাড়ির প্রধান গেট করা হল সবুজ-মেরুন কাপড় দিয়ে। তার উপরে মোহনবাগানের লোগো-নৌকা। ঢুকতেই মোহনবাগানের জার্সি পরে এক মাটির মডেলের হাতে ট্রফি। ইস্টবেঙ্গল সমর্থক কন্যাযাত্রীদের প্রথম স্বাগত জানাচ্ছে সেই। কোনও মতে সেই ধাক্কা সামলে ভিতরে ঢুকে বাড়ির মেয়ের কাছে যেতেই আবার ধাক্কা। কনের বসার জায়গার মাথার উপরে মোহনবাগানের লোগো। খাবার জায়গাতেও শান্তি নেই। সেখানেও সবুজ-মেরুন রঙে মুড়ে দেওয়া হয়েছে। খাবারের টেবিলে মেনু কার্ডটা পর্যন্ত কিনা সেই সবুজ মেরুন, সঙ্গে নৌকার লোগো। মানা যায়? তবে হ্যাঁ, পাতে পালটা চিংড়ি পড়েনি। প্রসঙ্গটা তুলতেই নতুন বর রথীক একটু যেন বিষণ্ণ হয়ে পড়েন, “খুব ইচ্ছে ছিল জানেন। কিন্তু একটা সমস্যার কারণে শেষ পর্যন্ত চিংড়িটা করে উঠতে পারলাম না।” বলেই নতুন বৌয়ের দিকে মুচকি হাসেন তিনি।
সম্পর্কের শুরু আট বছর আগে। তাঁরা দু'জনেই টিউশন নিতে যেতেন কৃষ্ণনগরের এক ইতিহাসের শিক্ষকের কাছে। সেখানেই আলাপ। প্রেম। দেখতে দেখতে পরিচয়ের বারো বছর পেরিয়ে গিয়েছে। কোনও দিন সমস্যা হয়নি। তবে ব্যতিক্রম একটাই, ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান। ডার্বির আগে তো প্রায় মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে থাকে। যার দল হারবে তার হেনস্থার শেষ নেই অন্য জনের কাছে। ‘অশান্তি’ চলে টানা বেশ কয়েক দিন।
ছাত্র জীবন পার করে এখন দু'জনই প্রতিষ্ঠিত। প্রিয়াঙ্কা কৃষ্ণনগর গভর্নমেন্ট কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপিকা আর রথীক বিশ্বাস এখন দক্ষিণ ২৪ পরগনার বারুইপুর আমঘড়া কালীকৃষ্ণ বিদ্যাপিঠের ইতিহাসের শিক্ষক। তবে প্রিয় ফুটবল দল নিয়ে আবেগ এতটুকু কমেনি। প্রিয়াঙ্কা বলেন, “বাই হার্ট আমি ইস্টবেঙ্গল। নো কমপ্রোমাইজ।” আর তাই নতুন শ্বশুর বাড়িতে এসে সমস্ত আবদার মুখ বুজে মেনে নিলেও একটা বিষয়ে তিনি 'না' বলে দিয়েছিলেন। কিছুতেই বরের সঙ্গে ‘ম্যাচিং’ করে সবুজ মেরুন রঙের শাড়ি পরানো যায়নি তাঁকে।
এ সব শুনে ‘শান্তিপুর মেরিনার্স’-এর সম্পাদক প্রবীর গোমস বলছেন, “মাঠের লড়াইটা নব্বই মিনিটের। তার বাইরে আমরা তো পরিবারই একটা। ইস্টবেঙ্গল পরিবারের মেয়ে মোহনবাগানের বাড়িতে ভাল থাকবে। ওঁদের জন্য শুভেচ্ছা রইল।”
আর ‘গর্ব আমার লাল হলুদ’-এর সম্পাদক বান্টি বসু বলছেন, “পাত্রী এবং তাঁর পরিবার যেহেতু ইস্টবেঙ্গল সমর্থক, তাই একটা কথা বলতে পারি। পাত্র বার বার শ্বশুরবাড়ি যেতে চাইবেন ইলিশের সুস্বাদু পদের জন্য। মাঠের লড়াইটা মাঠেই থাকুক।”
আর দিনের শেষে সব রং এসে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে নতুন বর-বউয়েরমুখের হাসিতে।