ইউএস ওপেনে হাতকাটা পোশাকে টিয়াফো (বাঁ দিকে) ও আলকারাজ়। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
২০১৯ সালের ইউএস ওপেন ফাইনাল। ড্যানিল মেদভেদেভকে পাঁচ সেটের লড়াইয়ে হারিয়েছিলেন রাফায়েল নাদাল। রাফার খেলার পাশাপাশি আরও একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। তাঁর পোশাক নিয়ে। কালো রঙের একটি হাতকাটা (স্লিভলেস) টি-শার্ট পরে খেলতে নেমেছিলেন রাফা। শুধু সে বারই নয়, নিজের কেরিয়ারে বহু গ্র্যান্ড স্ল্যাম তিনি জিতেছেন হাতকাটা টি-শার্ট পরে। তাঁর পেশি দেখে কিছুটা হলেও কি ভয় পেতেন প্রতিপক্ষেরা? মানসিক ভাবে কি খানিকটা এগিয়ে নামতেন নাদাল? সে তর্ক চলতেই পারে। তবে এ বারের ইউএস ওপেন সব কিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছে। কোয়ার্টার ফাইনালের আট প্রতিযোগীর মধ্যে তিন জনকে দেখা যাচ্ছে হাতকাটা পোশাকে। ম্যাচ শেষে পেশি ফুলিয়ে উল্লাস করছেন তাঁরা। তবে কি টেনিসের পাশাপাশি পেশির প্রদর্শন চলছে ইউএস ওপেনে? দেখে তো খানিকটা সে রকমই লাগছে।
এ বারের ইউএস ওপেনে কার্লোস আলকারাজ়, ফ্রান্সিস টিয়াফো ও বেন শেল্টনকে দেখা যাচ্ছে হাতকাটা টি-শার্টে। আমেরিকার দুই টেনিস প্রতিযোগী টিয়াফো ও শেল্টন পেশির লড়াইয়ে একে অপরকে টক্কর দিচ্ছেন। খেলাতেও দেখা যাচ্ছে শক্তির লড়াই। দু’হাতে দুরন্ত গতিতে ব্যাকহ্যান্ড মারছেন টিয়াফো। আবার ঘণ্টায় ২৩৯ কিলোমিটার গতিবেগে সার্ভিস করছেন ৬ ফুট ৪ ইঞ্চির শেল্টন। খেলা শুরুর আগে নিজের বাইসেপ দেখিয়েছেন ২৫ বছরের টিয়াফো। আবার চার সেটের লড়াইয়ে দশম বাছাইকে হারিয়ে পেশি ফোলাতে দেখা গিয়েছে শেল্টনকে। তাঁরা বুঝিয়ে দিচ্ছেন, কেউ কারও থেকে কম যান না।
টিয়াফো ও শেল্টনকেও ছাপিয়ে গিয়েছেন আলকারাজ়। তাঁর শক্তিশালী ফোরহ্যান্ড সমস্যায় ফেলেছে নোভাক জোকোভিচের মতো তারকাকে। ২৩ গ্র্যান্ড স্ল্যামের মালিক স্বীকার করে নিয়েছেন, তিনি এখনও পর্যন্ত যাঁদের বিরুদ্ধে খেলেছেন, তাঁদের মধ্যে সব থেকে কঠিন প্রতিপক্ষ ২০ বছরের স্প্যানিশ। আলকারাজ়ের এই পাওয়ার-টেনিসের উৎস তো সেই পেশি। দেখে মনে হচ্ছে, যেন জিম থেকে শরীরচর্চা করে সরাসরি কোর্টে নেমে পড়েছেন তাঁরা।
আগে কিন্তু ছবিটা এ রকম ছিল না। রজার ফেডেরার বা পিট সাম্প্রাসদের কেউ কোনও দিন পেশি প্রদর্শন করতে দেখেননি। হাফহাতা টি-শার্টেই চিরকাল খেলেছেন। তাঁরা কি জিম করতেন না? অবশ্যই করতেন। ফিট ছিলেন না? অবশ্যই ছিলেন। নইলে এত বছর ধরে একটানা টেনিসের শীর্ষে থাকতে পারতেন না তাঁরা। সময়ের সঙ্গে অন্য সব কিছুর মতো বিবর্তন হয়েছে টেনিসের। খেলার পাশাপাশি বদলে গিয়েছে খেলোয়াড়দের মানসিকতাও।
লন্ডনের টেনিস ম্যাগাজিন ‘ব্যাগেল’-এর সম্পাদক স্টুয়ার্ট ব্রামফিট জানিয়েছেন, দেখে মনে হচ্ছে বাস্কেটবল খেলোয়াড়েরা টেনিস খেলতে নেমে পড়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘এখনকার টেনিস খেলোয়াড়েরা অনেক বেশি শরীরচর্চা করে। তারা জিমে সময় কাটায় বেশি। তার ফলে তাদের পেশি আগের খেলোয়াড়দের থেকে বেশি। আর সেই পেশির প্রদর্শন করতে পিছপা হয় না তারা।’’
টিয়াফো সেই সময় থেকে নিজের পেশি প্রদর্শন করছেন, যখন তিনি হাফহাতা টি-শার্ট পরতেন। ২০২১ সালের উইম্বলডনে স্তেফানোস চিচিপাসকে হারিয়ে টি-শার্টের হাতা গুটিয়ে বাইসেপ ফুলিয়ে দেখিয়েছিলেন টিয়াফো। দেখে মনে হয়েছিল, হলিউডের বিখ্যাত ‘রকি’ ছবি থেকে উঠে এসেছেন সিলভেস্টার স্ট্যালোন। কাকতালীয় ভাবে ‘রকি’ আলাকারাজ়ের সব থেকে প্রিয় ছবি। প্রতি ম্যাচের আগে তিনি স্ট্যালোনের ছবি দেখে নিজেকে তাতান।
চলতি ইউএস ওপেনে খেলার বিশ্লেষণের পাশাপাশি বার বার ধারাভাষ্যকারদের মুখে এসেছে হাতকাটা টি-শার্টের প্রসঙ্গ। এমনকি সাক্ষাৎকারেও এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়েছে অন্য খেলোয়াড়দের। তাঁরাও মজার মজার উত্তর দিয়েছেন। টিয়াফো ও শেল্টনের দেশের কোকো গফ যেমন বলেন, ‘‘টিয়াফোর মন একটু খারাপ। কারণ, আমি ওকে বলেছি, তোমার থেকে শেল্টনের পোশাক বেশি সুন্দর। আলাকারাজ়কেও বেশ ভাল লাগছে।’’
টিয়াফো, আলকারাজ়দের পোশাকের রং ও ডিজ়াইনেও রয়েছে বৈচিত্র। আলকারাজ় পরেন নাইকির পোশাক। সেখানে খোপ খোপ ডিজ়াইন করা। গত বারের ইউএস ওপেনে কমলা রঙের টি-শার্ট পরেছিলেন তিনি। এ বার রং ও ডিজ়াইন বদলেছে। টিয়াফোও নাইকির পোশাক পরেন। সেখানে নীল ও কমলার আধিক্য বেশি। শেল্টনের পোশাকে অবশ্য একটাই রং।
পেশি প্রদর্শনের পাশাপাশি এই টি-শার্ট পরে খেলার আরও একটি কারণ রয়েছে। তা হল আবহাওয়া। নিউ ইয়র্কের গরমে কোর্টে কাহিল হয়ে পড়ছেন খেলোয়াড়েরা। হাতকাটা পোশাক পরলে কিছুটা হলেও স্বস্তি পাচ্ছেন তাঁরা। চলতি ইউএস ওপেনে একটি সাংবাদিক বৈঠকে টিয়াফো বলেন, ‘‘যত হালকা থাকা যাবে তত ভাল। আমি তো প্রতিটা ম্যাচের জন্য অন্তত ২০টা টি-শার্ট নিয়ে যাচ্ছি। একটু ঘেমে গেলেই টি-শার্ট বদলে ফেলছি।’’
আলকারাজ়ের কাছে আবার হাতকাটা পোশাক পরার আর একটি কারণ নাদাল। গুরুর দেখানো পথে এগোতে চান তিনি। খানিকটা সংস্কারও কাজ করছে তাঁর মনে। আলকারাজ় বলেন, ‘‘রাফা হাতকাটা টি-শার্ট পরে ইউএস ওপেন জিতেছিল। তাই না।’’ হ্যাঁ, আগের জমানায় নাদাই প্রথম খেলোয়াড় যিনি হাতকাটা টি-শার্ট পরে বার বার ট্রফি জিতেছেন। ফরাসি ওপেনে লাল সুরকির কোর্টেও রাফাকে সে ভাবেই দেখা গিয়েছে। ২০০৫ থেকে ২০০৮, পোশাকের রং বদলেছে। কিন্তু ধরন বদলায়নি।
নাদালে অনুপ্রাণিত হয়ে ২০০৭ সালের ইউএস ওপেনে কার্লোস মোয়া, আমের ডেলিচ, ডিয়েগো হার্টফিল্ড, স্টেফান কৌবেক, রবি গিনেপ্রি, অ্যালেক্স কুজ়নেটসভদের দেখা গিয়েছিল হাতকাটা পোশাকে খেলতে। তবে সেই এক বারই। এখন সংখ্যাটা বাড়ছে। টেনিসের পাশাপাশি পেশির প্রদর্শন বাড়ছে। খেলার আগেই প্রতিপক্ষকে চাপে ফেলার নতুন কৌশল পেয়ে গিয়েছেন টিয়াফো, আলকারাজ়েরা। পয়েন্ট জিতে পেশি ফুলিয়ে তাঁরা সেটাই বুঝিয়ে দিচ্ছেন।
(ভ্রম সংশোধন: এই প্রতিবেদনের ছবিতে বাঁ দিকে রয়েছেন ফ্রান্সিস টিয়াফো ও ডান দিকে কার্লোস আলকারাজ়। প্রথমে আলকারাজ়ের জায়গায় ছবির বিবরণে রাফায়েল নাদালের নাম লেখা হয়েছিল। এই অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য আমরা আন্তরিক ভাবে দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী।)