প্যারিস অলিম্পিক্সে ভারতকে প্রথম পদক দিলেন মনু ভাকের। ছবি: সংগৃহীত।
আচ্ছা প্যারিসকে ‘সিটি অব লাইট্স’ বলা হয় না?
কে জানত, প্যারিস অলিম্পিক্সও অন্ধকার ঘুচিয়ে আলোয় ভরিয়ে তুলবে এক ভারতীয় শুটারকে। যিনি চার বছর আগে টোকিয়োয় ব্যর্থতার বিষণ্ণতায় এতটাই মুষড়ে পড়েছিলেন যে, মনে হয়েছিল আর কি শুটিং রেঞ্জে কখনও ফিরতে পারবেন?
মনু ভাকের শুধু ফিরলেনই না, সারাজীবনের জন্য ভারতীয় খেলাধুলোর অন্যতম রূপকথা হিসেবে ফিরলেন। টোকিয়োয় পিস্তল বশ মানতে চায়নি। বিগড়ে গিয়ে তাঁর চোখের জল ফেলেছিল। প্রিয় হাতিয়ারই চার বছর পরে পরাজয়ের কান্না মুছে দিয়ে বিজয়ীর হাসি উপহার দিয়ে গেল।
২০২৪ অলিম্পিক্সে দেশকে প্রথম পদক দিলেন মনু। এমন একটা দিনে যখন তিরন্দাজিতে ফের হতাশা সঙ্গী হল। ব্রোঞ্জের লড়াই পর্যন্তও যেতে পারলেন না দীপিকা কুমারী-রা। টেনিসে হারলেন সুমিত নাগাল। উদ্বোধনে অন্যতম পতাকাবাহক শরৎ কমল বিস্ময়কর ভাবে হারলেন টেবল টেনিসে। বৃষ্টি থেমে প্যারিসের আকাশে যেমন রবিবার ঝলমলে রোদ উঠল, তেমনই ভারতীয় দলের মাথার উপরে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ কাটিয়ে দিলেন মনু। ১০ মিটার এয়ার পিস্তল ইভেন্টে ব্রোঞ্জ জিতলেন। ভাগ্য সামান্য সহায় থাকলে রুপোও জিততে পারতেন। রুপোজয়ী দক্ষিণ
কোরিয়ার ও ইয়ে জিনের চেয়ে তিনি পিছিয়ে ছিলেন মাত্র ০.১ পয়েন্টের ব্যবধানে। সোনা জিতলেন দক্ষিণ কোরিয়ার কিম ইয়েজি।
টোকিয়ো যাঁকে অন্ধকারে নিক্ষেপ করেছিল, তিনি কী ভাবে আলোয় ফিরলেন? পদক জেতার পরে মনু সাংবাদিকদের কাছে সেই রহস্য ফাঁস করেছেন। ভগবদ্গীতা। বদমেজাজি হিসেবে বদনাম হয়ে গিয়েছিল তাঁর। কোচ যশপাল রানার সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েন। তাঁর কোচিং থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। মাথা ঠান্ডা করতে সাহায্য করে গীতাপাঠ। আর সেই পরামর্শ কে দিয়েছিলেন? না, যশপাল রানা-ই। ‘‘স্যর আমাকে বলেছিলেন গীতা পড়ো। মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। মন, মেজাজকে বশে রাখতে হবে,’’ বলেছেন মনু। গীতার মন্ত্রেই অর্জুনের মতো লক্ষ্যভেদ করে গেলেন তিনি।
ব্রোঞ্জ নিয়ে উচ্ছ্বাস তারকা শুটারের। রবিবার। ছবি: সংগৃহীত।
গীতার সেই স্থিতধী মন। শুটারের আবশ্যিক ধর্ম। না হলে লক্ষ্যভেদ করবে কী ভাবে! ছাত্রীর পদক প্রাপ্তির দিনে গুরুর আবেগও বাঁধ মানল না। কেঁদে ফেললেন রানা। এক-এক সময় মনে হচ্ছে, শুধু মনু পদক জিতলেন না। তাঁর গুরুও জিতলেন। শুধু মনুর প্রত্যাবর্তন নয়। যশপাল রানারও ফিরে আসা।
যোগ্যতা অর্জনের পর্বে শনিবার তৃতীয় হয়ে ফাইনালে উঠেছিলেন মনু। রাতে ঘুম হয়েছিল? তাঁর জবাব, ‘‘আমি খুব বেশি চিন্তা করছিলাম না। শুধু একটাই কথা নিজেকে বলেছিলাম। নিজের সেরাটা দাও। ফিরে গিয়ে কখনও যেন আফসোস সঙ্গী না হয় যে, আর একটু চেষ্টা কেন করলাম না! তা হলে পদক জিতে ফিরতে পারতাম।’’ হতে পারে গীতার মন্ত্র আওড়াচ্ছিলেন গুলি ছোড়ার সময়। প্যারিস অলিম্পিক্সে প্রত্যেকটি পদকে আইফেল টাওয়ার থেকে সংগ্রহ করা লোহার অংশ থাকছে। প্রথম ভারতীয় হিসেবে সেই ঐতিহাসিক পদকে কামড় দিলেন মনু। গেমস ভিলেজে যা অন্য ভারতীয়দেরও উদ্বুদ্ধ করেতুলতেই পারে।
মনু ব্রোঞ্জ জেতার সঙ্গে সঙ্গেই নানা কীর্তি ঝকমক করতে থাকল। এই প্রথম কোনও ভারতীয় মহিলা শুটার পদক জিতলেন অলিম্পিক্সে। বারো বছর পরে কোনও শুটারের পদক। শেষবার লন্ডনে জিতেছিলেন গগন নারাং এবং বিজয় কুমার। এ বারে নারাং ভারতীয় দলের শ্যেফ দ্য মিশন হয়ে এসেছেন। এক-এক সময় আবার মনে হচ্ছে, এ সব পরিসংখ্যানের মধ্যে আজকের দিনটাকে আটকে রাখতে যাব কেন? কী সব আবেগের ছবি তোলা থাকল মনুকে ঘিরে। সেগুলোই তো আসল। কেউ পদক জিতছেন নিজের ইভেন্টের কিংবদন্তির সামনে— এমন দৃশ্য রোজরোজ দেখা যায় নাকি? ক’জনের এমন সৌভাগ্য হয়? রবিবার যেমন মনু যখন ব্রোঞ্জ জিতছেন, তখন শাতেরুর শুটিং রেঞ্জে উপস্থিত অভিনব বিন্দ্রা। অলিম্পিক্সের ইতিহাসে প্রথম সোনাজয়ী ভারতীয়। অভিনব অভিনন্দনে ভাসলেন মনু এবং তাঁর কোচ যশপাল রানা।
প্যারিস থেকে ট্রেনে করে ঘণ্টা আড়াই যাত্রা করে যেতে হয় শাতেরুতে। সেখানে কী করে যে পৌঁছে গিয়েছিলেন কয়েক জন ভারতীয় দর্শক। তাঁরা জয়ধ্বনি তুললেন পদকজয়ীর নামে। কোচ যশপাল রানা এসে তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলে গেলেন, ‘‘আপনারা মনুর জন্য ভাগ্য সঙ্গে করে এনেছিলেন।’’ অভিনব বিন্দ্রা তখন সাংবাদিকদের ইন্টারভিউ দিতে দিতে বলছেন, ‘‘মনুর এই সাফল্য সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে। টোকিয়োয় চরম যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে ওকে যেতে হয়েছে। তার পর এ ভাবে ফিরে এসে ব্রোঞ্জ জিততে গেলে মনের জোর দরকার। ওর জন্য আমি খুব খুশি। কোনও প্রশংসাই আজ যথেষ্ট নয়।’’ ভারত এ বারে সব চেয়ে বড় দল পাঠিয়েছে শুটিংয়ে। একাধিক পদক আসতে পারে বলে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। মনুর ব্রোঞ্জ কি পুরো শুটিং দলকে উদ্বুদ্ধ করবে? এক টিভি সাংবাদিক জানতে চাইলেন বিন্দ্রার কাছে। তিনি যে জবাব দিলেন, সেটাও মনুর কাছে অমূল্য পদক হয়ে থাকতে পারে। বললেন, ‘‘শুধু শুটিং দলের জন্য বা অলিম্পিক্সে আসা ভারতীয় দলের জন্য নয়, দেশের সব খেলার সবাইকে উদ্বুদ্ধ করে যাবে মনুর এই লড়াই।’’ বেজিংয়ে সোনা জেতার পরে বিন্দ্রার ‘ব্রেন ম্যাপিং’ নিয়ে খুব হইচই হয়েছিল। মনুর গীতা-পাঠও তেমনই নতুন প্রেসক্রিপশন হয়ে থাকতে পারে তরুণ ভারতীয় ক্রীড়াবিদদের জন্য।
পর ক্ষণেই আবার মনে হচ্ছে, ধ্যাৎ, শুধু ভারতীয় খেলাধুলোর বৃত্তে মনু-কাহিনিকে আটকে রাখার কথা কী বলছি! তা হলে তো তাঁর সাফল্যকে ঠিকঠাক ব্যাখ্যাই করা হল না। আজ থেকে তিনি বরং জীবনের রাস্তায় জ্বলজ্বল করা এক উদাহরণ। যখন ব্যর্থ হব, যখন বিশ্বস্ত হাতিয়ারও বিদ্রোহ করবে, যখন সারা পৃথিবী রক্তাক্ত করবে, সেদিন যেন ধরে না নিই সব কিছুর শেষ। হাল ছেড়ো না, লেগে-পড়ে থাকো, বিশ্বাস হারিও না। দেখবে, মেঘ কেটে গিয়ে আবার রোদ উঠবে। এটাই তো মনু-মন্ত্র। এই শিক্ষাই তো দিয়ে গেল মনুর পদক। কোনও কোনও ব্রোঞ্জ থেকে সোনার ঔজ্জ্বল্য ঠিকরে বেরোয়, জানা গেল রবিবার।
আর মনু ভাকেরের গলায় জ্বলজ্বল করতে থাকা পদকে আইফেল টাওয়ারের অংশ আছে, কথাটাও আগে ভুল লিখেছি। চার বছরের দীর্ঘ যন্ত্রণার পথ পেরিয়ে তাঁর এই পদক প্রাপ্তি আসলে আইফেল টাওয়ারের মতোই সুউচ্চ এক মনুমেন্ট। বিস্ময় ভরা চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখার মতো!