গ্রিপটা শিখে নাও। বাংলার খুদে স্পিনারদের মঞ্চ থেকেই টিপস চন্দ্রশেখরের। সোমবার সিএবিতে। ছবি: উত্পল সরকার
ভগবত্ চন্দ্রশেখর আজও বুঝে পান না, ক্লাব ক্রিকেট না খেলেও কী করে তিনি জাতীয় দলে খেলে ফেললেন। ভারতের সর্বকালের সেরা অধিনায়ক হিসেবে কাউকে বাছতে বললে মনসুর আলি খান পটৌডি নামটা ছাড়া কারও নাম মাথাতেই আসে না।
ভারতের নতুন প্রজন্মের স্পিনারদের সে ভাবে চেনেন না চন্দ্র। অক্ষর পটেল নিয়ে প্রশ্ন এলে উত্তর দেন, ও কে? আমি ঠিক চিনি না। ভারতের নতুন প্রজন্মের ম্যাচ খুব দেখেনও না তিনি। মনে করে বলতে পারেন না, কোন ম্যাচে কোন স্পিনারের কী পারফরম্যান্স। নিজের সোনার দিনগুলো কেমন যেন বিস্মৃত হয় আজ। কিছু মনে আছে, স্মৃতি কিছু হারিয়েছে। প্রথম কলকাতায় আসার দিনটা শুধু এখনও মনে পড়ে। মনে পড়ে কিশোর চন্দ্রের ইডেন দেখে উচ্ছ্বসিত চোখমুখ, যে বাষট্টি সালে প্রথম বার কলকাতায় এসে ইডেন দেখে ভেবেছিল, এখানে নামতে পারলে তো দারুণ হয়।
ইডেন তাঁর কাছে অধরা থাকেনি। বছরখানেকের মধ্যে টেস্টে নেমে পড়া। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ইডেনে প্রথম বার নামার অভিজ্ঞতাটা আজও মনে আছে। মনে আছে কেন ব্যারিংটনকে, যাঁর অদ্ভুত শক্তিশালী ডিফেন্সের সামনে পরাভূত হয়েছিল তাঁর লেগস্পিনের জাদুকরি। বাইশ গজের জীবনের সেরা অভিজ্ঞতাটা বল হাতে এসেছিল, কিছুতেই বলবেন না তিনি। বলবেন পঁয়ষট্টিতে বাপু নাদকার্নির সঙ্গে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে তাঁর ৫১ রানের একটা পার্টনারশিপ। ইডেনে সেরা মুহূর্ত জিজ্ঞেস করলে তিয়াত্তরের ইংল্যান্ড বধ নয়, আসবে দু’বছর পরের ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারানো। ইডেন তো আজও ভোলেনি সেই টেস্টের শেষ দিনে লয়েড আর কালীচরণকে চন্দ্রর তুলে নেওয়া।
পোলিওর আক্রমণ আপনার হাতে তো পড়েছিল। তবু কী ভাবে এমন স্পিন করতেন?
“কে জানে। আমি যে ক্লাব ক্রিকেট না খেলে কী করে জাতীয় দলে খেলে ফেললাম, এখনও বুঝি না,” সোমবার সিএবি আয়োজিত ইডেনের সার্ধশতবর্ষ পূর্তি অনুষ্ঠানে এসে বলছিলেন চন্দ্র। ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিপর্যয়ের পর উত্সবে আচমকাই ভাঁটা পড়েছিল শহরের ক্রিকেট রাজপ্রাসাদে। সোমবার তার পুনর্জাগরণ হল। স্বর্ণযুগের তিন স্পিনারের মধ্যে বেদী-প্রসন্নকে বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্ন সময় দেখা গিয়েছে। কিন্তু চন্দ্র ক্রিকেট থেকে অবসরের পর কেমন যেন অবগুণ্ঠনে আবৃত হয়ে গিয়েছিলেন। টিভি শো-এ তাঁকে দেখা যায় না, মিডিয়ায় বাইট দেন না, কোনও অনুষ্ঠানেও তাঁকে সে ভাবে পাওয়া যায়নি।
সোমবারের অনুষ্ঠান তাই ব্যতিক্রম।
সোমবার শহরেরই একটা ব্যতিক্রমী দিন। এক দিকে ক্রিকেট-যজ্ঞ। বৃহস্পতিবার ভারত-শ্রীলঙ্কা ম্যাচ, সেই উপলক্ষ্যে দুটো টিমের ঢুকে যাওয়া। অন্য দিকে কলকাতা আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল উপলক্ষ্যে বলিউডের এক ঝাঁক। এক উচ্চপদস্থ পুলিশকর্তা বললেন, আজকের দিনটা অভুতপূর্ব। এক দিকে অমিতাভ বচ্চন, জয়া বচ্চন, অভিষেক বচ্চন, ঐশ্বর্য রাই বচ্চন, শাহরুখ খান। অন্য দিকে ইন্ডিয়ান টিম। ম্যাচের দিনটাও কম রংচঙে হবে না। অমিতাভ বচ্চনের কাছে ম্যাচে উপস্থিত থাকার অনুরোধ পাঠিয়েছে সিএবি। শোনা গেল, অমিতাভ সম্মতি দিয়েছেন। দীপিকা পাড়ুকোনকেও নিমন্ত্রণ করা হয়েছে।
সন্ধেয় সিএবিতে গিয়ে দেখা গেল, আবহটা দু’ভাগ। একটা ভাগ দৌড়চ্ছে বর্তমানের পিছনে। দুটো টিম ঢুকছে রাত সাড়ে ন’টায়, দুই স্থানীয় ম্যানেজার সন্দীপ দাস ও সৈকত গোস্বামী এয়ারপোর্ট ছুটলেন আড়াই ঘণ্টা আগে। তা-ও বিরাট কোহলি আজ এলেন না। মঙ্গলবার আসবেন, জল্পনা সত্যি হলে সঙ্গে অনুষ্কাও। অন্য ভাগ দেখা গেল নতুনের আগমনের মধ্যেই পুরাতনের আবাহনে ব্যস্ত।
সাড়ে তিনশো জন খুদে স্পিনারকে এনেছিল সিএবি চন্দ্রর সঙ্গে কথা বলে কিছু টিপ্স পাওয়ার জন্য।
স্যর, লিমিটেড ওভার্স ক্রিকেটে লুপ দেব? না টেনে টেনে বল করব?
“ফ্লাইট কোরো না। ওটা টেস্টে চলে। মনে রাখবে, তোমার ক্রিকেটে ৪-৭৫ খুব খারাপ বোলিং। আমার টেস্ট ক্রিকেটে দুর্দান্ত।”
দুসরা, ওটা একটু শিখিয়ে দেবেন?
“দুসরা কাকে বলে জানো? না জানলে চেষ্টা কোরো না। সব পারতেই হবে, তার কোনও মানে নেই।”
স্ট্রেটার ডেলিভারিতে ব্যাটসম্যানকে কী ভাবে ধাঁধায় ফেলা উচিত?
“আমি কোনও দিন ব্যাটসম্যানের বিরুদ্ধে প্ল্যান করে নামিনি। ওরা নেমেছে আমার বিরুদ্ধে। তাই বলতে পারব না।”
আর ফ্ল্যাট পিচ? সেখানে কী ভাবে বল ঘোরাতে হয়?
“আমি পারি না রে ভাই। ওয়ার্ন পারে। ওকে কোনও দিন জিজ্ঞেস করিস।”
কে বলবে পিচ অচেনা? কে বলবে এত দিন লোকচক্ষুর অন্তরালে তিনি? কে বলবে বয়স এখন তাঁর ঊনসত্তর?
এ তো সেই যৌবনের চন্দ্র, যাঁকে ইডেন আবার নিজের বাইশ গজে নামিয়ে দিয়েছে।