অপ্রীতিকর ঘটনায় জড়ালেন মনোজ। ইডেনে নিয়ম ভাঙার কথা মানছেন না দেবাং। নিজস্ব চিত্র
অশোক ডিন্ডা বনাম রণদেব বসুর পরে এ বার দেবাং গাঁধী বনাম মনোজ তিওয়ারি। বাংলা ক্রিকেট দলের ড্রেসিংরুম এখন কাজিয়ার সংসার।
বৃহস্পতিবার অন্ধ্রপ্রদেশের বিরুদ্ধে বাংলার রঞ্জি ম্যাচের দ্বিতীয় দিনের খেলা থেমে থাকার সময় ড্রেসিংরুমে প্রবেশ করেছিলেন দেবাং গাঁধী। যিনি বাংলার প্রাক্তন নামী ক্রিকেটার এবং বর্তমানে জাতীয় নির্বাচক কমিটিতে পূর্বাঞ্চলের প্রতিনিধি। কোমরে ব্যথা হচ্ছে বলে ড্রেসিংরুমে ঢুকে বাংলা দলের ফিজিয়োর সঙ্গে পরামর্শ করতে যান দেবাং। কিন্তু বাংলা দলের মধ্য থেকেই মনোজ তিওয়ারি তাঁর ড্রেসিংরুমে প্রবেশ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। দুর্নীতি দমন শাখার কাছে এ নিয়ে জানতে চান মনোজ যে, দেবাং কী করে ড্রেসিংরুমে ঢুকলেন? এখানে তো শুধু দলের ক্রিকেটার এবং আগে থেকে অনুমতি নেওয়া ব্যক্তি ছাড়া প্রবেশ নিষেধ। অন্য কেউ ঢোকা মানে তো দুর্নীতি দমন শাখার আইন ভাঙা। মনোজের প্রশ্নের জেরেই দেবাংকে ড্রেসিংরুম ছেড়ে বেরিয়ে যেতে বলেন দুর্নীতি দমন শাখার কর্তা।
বাংলার ক্রিকেটে নানা সময়ে বিভেদের নানা কাহিনি শোনা গিয়েছে, কিন্তু এ ভাবে কোনও ক্রিকেটার তাঁর চেয়ে অগ্রজ, প্রাক্তন কোনও ক্রিকেটারের ড্রেসিংরুমে ঢোকা নিয়ে হেস্তনেস্ত করতে চাইছে, এমন ঘটনা নজিরবিহীন। জাতীয় নির্বাচককে কোনও একটি রাজ্য দলের ড্রেসিংরুম থেকে বার করে দেওয়া হচ্ছে, এমন ঘটনাও বিরল। যদিও দেবাং এবং মনোজের তিক্ততা পুরনো এবং অতীতের সমীকরণ এই ঘটনার পিছনে আছে বলেই গরিষ্ঠ অংশের মত। এর আগে মনোজ জাতীয় দল থেকে ব্রাত্য থাকা নিয়ে দেবাংয়ের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন। কারও কারও মনে হচ্ছে, সুযোগ পেয়ে তাঁর প্রতি ‘বিরূপ’ নির্বাচকের উপরে প্রতিশোধই তুললেন মনোজ।
আরও পড়ুন: ঘরের মাঠে জয়ে ফিরল কাশ্মীর
সূর্যগ্রহণের জন্য মধ্যাহ্নভোজের আগে যখন খেলা বন্ধ, তখনই এই অপ্রীতিকর ঘটনাটি ঘটে। দেবাংয়ের বক্তব্য, ‘‘আমার কোমরে ব্যথা ছিল। বাংলার কোচ অরুণ লাল বলেন, তাঁর দলের ফিজিয়োর সঙ্গে এ বিষয়ে এক বার আলোচনা করতে। দুর্নীতি-দমন শাখার প্রতিনিধির অনুমতি নিয়েই ড্রেসিংরুমে প্রবেশ করি। তার পরে বাংলার ফিজিয়োকে নিয়ে সিএবি-র মেডিক্যাল রুমে চলে যাই।’’ সিএবি সচিব অভিষেক ডালমিয়া যে প্রেস বিবৃতি দেন, তাতে লেখা ছিল, অনুমতি নিয়েই ড্রেসিংরুমে ঢুকেছিলেন দেবাং। যদিও আইনের চেয়ে দেবাংয়ের সঙ্গে মনোজের তিক্ততার পুরনো সম্পর্কই এমন চাঞ্চল্যকর ঘটনার পিছনে রয়েছে বলেই অনুমান করা হচ্ছে।
খেলা যখন স্থগিত রয়েছে, তখন মনোজ মাঠ ছেড়ে উঠে আসেন ক্লাব হাউসের দ্বিতীয় তলায়। সেখানে এসে সাংবাদিকদের কাছে এই ঘটনা জানিয়ে দেবাংয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন তিনি। এ নিয়েও প্রশ্ন উঠছে যে, ম্যাচ স্থগিত থাকলেও পরিত্যক্ত হয়নি। তা হলে মনোজই বা কী করে ড্রেসিংরুমে ঘটা ঘটনার কথা সাংবাদিকদের বলতে চলে আসতে পারেন? অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগে বঙ্গ ক্রিকেটের কাজিয়া এবং দুর্দশার ছবিই প্রকট হয়ে উঠছে। অন্ধ্রের সঙ্গে এই ম্যাচ শুরুর আগের দিন দলের বোলিং কোচ রণদেব বসুর অভিযোগের ভিত্তিতে বাদ দিয়ে দেওয়া হয় বাংলার অভিজ্ঞ পেস বোলার অশোক ডিন্ডাকে।
দলের অভিজ্ঞ বোলার এবং বোলিং কোচ খাওয়াখাওয়ি করছেন, এমন দৃশ্যই এখন চলছে বাংলার ক্রিকেটে। এখানেও পুরনো সম্পর্কের রেশ রয়েছে। রণদেব-ডিন্ডা একসঙ্গে খেলার সময়েও ঝামেলায় জড়িয়েছেন। ক্রিকেট প্রশাসনের অলিখিত নিয়ম ছিল, সতীর্থ কাউকে কখনও কোচ করে এনো না। বঙ্গ ক্রিকেটে এখন সে সব মানে কে! ডিন্ডার আচরণজনিত সমস্যা আছে মেনে নিয়েও কেউ কেউ ধরিয়ে দিচ্ছেন, এ সব ক্ষেত্রে নিয়ম হচ্ছে, শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির হাতে দায়িত্ব দিয়ে দু’পক্ষের বক্তব্য শুনে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু সে সবের তোয়াক্কা না করে সে দিনই নির্বাচক কমিটিকে দিয়ে যে ভাবে ডিন্ডাকে বাদ দেওয়া হয়েছে, তাতে প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।
আরও আছে। রণদেব বসু এবং জয়দীপ মুখোপাধ্যায় বাংলা দলের সঙ্গে পেশাদারি প্রক্রিয়ায় যুক্ত। এর জন্য তাঁরা সিএবি থেকে বেতন পান। তা হলে কী করে তাঁদের ধারাভাষ্য দেওয়ার অনুমতি দিচ্ছে সিএবি? লোঢা সংস্কার এবং হালফিলে ভারতীয় ক্রিকেটে হইচই ফেলা স্বার্থ সংঘাত নিয়ম অনুযায়ী, এই দু’টি ভূমিকা একই সঙ্গে তাঁরা পালন করতে পারেন না। ভারতীয় দলের কোচেরা যেমন কমেন্ট্রি করতে পারেন না, আইপিএলে কোচিং করতে পারেন না। তা হলে বাংলার ক্রিকেট সংস্থা কী করে ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত নিয়ে দিনের পর দিন চালিয়ে যাচ্ছে?
অরুণ লালের মতো প্রেরণামূলক ব্যক্তিত্ব থাকার পরেও পরিবেশ বিষাক্ত হয়ে রয়েছে দেখে চমকে উঠছেন অনেকে। এখন প্রকাশ্যে এসে গেল মনোজ-দেবাং কাজিয়া। এ দিন সাংবাদিকদের কাছে এসে মনোজ বলতে থাকেন, ‘‘দুর্নীতি-দমন শাখার নিয়ম অনুযায়ী, ক্রিকেটার ও সাপোর্ট স্টাফ ছাড়া ড্রেসিংরুমে কেউ প্রবেশ করতে পারেন না। জাতীয় নির্বাচক হিসেবে ওঁর (দেবাংয়ের) সেটা জানা উচিত ছিল।’’ যোগ করেন, ‘‘দলের সিনিয়র ক্রিকেটার হিসেবে আমার দায়িত্ব ড্রেসিংরুমের শৃঙ্খলা বজায় রাখার। তাই দুর্নীতি-দমন শাখার প্রতিনিধিকে বিষয়টি জানাতে বাধ্য হই। ফলস্বরূপ, জাতীয় নির্বাচককে ড্রেসিংরুমের বাইরে যাওয়ার নির্দেশ দেন সেই প্রতিনিধি।’’
বাংলার ক্রিকেটার। বাংলা থেকে মনোনীত জাতীয় নির্বাচক। একে অন্যের দিকে তেড়ে যাচ্ছেন। হায় রে বঙ্গ ক্রিকেট!