আরও কিছুদিন খেলার ক্ষমতা রাখেন অ্যান্ডারসন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজ দেখে তেমনই ধারণা মদন লালের। ছবি: এএফপি।
জেমস অ্যান্ডারসন মানেই ব্যতিক্রমী!
১৫৬ টেস্টে ৬০০ উইকেটের মাইলফলকে পৌঁছনোই হোক, পেসার হিসেবে সবচেয়ে বেশি বল করার রেকর্ড হোক, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমতে থাকা গড়ই হোক— ডানহাতি অবাক করেই চলেছেন ক্রিকেটদুনিয়াকে।
গ্লেন ম্যাকগ্রার ৫৬৩ উইকেট। কোর্টনি ওয়ালশের ৫১৯। স্টুয়ার্ট ব্রডের ৫১৪। ডেল স্টেনের ৪৩৯। কপিল দেবের ৪৩৪। রিচার্ড হ্যাডলির ৪৩১। শন পোলকের ৪২১। ওয়াসিম আক্রমের ৪১৪। কার্টলি অ্যামব্রোজের ৪০৫। এঁদের কেউ গ্রেট, কেউ কিংবদন্তি। অথচ, সমকালকে শাসন করা এই পেসারদের কেউ যা পারেননি, সেই শিখরে পা রেখেছেন অ্যান্ডারসন। চোখ আরও উপরে, সাতশোর দিকে। আর সেটা ৩৮ বছর বয়সি জোর গলায় জানিয়েও দিয়েছেন।
আরও পড়ুন: যিনি বিজ্ঞানী, তিনি-ই ক্রিকেটার, কর্নাটকের মেয়ে এখন জার্মানির জাতীয় দলের অধিনায়ক
কোথায় অনন্য ইংরেজ পেসার? আনন্দবাজার ডিজিটালকে মদন লাল বললেন, “মুভিং বোলারদের সব সময়ই বেশি উইকেট পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কারণ, বল মুভ করলে তা খেলা সব সময়ই কঠিন। আর ও ইংল্যান্ডের। এটাও একটা সুবিধা। ওখানের কন্ডিশন সুইং বোলারদের সহায়ক। তবে এটাও ঠিক, এত বছর ধরে ও খেলে চলেছে। সেটা মস্ত বড় কৃতিত্ব। আর ৬০০ উইকেট নেওয়া বিশাল প্রাপ্তি। ইংল্যান্ডের হয়ে দুর্দান্ত অবদান রেখেছে।”
২০০৩ সালে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছিল অ্যান্ডারসনের। ১৭ বছরের টেস্ট কেরিয়ারের রগড়ানির পরও তরতাজা দেখাচ্ছে তাঁকে। পরের বছর অস্ট্রেলিয়ায় অ্যাশেজে খেলতে আগ্রহী তিনি। কিন্তু সর্বকালের সেরা পেসারদের তালিকা যদি করতে হয়, তবে তিনি কোথায় থাকবেন? মদন লাল বললেন, “পারফরম্যান্সই তো ওর হয়ে কথা বলছে। রিচার্ড হ্যাডলির মতো অ্যান্ডারসনও সুইং বোলার। এই ধরনের বোলারদের উইকেট নেওয়ার সুযোগ থাকে বেশি। আমার মনে হয় সর্বকালের তালিকায় খুব উপরের দিকেই ও থাকবে। তবে কারও সঙ্গে তুলনায় আমি বিশ্বাসী নই। তুলনা করা মানে অন্যদের অসম্মান করা। আমি তা পছন্দ করি না। তবে ও নিজস্ব একটা জায়গা গড়ে নিয়েছে। প্রচুর ম্যাচ জিতিয়েছে। আর ৬০০ টেস্ট উইকেট তো কোনও রসিকতা নয় এক জন পেসারের কাছে। তাঁকে ফিট থাকতে হয় দীর্ঘদিন।”
প্রথম পেসার হিসেবে টেস্টে ৭০০ উইকেটে পৌঁছতে পারবেন অ্যান্ডারসন? ছবি: এএফপি।
কোথায় গিয়ে থামবেন অ্যান্ডারসন? তিনি নিজে খেলা চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। চল্লিশের কাছাকাছি বয়সে পৌঁছে পারফর্ম করা এক জন পেসারের কাছে কঠিনতর হওয়ারই কথা। মদনলাল বললেন, “পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সিরিজে ওকে দেখলাম। এখনও যে ভাবে বল করছে, যে ছন্দে দৌড়ে আসছে, তাতে ভিতরে বারুদ অবশিষ্ট আছে বলেই মনে হচ্ছে। বল মুভও করাচ্ছে দারুণ ভাবে। হয়তো আগের চেয়ে গতি এক-দু’গজ কমেছে, কিন্তু ঘন্টায় ১৩০-১৩৬ কিমিতেই বল করছে। ১৪০ কিমিতেও হয়তো পৌঁছচ্ছে। আরও কিছু দিন খেলবে নিশ্চয়ই।”
গতি নয় সুইং। অ্যান্ডারসনের মন্ত্র এটাই। দেড়শো কিমির বেশি গতির ঝড়ের দিকে যখন ঝুঁকছেন তরুণরা, তখন ইংল্যান্ডের ‘জিমি’ ভরসা রেখেছেন সুইংয়ে। মদন লালের ব্যাখ্যা, “দেখুন, উইকেট নেওয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমি ১৪০ কিমি বা ১৫০ কিমিতে বল করছি কি না, তা নয়। উইকেট পাওয়ার বিদ্যা আয়ত্ত করতে হবে। ব্যাটসম্যানকে আউট করার কৌশল রপ্ত করতে হবে। সেটাই আসল। অনেক বোলার আছে দারুণ বল করেও উইকেট পায় না। কেউ কেউ উইকেট নেওয়ার রহস্যটা জানে। ব্যাটসম্যানকে আউট করার জন্য বল কোথায় ফেলতে হবে, কোন লাইনে বল রাখতে হবে, এগুলো জানা জরুরি। আর উইকেট নেওয়া একটা অভ্যাসের মতো। সেটা বজায় থাকা দরকার।”
আরও পড়ুন: বারান্দাই জিম, কোহালির শরীরচর্চার ভিডিয়ো ভাইরাল
কোথায় বিশেষত্ব অ্যান্ডারসনের? প্রথম বিশেষজ্ঞ পেসার হিসেবে ১৫০ টেস্ট খেলা ও পাঁচ দিনের ক্রিকেটে ৩৩,৭১৭ ডেলিভারি করা বোলারের সাফল্যের রেসিপি কী? মদন লাল বললেন, “ওর আউটসুইং। বল ভিতরেও আনতে পারে। কিন্তু, প্রধানত ও আউটসুইং বোলার। তার সঙ্গে অভ্রান্ত লাইন-লেংথ।”
পরিসংখ্যান বলছে, ইংল্যান্ডের হোম কন্ডিশনে বরাবর দাপুটে থেকেছেন অ্যান্ডারসন। ডিউক বলে ঘরের মাঠে ২৩.৮৩ গড়ে ৩৮৪ উইকেট নিয়েছেন তিনি। কেরিয়ারের গড় ২৬.৭৯, যা ঘরের মাঠের চেয়ে বেশি। ইংল্যান্ডের মাঠে ইনিংসে পাঁচ উইকেট নিয়েছেন ২২ বার। সেখানে দেশের বাইরে ইনিংসে পাঁচ উইকেটের সংখ্যা মাত্র সাত বার। পরিষ্কার, ঘরের মাঠের সিম-সহায়ক পরিবেশে ৮৯ টেস্ট খেলা কিছুটা হলেও ‘অ্যাডভান্টেজ’ হয়ে উঠেছে। মদন লাল যদিও অন্য ভাবে দেখছেন বিষয়টা। তাঁর যুক্তি, “ইংল্যান্ডে খেলা এক জন সুইং বোলারের কাছে বরাবরের সুবিধা। কিন্তু, তার জন্যই ৬০০ উইকেট পেয়েছে, এটা বড্ড সরলীকরণ হয়ে উঠবে। যেখানেই খেলা হোক, টেস্টে উইকেট নেওয়া কখনই সহজ নয়। তা সে ইংল্যান্ডেই খেলা হোক বা ভারতে বা অস্ট্রেলিয়ায়। এই তিন জায়গার পিচ-কন্ডিশন একেবারেই আলাদা। তবে উইকেট নেওয়া একেবারেই সহজ কাজ নয়। তা সে যেখানেই খেলতে হোক না কেন।”
ইংল্যান্ডে ঘরের মাঠে বেশি সফল অ্যান্ডারসন। ছবি: এএফপি।
সমসাময়িকদের মধ্যে গ্লেন ম্যাকগ্রা থেমে গিয়েছেন ছশোর আগে। ওয়াসিম আক্রম তো সাড়ে চারশোও পাননি। এ দিকে, সতীর্থ স্টুয়ার্ট ব্রড পেরিয়ে গিয়েছেন পাঁচশোর গণ্ডি। অ্যান্ডারসন কোথায় বাজিমাত করলেন? মদন লাল বললেন, “ম্যাকগ্রাও খেলা চালিয়ে গেলে ৬০০ উইকেট পেত। কিন্তু তা পারেনি। আসলে ফিটনেস মারাত্মক জরুরি। যত ভাল বোলারই হোক না কেন, ফিট থাকতে হবে লম্বা সময়ের জন্য। ম্যাকগ্রা বা আক্রমের তো বোলার হিসেবে কোনও দুর্বলতা ছিল না। কিন্তু ওরা এত টেস্ট খেলতে পারেনি। অবসরের ব্যাপারটা আবার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের উপরও নির্ভরশীল।”
অর্থাৎ, কেউ থেমে যান, কেউ খেলা চালিয়ে যেতে চান। জুলাইয়ে ৩৯ বছরে পা দেওয়া মহেন্দ্র সিংহ ধোনি যেমন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকেই সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। আর তার দিন কয়েক পরই বছর ৩৮-এর ইংরেজ পেসার টেস্টে পৌঁছলেন অন্য উচ্চতায়। কে জানে, অ্যান্ডারসন কোথায় গিয়ে থামবেন!