গম্ভীরকে সান্ত্বনা সানরাইজার্সের দুই মগজ ভিভিএস লক্ষ্মণ এবং মুরলীধরনের। ছবি: উৎপল সরকার
সানরাইজার্স হায়দরাবাদ: ১৬২-৮ (২০ ওভারে)
কলকাতা নাইট রাইডার্স: ১৪০-৮ (২০ ওভারে)
শেষ পাঁচ ওভারে বাকি ছিল ৫৩। কমতে কমতে দাঁড়াল ১৮ বলে ৩৯। আরসিবি হলে ম্যাচ রিপোর্টের হেডিং হত, হাসতে হাসতে জিতল রে!
অথচ শেষ ওভারে যখন হোল্ডার গার্ড নিয়ে দাঁড়াচ্ছেন ভুবনেশ্বর কুমারের বিরুদ্ধে তখন জেতার জন্য চাই ২৫। কোথা থেকে কোথায় ম্যাচটা চলে গেল!
কে না জানে, হোল্ডারের পাসপোর্টে পদবী লেখা হোল্ডার-ই। ব্রেথওয়েট নয়। তিনি ধোনিও নন। গল্পের শেষটা তাই আগাম অনুমান করা যায়।
নাইট অধিনায়কের পরিচিত কুসংস্কার হল, রান তাড়া করার সময় উত্তেজক ম্যাচে তিনি আউট হয়ে এসেও প্যাড খোলেন না। অথচ এ দিন শেষ ওভারের প্রথম বলটা হওয়ামাত্র দু’পায়ের প্যাড টেনে খুলে ফেললেন। তখনই যে গম্ভীর জেনে গিয়েছেন বিজিত অধিনায়ক হিসেবে টিভি ইন্টারভিউয়ে প্রথম তাঁরই ডাক পড়বে। জেনে গিয়েছেন, কোটলা আবার তাঁকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিল। গ্রুপ ম্যাচে ভুল স্ট্র্যাটেজি সমেত বিশ্রী খেলে দিল্লির কাছে হেরেছিলেন। আজ আবার সঙ্গে বড় ম্যাচে ‘চোক’ও করলেন।
সুতরাং, পিকচার অভি বাকি হ্যায় মেরে দোস্ত বলার কোনও উপায় নেই। নাইটরা আইপিএল কক্ষচ্যুত। রাইগর মর্টিস সেট ইন করে গিয়েছে। বিদায় ২০১৬।
হর্ষ থেকে বিষাদ: কুলদীপের জোড়া শিকারের পর কেকেআর উচ্ছ্বাস।
খান মার্কেটের কাবাব। পান্ডারা রোডের পরোটা। বেঙ্গলি মার্কেটের চানা-বটোরা। করিমসের বিরিয়ানি। আর ফিরোজ শাহ কোটলার স্পিনিং উইকেট।
ঐতিহাসিক ভাবে এটাই নয়াদিল্লি। শুধু টি-টোয়েন্টির বাজারে স্পিনারদের আধিপত্যটা পুরনো ফিরোজ শাহ কেল্লার মতো জরাজীর্ণ দেখায়। কুম্বলের সেই দশ উইকেটের মতো ট্র্যাক টি-টোয়েন্টির বাজারে অসম্ভব। আর তার অর্ধেক ঘূর্ণিও এখনকার কোটলা সরবরাহ করে না। আইপিএল স্পিনার তাই এ মাঠে সম্পদ না বোঝা তা নিয়ে ক্রিকেট তর্ক চলতে পারে।
এটা মাথায় রেখেই হয়তো গম্ভীর এ দিন স্পিনার ভর্তি আক্রমণ খেলাননি। সাকিবকে বসিয়ে খেলালেন মর্কেলকে। সেটা না হয় বোঝা গেল। তা বলে মানরো তিন? কেন?
কুলদীপ যাদবকেই বা এক ওভারে দু’উইকেট পাওয়ার পর এন্ড চেঞ্জ করার জন্য সরালেন কেন? যুবরাজ তখন ক্রিজে। যতই তিনি কুলদীপকে ভাল খেলুন সদ্য ক্রিজে এসেছিলেন। কুলদীপের বাঁ হাতি লেগস্পিন ন্যাটা ব্যাটসম্যানকে শুরুতে সমস্যায় ফেলবেই। এ দিন কুলদীপ সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে গেলেন রবি শাস্ত্রী আর সঞ্জয় মঞ্জরেকর।
যুবরাজের পাল্টা আক্রমণ।
দু’জনেই মনে করেন ধোনির নেতৃত্বে জিম্বাবোয়েগামী দলে কুলদীপের থাকা উচিত ছিল। কুলদীপের বোলিং যদি রহস্য হয়, তা হলে গম্ভীরের ওই ওভারে তাঁকে সরিয়ে নেওয়াটা একই রকম বড় রহস্য। ওই ওভারটায় বেশ কিছু রান গেল। দিনের শেষে ২২ রানে হারাটাকে যদি ব্যাখ্যা করা যায়, দেখা যাবে এমন টুকরো টুকরো কয়েকটা মুহূর্ত তার জন্য দায়ী।
নাইটদের ভরসা ছিল কোটলায় শিশির পড়ে সানরাইজার্সের বল গ্রিপ করতে সমস্যা হবে। একে নেহরা নেই। তার উপর টস হেরে পরে বোলিং।
ক্রিকেটমহলে কিন্তু সকাল থেকেই বলাবলি চলছে, নেহরার না থাকাটা বাড়তি কোনও ক্ষতি নয়। কারণ ও দিকে রাসেলও তো নেই। প্লাস-মাইনাসে জিরো হয়ে গেল।
ওপেনিং পার্টনারশিপে নাইটদের ম্যাচ ঘোরানো বহু দিন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। গত বছর থেকেই এই ট্রেন্ডটা দেখা যাচ্ছে। গম্ভীর-উথাপ্পা শুরু করেন দারুণ। যত আইপিএল এগোয়, তত চাপের মুখে হারিয়ে যান। এলিমিনেটরে ১৬৩ তাড়া করে যে টিমের তিন নম্বরে মানরো, তাদের ওপেনিংয়ে একটা ভিত গড়ে দিয়ে যেতেই হবে। অথচ এঁরা বারবার ‘চোক’ করছেন।
এলিমিনেটরের এই ম্যাচটা দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল সত্যিই যেন তিন আর চারের মধ্যে খেলা হচ্ছে। মঙ্গলবারের বেঙ্গালুরু যদি এল ক্লাসিকো হয়, বুধবারের কোটলা ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের গড়পড়তা ম্যাচ।
দু’দলেই নায়কের বক্স অফিস নিয়ে একাধিক ক্রিকেটার। ওয়ার্নার। ধবন। নারিন। গম্ভীর। মুস্তাফিজুর। ইউসুফ পাঠান। যুবরাজ। কিন্তু কোথায় নক্ষত্রপুঞ্জের দীপ্তি?
আইপিএল ট্রফি গম্ভীরের কাছে থেকেও কত দূরে!
চিত্তরঞ্জন পার্ক ঝেঁটিয়ে এলেও কোটলার দুই-তৃতীয়াংশই ভরেনি। ম্যাচেও তেমন তারার আলো কোথায়? কুলদীপ দুর্ধর্ষ স্পেল করলেন। মুস্তাফিজুর ইয়র্কারের উপর তাঁর বাংলাদেশি পেটেন্ট জারি রাখলেন। পদ্মার ইলিশের মতো তাঁর ইয়র্কার ক্রমশ ভারতীয় বাজারে সমৃদ্ধি পাচ্ছে।
কিন্তু কোটলার একটা ডে’ভিলিয়ার্স কোথায়? একটা ধবল কুলকার্নি কোথায় যে, ম্যাচ হঠাৎ করে খুলে দেবেন?
আউটফিল্ডে দুর্দান্ত দু’টো ক্যাচ অবশ্য সানরাইজার্স দেখাল। মাত্র ২ রানে ইউসুফের ক্যাচ আর গম্ভীরকে সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে ধরা জোড়া ধাক্কা জিতিয়ে দিল ওয়ার্নারদের।
আর ঝলমল করলেন যুবরাজ সিংহ। কুলদীপ যখন ম্যাচ ছিনিয়ে নিচ্ছেন যুবরাজ পাল্টা কাউন্টার অ্যাটাকে ওটা নিয়ে গেলেন সানিয়া মির্জার সাবেকি শহরে। ৩০ বলে তাঁর ৪৪। যার ৩৮ রান এসেছে শুধু চার-ছয়ে।
ঐতিহাসিক ভাবে নাইটদের টিমের বিপদে পড়ার গায়ত্রীমন্ত্র হলেন সুনীল নারিন। তাঁকে বারবার যুবরাজের সামনে লেলিয়ে দিলেন নাইট অধিনায়ক। কিছু ডট বলও খেললেন যুবি। কিন্তু সেট হওয়া মাত্র ধরে নিলেন খেলাটা। ইনিংসের দু’টো অর্ধের মধ্যে যে ফুটোফাটা দেখা যাচ্ছিল যুবির ব্যাটে সেটা সেলাই হয়ে গেল। কুড়ি গজি থ্রোয়ে মানরোকে রান আউটও করে দিলেন যুবরাজ।
উচ্চমার্গীয় ম্যাচে শুধু এই পারফরম্যান্সেই ম্যাচ ঘুরবে না। কিন্তু বুধবার যারা মুখোমুখি হয়েছিল, তারা এ বারের আইপিএলের মাপে গত দু’সপ্তাহ নিছক মধ্যবিত্ত ক্রিকেট খেলছে। সেখানে সামান্য ভাল পারফরম্যান্সও ম্যাচ ঘুরিয়ে দিল।
নারিন যেমন টিমের গায়ত্রীমন্ত্র, কেকেআরের অগতির গতির নাম মণীশ পাণ্ডে। রণে-বনে-জলে-জঙ্গলে এমনকী আইপিএল ফাইনালেও যখন কেকেআর বিপদে তখন মণীশ পাণ্ডে আবির্ভূত হয়েছেন। ইডেনেও গত রবিবার তিনি ব্যাপক ভাবে ছিলেন। এ দিনও মণীশই ছিলেন শেষ আশা। আউটফিল্ডে তিনি আউট হওয়ামাত্র লক্ষ্য করলাম ডাগআউটে বসা আক্রম চিবুক নিচু করে ফেললেন।
আইপিএল থেকে মুছে যাওয়া কেকেআরকে আপাতত ভাবতে হবে টুর্নামেন্টে দারুণ শুরু করে হঠাৎ মানসিক বিচ্যুতি ঘটছে কেন? নাইটদের চিয়ারলিডারদের কেউ কেউ শেষ বল হওয়ার আগেই কাঁদতে শুরু করেছিলেন।
পরের মরসুমে এই চোখের জল মোছাতে হলে আত্মবিক্ষণ দরকার। ভাবা দরকার এই অধিনায়ক দারুণ সার্ভিস দিয়েছেন। দু’বার আইপিএল দিয়েছেন। কিন্তু এ বার কি তাঁকে সরানোর সময় এসেছে? ভাবতে হবে।
সংক্ষিপ্ত স্কোর: সানরাইজার্স হায়দরাবাদ ১৬২-৮ (যুবরাজ ৪৪, হেনরিক ৩১, কুলদীপ ৩-৩৫), কেকেআর ১৪০-৮ (মণীশ ৩৬, ভুবনেশ্বর ৩-১৯)।
ছবি: উৎপল সরকার ও বিসিসিআই