ইডেন-ধামাকা। উইকেট নিয়ে মর্কেলের উচ্ছ্বাস।
ব্যাট উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে কে? সূর্যকুমার, আবার কে?
তৃপ্ত মুখে হাসি কার? গুরু-গম্ভীর, আবার কার?
ইডেনকে ‘চুমু’ দিচ্ছে কে? কিঙ্গ খান, আবার কে?
পিঠে চাপড় পড়ছে কার? সুনীল নারিন, আবার কার?
ক্রুদ্ধ গর্জন আসছে একের পর এক। আসছে ওই সামনের বাইশ গজ থেকে। ওখানে ব্যাট তুলে ‘বি ব্লক’ তাক করে দাঁড়িয়ে যিনি, এই মুম্বই ইন্ডিয়ান্সই তাঁকে বসিয়ে রাখত না? আজ শোধ নিচ্ছেন ‘বেবি নাইট’, চরমতম প্রতিশোধ তুলেছেন কেকেআরের নতুন সূর্য! ওই দিকটায় দেখুন, ওই ডাগআউটে। ওখানে গৌতম গম্ভীর দাঁড়িয়ে না? তৃপ্ত, নিশ্চিন্ত একটা মুখাবয়ব অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে বন্ধু বিজয় দাহিয়ার বুকে। টেনশনের তো শেষ ছিল না কেকেআর ক্যাপ্টেনের। আকাশ। ব্যাটিং ফর্ম। একটা নয়, একশোটা। তার উপর আবার একশো সত্তর তুলতে হবে। আরে, পুরস্কার-মঞ্চের পাশে আবার একটা জটলা! ওখানে দাঁড়িয়ে চার। কিন্তু ক্রমাগত পিঠে চাপড় পড়ছে শুধু একের, আর দিচ্ছে বাকি তিন। ওঁরা সবাই ক্যারিবিয়ান আর অভিবাদনে অধোবদন মুখটা প্রত্যেকের চেনা। উনি— সুনীল নারিন! সম্মানের পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়ে সসম্মানে উত্তীর্ণ!
রাত সাড়ে এগারোটাতে দেখা গেল, ইডেনের চার দিকে ঘুরে-ঘুরে কলকাতার আরও কাছাকাছি চলে যেতে চাইছেন শাহরুখ খান। হাত নাড়িয়ে, চুমু ছুড়ে শহরের হৃদয়ের আরও কাছাকাছি চলে যাওয়ার তৃষ্ণায় মত্ত। সূর্যের বিশাল ছক্কায় এক ফটোগ্রাফারের ল্যাপটপ দু’টুকরো, শোনা গেল শাহরুখ নাকি নামধাম নিয়ে তাঁকে একটা আস্ত ল্যাপটপ গিফট করবেন বলেছেন! টিভি সঞ্চালক ধরল মাঝখানে, মুহূর্তে এসআরকে অকপট, অনর্গল। যে কোনও জয়ই টিম মালিকের কাছে সুখ বহন করে আনে। কিন্তু মাঝরাতে শাহরুখের বাড়তি আবেগের সমুদ্রে ডুবে যাওয়ার কারণটা বোধহয় আন্দাজ করা যায়। সাধারণ আর পাঁচটা জয় এক, আর মর্যাদার যুদ্ধ, আত্মসম্মানের যুদ্ধ জিতে ওঠা আর এক। ওয়াংখেড়ে আরও বছর দু’য়েক তাঁকে ঢুকতে দেবে না। ওয়াংখেড়ে-কাণ্ডকে ঘিরে এত দিন পরেও আজও তাঁর নামে মামলা হয় মুম্বইয়ে। গত মাসেই হয়েছে। একটা সময় তো কেকেআর ক্রিকেটারদের শাহরুখ মেসেজ করে বলেওছিলেন, তোমরা আমাকে ওয়াংখেড়েতে জিতিয়ে দাও। আমাকে এখানে সবাই বাদশা বলে।
বাদশা তো ছিলেনই। শুধু আজকের পর বাদশার মুকুটটাও পেয়ে গেলেন শাহরুখ খান।
রাতে হোটেলে ফিরে কেকেআরের নতুন সূর্য ঘিরে উৎসব।
এক নয়, দুই নয়, একে একে তিন। আইপিএলে বুধবারের ইডেনটা নিয়ে টানা তিন বার মুম্বইকে চূর্ণ করল কেকেআর! আর কোনও এক জায়গায় নয়। গত আইপিএলের উদ্বোধনীতে আমিরশাহিতে। পরেরটা কটকে। এবং শেষটা আবার উদ্বোধনে, ইডেন গার্ডেন্সে। আশ্চর্য হলেও সত্যি যে, তিন বারই মুম্বই বলতে গেলে দাঁড়াতে পারল না! রোহিত যে রোহিত, ইডেন যাঁকে এত দিনে আজহার-ভিভিএসের সঙ্গে সম-সম্মানের মঞ্চটা ছেড়ে দিয়েছে, তাঁকে পর্যন্ত ইডেনে দাঁড়িয়ে দেখতে হল নিজের দুর্ধর্ষ ৯৮ কী ভাবে আস্তে আস্তে তলিয়ে যাচ্ছে গঙ্গাবক্ষে! দেখতে হল, তাঁর মঞ্চ তাঁরই সামনে কেড়ে নিচ্ছেন মরাঠারাজ্যেরই আর এক নতুন প্রতিনিধি। দেখতে হল, নিজের ‘ঘরের মাঠ’ ইডেনে তিনি নিজেই আজ শাসিত। অসীম দর্পে তাঁর টিমকে শাসন করে বেরিয়ে যাচ্ছে কেকেআর! আসলে শাহরুখ খান তাঁর ‘প্রিয়’ মুম্বইয়ের বিরুদ্ধে এ দিন একটা নয়, তিনটে ম্যাচ জিতলেন। কেকেআর আইপিএল সেভেন চ্যাম্পিয়ন হলেও তার অধিনায়কের ব্যাট মোটে চলেনি। শুরুর দিকে উল্টে পরপর শূন্যে গম্ভীরের ‘ডাক টেলস’ নিয়ে মুখরোচক টিপ্পনী ছড়িয়েছিল সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে। ভারত তাঁকে এখন আর ডাকে না। রঞ্জি আর কেকেআরই এখন গম্ভীরের পৃথিবী। বুধবারের আইপিএল যুদ্ধের গম্ভীর কিন্তু বুঝিয়ে গেলেন, তাঁর ব্যাটিং-শিল্পের মৃত্যু এখনও ঘটেনি। ১৩২ স্ট্রাইক রেট রেখে ৪৩ বলে ৫৭ দেখলে তাঁর ইনিংসের মাহাত্ম্য বোঝা যাবে না। বুঝতে হবে পরিস্থিতি। একশো সত্তর তাড়া করতে গিয়ে উথাপ্পা চলে গিয়েছেন। স্কোরটা পনেরো পেরোয়নি। ওই সময় তাঁর ব্যাটিংয়ে চিড় ধরলে বিপদ আসতে পারত। কিন্তু আসেনি। বরং মালিঙ্গাকে সাবলীল ভাবে সামলাতে দেখে এক সময় মনে হল, ইডেন কোথায়? গম্ভীরকে তো চার বছর আগের ওয়াংখেড়ে ফাইনালে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে! সামনে বড় স্কোর, টিম বিপদে, ছুটে আসছেন মালিঙ্গা আর ব্যাট হাতে তিনি।
মাঠে বাদশার উল্লাস। বুধবার।
দু’নম্বর ম্যাচ, সূর্যকুমার যাদব। টি-টোয়েন্টিতে তিনি কতটা মারাত্মক, এত দিনে সবাই জানে। কিন্তু বোধহয় তাঁর অনন্য টি টোয়েন্টি প্রতিভা এত দিনে ‘সুবিচার’ পেল! মাঝেমধ্যেই তাঁকে বলতে শোনা যায়, মুম্বই ইন্ডিয়ান্স তাঁকে যা দেয়নি, কেকেআর দিয়েছে। মুম্বইয়ে তিনি ডাগআউটে বসে থাকতেন। কেকেআরে তিনিই রেগুলার মিডল অর্ডার। শাহরুখ উদ্ধৃত ‘বেবি নাইট’ উপাধি থেকে বেরিয়ে কত দিনে তিনি পরিপূর্ণ ‘নাইট’ হবেন, সময় বলবে। শুধু আজকের মতো এটুকু বলা যায়, মুম্বই ইন্ডিয়ান্স বুঝে গেল সূর্য-রশ্মিতে পুড়তে হলে ঠিক কেমন লাগে! ২০ বলে ৪৬ নটআউট, আড়াইশোর কাছে স্ট্রাইকরেট রেখে পাঁচটা বিশাল ছক্কায় রোহিত শর্মার মুখ ফ্যাকাশে করে দেওয়া— বাদ কিছু দেননি কেকেআরের ‘মিস্টার ইম্প্রোভাইজেশন’। আর দু’নম্বর ম্যাচ সূর্য হলে অতি গুরুত্পূর্ণ তিন—সুনীল নারিন। আইপিএল আট শুরু পাঁচ দিন আগেও বোঝা যায়নি, আদৌ সুনীল নারিনকে পাবে কি না কেকেআর। পেল যখন, আশঙ্কা তৈরি হল নারিন খেললেও আগের মতো পারবেন তো? এ দিন দেখা গেল, হাত যেমন সোজাসুজি ভাবে আনতেন, তেমনই আনছেন। রিলিজের আগে সামান্য একটু রাউন্ড আর্ম হচ্ছে যেন। লোকে বলবে, আজ তিনি চার ওভারে আঠাশ দিয়েছেন। শুরু করেছেন চার দিয়ে। পরে ছক্কাও খেয়েছেন। উইকেট নেই। কিন্তু তাঁর উপর এত দিনের টানা অসহ্য চাপ ভাবতে হবে। যে বলগুলো একটু বাইরে পড়েছে, মার খেয়েছেন। কিন্তু যেগুলো লাইনে থাকল, রোহিত শর্মার মতো দুঁদে স্পিন-শিকারিকেও ‘ব্লক’ করে ছেড়ে দিতে হয়েছে। নারিন নিয়ে কোনও চূড়ান্ত রায়ে পৌঁছনোর আগে বোধহয় আরও গোটা তিনেক ম্যাচ দেখা উচিত। আর একটা ব্যাপার। কেকেআর বোলিং আজ শেষ ছ’ওভারে প্রায় নব্বই তুলতে দিল মুম্বইকে। উমেশ যাদব এক ওভারে একুশ খেলেন! অন্যান্য টিমের ক্ষেত্রে এটা খুব সাধারণ লাগবে। কিন্তু কেকেআরের ক্ষেত্রে নয়। কারণ গত আইপিএল থেকেই টিমটা সবচেয়ে কৃপণ বোলিং করে যাচ্ছে বাকিদের চেয়ে।
বুধবারের মোহিনী ইডেনের পাশে ও সব ছুটকো-ছাটকা যদিও অনায়াসে বাদ রাখা যায়। কারণ তার চেয়ে তো বেশি প্রাসঙ্গিক একটা রেকর্ড। আইপিএলে টানা দশে দশ হল। গত বার টানা নয়, এ বার এক। আর এখন সবে তো শুরু। মুম্বই গেল, আরসিবি শনিবার। তার পর আরও বারোটা।
আয়, তোরা আবার এক এক করে আয়!
সংক্ষিপ্ত স্কোর
মুম্বই ১৬৮-৩ (রোহিত ৯৮ ন.আ, মর্কেল ২-১৮)
কেকেআর ১৭০-৩ (গম্ভীর ৫৭)
ছবি: টুইটার, পিটিআই ও উৎপল সরকার।