সিমোন বাইলস। বিশ্বসেরা জিমন্যাস্ট। এই নামটির সঙ্গে কম বেশি অনেকেই পরিচিত। তাঁর নিখুঁত জিমন্যাস্টিক অভিভূত করে সারা বিশ্বকে। কিন্তু জানেন কি সিমোনের জীবনের প্রথম অধ্যায় ছিল অত্যন্ত কষ্টকর। এক সময় না খেয়ে দিন কাটাতে হত তাঁকে?
ছয় বছর বয়সে একটি ফিল্ড ট্রিপে গিয়ে প্রথম জিমন্যাস্টিক করেছিলেন সিমোন। ফিল্ড ট্রিপের ইনস্ট্রাক্টর দেখেই বুঝেছিলেন, এ মেয়ে কোনও সাধারণ মেয়ে নন। সে দিনই তিনি তাঁকে জিমন্যাস্টিক চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
তার দু’বছর পর থেকে অ্যামি বুরমানের অধীনে প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন সিমোন। ১৪ বছর বয়সে ২০১১ সালে প্রথম প্রতিযোগিতায় নামেন। হিউস্টনের আমেরিকান ক্ল্যাসিক্সে অলরাউন্ডে তৃতীয় হন, ভল্টে প্রথম এবং ফ্লোর এক্সসারসাইজে চতুর্থ।
এর পরের বছরই টেক্সাসে আমেরিকান ক্ল্যাসিক্সে অলরাউন্ডে প্রথম হন, ফ্লোর এক্সসারসাইজে দ্বিতীয় এবং ব্যালান্স বিমে তৃতীয় হন।
২০১৩-র মার্চে আমেরিকান কাপে প্রথম সিনিয়র দলে ডেবিউ করেন তিনি। তার পর ক্রমশ নিজের ভুলগুলো শুধরে নিয়ে ‘অতিমানব’ হয়ে উঠেছেন তিনি।
তিনিই যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম মেয়ে জিমন্যাস্ট যিনি এক অলিম্পিক্সে চারটি সোনা জিতেছিলেন। সব মিলিয়ে মোট ২৭টি সোনা, ৪টি রুপো এবং ৪টি ব্রোঞ্জ জিতেছেন তিনি।
বিশ্বসেরা এই জিমন্যাস্টের ছেলেবেলা কেটেছে খুব অবহেলা এবং অর্থকষ্টে। ঠিকমতো খাবারও জুটত না তাঁর।
সিমোনের জন্ম আমেরিকার কলম্বাসে। চার ভাইবোনের মধ্যে তৃতীয় ছিলেন তিনি।
তাঁদের মা শ্যানন বাইলস মাদক এবং মদের নেশায় দিনভর বুঁদ হয়ে থাকতেন। চার ছেলেমেয়ের দেখাশোনার কথা তিনি ভাবতেনই না। তারা কী খাচ্ছে, কী পরছে সে সব নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা ঘামাতেন না মা শ্যানন।
তাঁদের এ রকম অসহায় অবস্থা দেখে তাঁদের দাদু রন বাইলস এবং সৎ দিদা নেইলি কায়েটানো চার ভাইবোনের দেখভালের দায়িত্ব নিয়ে নেন।
মাকে ছেড়ে যেতে কষ্ট হয়েছিল ছোট্ট সিমোনের। কিন্তু এটা ভেবে তার ভাল লেগেছিল যে অন্তত ভাইবোনেরা একই বাড়িতে থেকে বড় হবে। সে ভাগ্যই বা কত জনের হয়!
এর তিন বছর পর, ২০০৩ সালে সিমোন এবং তাঁর বোন আদ্রিয়াকে দত্তক নিয়ে নেন দাদু-দিদা। তার পর থেকে আইনত তাঁরাই সিমোনের বাবা-মা হয়ে যান। আর দু’জনকে দত্তক নেন রনের বোন হ্যারিয়েট।
জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ের সূচনা হয় ওই দিন থেকেই। সিমোনের পড়াশোনা, জিমন্যাস্টিক সমস্ত কিছু দায়িত্ব নিয়ে করিয়েছেন তাঁরাই। দিনে ২০ থেকে ৩২ ঘণ্টা অনুশীলন করতেন সিমোন। তার জন্য স্কুল ছেড়ে ঘরেই পড়াশোনা শুরু করেন তিনি।
জিমন্যাস্টের পদে পদেও অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে তাঁকে। কখনও তাঁর বিরুদ্ধে ডোপিংয়ের অভিযোগ উঠেছে, কখনও যৌন হেনস্থার শিকার হয়েছেন।
ডোপ করেই ২০১৬-র রিও অলিম্পিক্সে দীপা কর্মকারকে হারিয়েছিলেন তিনি, রুশ হ্যাকারদের এমন অভিযোগে এক সময় জেরবার হতে হয়েছিল তাঁকে।
তাতে সিমোন জানিয়েছিলেন, ছোটবেলা থেকেই তাঁর একটা সমস্যা রয়েছে। যার নাম এডিএইচডি বা অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাকটিভিটি ডিজঅর্ডার। যে জন্য তাঁকে ওষুধ খেতে হয়। সর্বস্তরের সম্মতি নিয়েই ওই ওষুধ খেয়েছিলেন তিনি।
২০১৮ সালে ফের এক বার খেলা ব্যতীত ভিন্ন বিষয়ে চর্চায় উঠে আসেন সিমোন। যৌন হেনস্থার অভিযোগ এনেছিলেন ল্যারি নাসার বিরুদ্ধে। ল্যারি নাসা আমেরিকার জাতীয় জিমন্যাস্টিক্স দলের প্রাক্তন চিকিৎসক। তাঁর বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থা এবং শ্লীলতাহানির অভিযোগ এনেছিলেন সিমোন।
নেটমাধ্যমে নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে সিমোন লেখেন, ‘বেশির ভাগ মানুষ আমাকে চেনেন হাসিখুশি, চনমনে স্বভাবের একটি মেয়ে হিসেবে। কিন্তু সেই মেয়েটিই ওই ঘটনার পর একদম কুঁকড়ে গিয়েছিল মানসিক ভাবে’।
একাধিক সোনার পদক পেয়েছেন সিমোন। নিজের রেকর্ড নিজেই ভেঙে এগিয়ে গিয়েছেন। আমেরিকার এই জিমন্যাস্ট অনেক দিন আগেই নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন।
সম্প্রতি ইন্ডিয়ানাপোলিসে ইউএস ক্ল্যাসিক্স জিমন্যাস্টিক্সে মারণ ভল্ট দিয়ে ফের সাড়া ফেলে দিয়েছেন তিনি। ওই ভল্টটির নাম ইউরচেঙ্কো ডাবল পাইক। এটি এতটাই কঠিন এবং ঝুঁকির যে কোনও মেয়ে এর আগে দিতে সাহস পাননি।
জীবনের তৃতীয় অধ্যায়ের জন্যও প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন। ২০২০ থেকে আমেরিকার ফুটবল খেলোয়াড় জোনাথন ওয়েন্সের সঙ্গে ডেট করছেন তিনি।