বরাবর নবীনের আগমনী মঞ্চ হিসেবে দেখা হয় আইপিএলকে। এ বারে সেটাই ছিনিয়ে নেওয়ার লক্ষণ দেখাচ্ছিলেন প্রবীণরা।
কিংস ইলেভেন পঞ্জাবের জার্সিতে নিলামে উপেক্ষিত ৩৮ বছরের ক্রিস গেল। চেন্নাই সুপার কিংসের হলুদ জার্সিতে ৩৬ বছরের মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। অথবা ৩৬ বছর বয়সি শেন ওয়াটসন। কেকেআরের বেগুনি রংয়ে ঝলমলে ৩২ বছরের দীনেশ কার্তিক। এ বারের আইপিএলে শাসন করতে দেখা যাচ্ছিল অভিজ্ঞদেরই।
বৃহস্পতিবারের ইডেনে শিবম মাভি এবং শুভমান গিল— অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপজয়ী দুই সদস্যের হাত ধরে আইপিএল আবার হয়ে উঠল নবীনের জয়গানের মঞ্চ! এক জন বল হাতে আগুন ঝরালেন। সদ্য অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ খেলে আসা তরুণ নিয়মিত ভাবে ঘণ্টায় ১৪০ কিলোমিটার গতিবেগে বল করে যাচ্ছেন, এমন দৃশ্য বিরল। যেমন গতি রয়েছে, তেমনই ধারাল অস্ত্র ইনসুইং। হাতে ইনসুইং আসার কাহিনিটাও চমকপ্রদ। চোটে কাবু হয়ে বাড়িতে পড়েছিলেন শিবম। মাঠে ফিরে দেখেন আউটসুইং হারিয়ে গিয়েছে। যেটা তিনি বেশি করতে পারতেন। যখনই বল করতে যাচ্ছেন, ইনসুইং হচ্ছে। অবশেষে সেটাই অস্ত্র হয়ে গেল। কিংস ইলেভেন পঞ্জাব ম্যাচে ক্রিস গেলকে এই ইনসুইঙ্গারেই (বাঁ হাতি গেলের জন্য আউটসুইঙ্গার) দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন শিবম। এ দিন শান্ত করে রাখলেন বিধ্বংসী ফর্মে থাকা ধোনিকে। ইডেনে তিন ওভারে শিবম দিলেন ২১ রান। ধোনি এক বারই তাঁর অফস্টাম্পের উপর করা শর্ট বল পাঠিয়ে দিলেন মিডউইকেট গ্যালারিতে। এ ছাড়া তিনি যতটা ধোনিকে শান্ত রাখতে পেরেছিলেন, অস্ট্রেলিয়ার হয়ে ৭৩ টেস্ট এবং ১৫৩ ওয়ান ডে খেলা মিচেল জনসনও পারেননি।
ইডেনে ধোনি-ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধে নাইট আকাশে উদয় আর এক তারার। তিনি শিবমেরই অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ জয়ী দলের সতীর্থ, ডান হাতি ব্যাটসম্যান শুভমান গিল। অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপে মোট ৩৭২ রান করেছিলেন শুভমান। পঞ্জাবের কৃষকের সন্তান বড় হয়েছেন ক্রিকেটকে জড়িয়ে ধরে। বাবাই সব চেয়ে বেশি উৎসাহ দিয়ে গিয়েছেন। পঞ্জাবের ক্ষেতে কর্মীদের বলতেন, বল ছুড়ে ছুড়ে আমার ছেলেকে ব্যাটিং অনুশীলন করাও।
ইডেনে সচিন তেন্ডুলকর এবং বিরাট কোহালির ভক্তের ৩৬ বলে ৫৭ অপরাজিত দেখে উচ্ছ্বসিত ক্রিকেট দুনিয়া। মাইকেল ভন টুইট করলেন, ‘আরও এক অনূর্ধ্ব ১৯ তরুণের উত্থান আইপিএলে। এগিয়ে যাও শুভমান গিল’। আর ম্যাচ জিতিয়ে বেরিয়ে আসা শুভমানকে দেখে সুনীল গাওস্করের পর্যবেক্ষণ, ‘‘ওকে দেখে তো মনেই হচ্ছে না ঘাম ঝরিয়েছে। এটা দারুণ লক্ষণ।’’ টেস্টে দশ হাজার রানের এভারেস্টে প্রথম ওঠা সানি নিশ্চয়ই জানবেন।
দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, এটাই তো আইপিএলের মঞ্চ। যেখানে প্রতিভা মিলবে সুযোগের সঙ্গে আর তৈরি হবে রামধনুর রং। সেই জন্মলগ্ন থেকে আইপিএল আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের মতো নতুন নতুন সব প্রতিভা উপহার দিয়েছে। কখনও হার্দিক পাণ্ড্য। কখনও যশপ্রীত বুমরা। কখনও হায়দরাবাদের অটোরিক্সা চালকের ছেলে মহম্মদ সিরাজ। কখনও গোয়ার রেস্তোরাঁয় ওয়েটারের কাজ করা কুলবন্ত খেজরোলিয়া। দুর্ধর্ষ সব জীবন সংগ্রামের কাহিনি। ছোট ছোট শহর, গ্রাম থেকে উঠে আসা দুরন্ত সব প্রতিভা। অচেনাকে বিখ্যাত করে দেবে। নামকরণ করা যায় ক্রিকেটের কৌন বনেগা ক্রোড়পতি লিগ! সেটাই এ বছরে পাল্টাপাল্টি হওয়ার লক্ষণ দেখাচ্ছিল। ইডেনে বুক চিতিয়ে রুখে দিলেন রাহুল দ্রাবিড়ের দুই ছাত্র।
দুরন্ত: হাফসেঞ্চুরি করে নায়ক শুভমানও। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
আবার এক-এক সময় মনে হচ্ছে, প্রবীণদেরই বা পুরোপুরি মঞ্চ থেকে সরিয়ে দেওয়া গেল কোথায়? ধোনিকে নিয়ে যে আবেগ দেখা গেল বৃহস্পতিবারের ইডেনে, তা তো নজিরবিহীন। গ্যালারিটাই যেন হলুদ স্রোতে ভেসে যাচ্ছিল। যে-ই বল ধরুন না কেন, ইডেন চিৎকার করছে ‘ধো-নি, ধো-নি’। এর মধ্যে হলুদ জার্সিতে এক ভক্ত কোথা থেকে এসে ঢুকে পড়ল চেন্নাই সুপার কিংসের ডাগআউটে। ধোনি তখন একদম ডান দিকটায় বসা। এর পরেই ব্যাট করতে যাবেন বলে বোঝাই যাচ্ছিল, মনঃসংযোগ করছেন। ব্যাঘাত ঘটায় তাঁর মতো শান্ত লোকও বিরক্ত। এর পর সম্প্রচারকারী চ্যানেলের ক্যামেরাম্যানকেও সরিয়ে দিলেন।
‘ক্যাপ্টেন কুল’ ক্রিজে আসা মাত্র অভিনব অভ্যর্থনার ব্যবস্থা করল ইডেন। মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে দিলেন দর্শকেরা। দেখে মনে হচ্ছিল যেন স্বঘোষিত দীপাবলি উৎসব। ক্লাব হাউসের উপরের তলায় তখন হাঁটা যাচ্ছে না। সিট তো গিজগিজ করছেই, অনেকে নীচে সিঁড়িতেও বসা। বেশির ভাগ হলুদ জার্সি গায়ে। ২৫ বলে ৪৩ অপরাজিত নিয়ে ধোনিই তাঁর দলের সর্বোচ্চ স্কোরার। চারটি ছয়। স্ট্রাইক রেট ১৭২। সিএসকে-র ১৭৭-৫ কেকেআর তুলে দিল ১৪ বল বাকি থাকতে। ছয় উইকেটে জিতে তিন নম্বরে উঠে এল কেকেআর। প্লে-অফের দৌড়ে তারা ভাল মতোই রয়েছে। ধোনির পাশে উজ্জ্বল নাইটদের উইকেটকিপার-অধিনায়ক। ১৮ বলে ৪৫ নট আউট না থাকলে শুভমানদের স্বপ্নপূরণ হয় না।
সিএসকে-র যেমন ধোনি, তেমনই কেকেআর-এর মুখ হলেন সুনীল নারাইন। অধিনায়ক ধোনিকে কখনও ছাড়েননি শ্রীনিবাসন। তেমনই শাহরুখ খান যেতে দেন না নারাইনকে। বোলিং অ্যাকশনে ত্রুটি ধরা পড়ার পরে নারাইনের দেশের হয়ে খেলা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কেকেআর তাঁকে ছাড়েনি। তাঁর জন্য বিশেষজ্ঞ কোচ এনে তালিম দিয়ে অ্যাকশন ঠিক করিয়েছে।
সুনীল নারাইন সেই ভালবাসার প্রতিদান দিয়ে চলেছেন। এ দিনও চার ওভারে ২০ রান দিয়ে দুই উইকেট, ব্যাটে ২০ বলে ৩২। ম্যাচের সেরা তিনিই। ইডেনের আকাশে দুই নতুন নাইটের উদয়ের রাতেও সেই সুনীল আকাশ! নবীন বরণের মঞ্চেও পুরনো জপমন্ত্রটা থেকেই গেল—‘নারাইন-নারাইন!’