নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসন কি আর ভারতীয় বোর্ডে ফিরে আসতে পারবেন?
শরদ পওয়ার, আই এস বিন্দ্রার মতো সত্তরোর্ধ্ব কর্তাদের ভাগ্যেই বা কী আছে?
কী হবে অনুরাগ ঠাকুর, রাজীব শুক্ল, অরুণ জেটলিদের মতো রাজনীতিবিদদের?
ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড এত দিন চলে এসেছে গোছানো এক পারিবারিক ব্যবসার মতো। কিন্তু এ বার লোঢা কমিশনের রিপোর্টে ধাক্কা লাগতে পারে সেই কাঠামোতেই!
দিল্লির তিনমূর্তি ভবনের অডিটোরিয়াম। সোমবার দুপুর বারোটা। যেখানে বিচারপতি লোঢা কমিশনের চূড়ান্ত রিপোর্ট জমা পড়তে চলেছে। যে রিপোর্টের সুপারিশ মানলে আমূল বদলে যেতে পারে বিসিসিআইয়ের চেহারাটাই। এমনই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।
ওই রিপোর্টে কী কী সুপারিশ থাকতে চলেছে?
ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আর এম লোঢা, বিচারপতি অশোক ভান ও অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আর ভি রবীন্দ্রনের দেওয়া এই রিপোর্টে পেশাদারিত্বের মোড়কে বোর্ডকে মুড়ে ফেলার সুপারিশ করতে পারে কমিশন। ক্রিকেটের বাইরের জগৎ থেকে আসা রাজনীতিক ও শিল্পপতিদের মতো অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন বোর্ড কর্তাদের ডানা ছাঁটা হতে পারে। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে এই সুপারিশ কার্যকর হলে বোর্ড রাজনীতিতে শ্রীনিবাসনের মতো শিল্পপতিদের ফেরার পথ পাকাপাকি ভাবে বন্ধ হয়ে যাবে কি না। মসনদে থাকা অনুরাগ ঠাকুর, রাজীব শুক্লদেরও বোর্ড ছাড়তে হবে কি না, তা নিয়েও জল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছে।
এমন সুপারিশও নাকি করা হচ্ছে, যাতে সত্তরোর্ধ্ব কর্তাদের অবিলম্বে বিদায় জানাতে হতে পারে বোর্ড ও রাজ্য ক্রিকেট সংস্থাগুলিকে। সে ক্ষেত্রে শরদ পওয়ার, আইএস বিন্দ্রাদের মতো প্রবীণ ক্রিকেট প্রশাসকদের ভবিষ্যৎ কী, তা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। তিরিশ বছরের বেশি পদে থাকলে তাদের সরিয়ে দেওয়ার সুপারিশও নাকি থাকছে রিপোর্টে। রিপোর্টে নাকি আরও চাওয়া হবে, প্রাক্তন ক্রিকেটাররা বোর্ড প্রশাসনে আসুক। তবে তাদের আগে রাজ্য সংস্থার সদস্য হতে হবে।
বিচারপতি লোঢা পরিষ্কার করে দিয়েছেন, দুটো জিনিস বোর্ডের কাছ থেকে দেখতে চান তাঁরা। এক, স্বচ্ছতা। দুই, দায়িত্ববোধ।
বোর্ড প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার পর শশাঙ্ক মনোহরের সঙ্গে লোঢা কমিশনের সদস্যরা বসেছিলেন এক বৈঠকে। সেই বৈঠকেই নাকি মনোহর ইঙ্গিত পেয়ে যান কমিশন কোন কোন বিষয়ের উপর বাড়তি গুরুত্ব দিতে চলেছে তাদের রিপোর্টে।
সেটা বোঝার পরই বোর্ড ও বিভিন্ন রাজ্য সংস্থার সদস্য, কর্মী, ক্রিকেটার, কোচ ও নির্বাচকদের উদ্দেশে তিন পাতার যে নির্দেশিকা মনোহর পাঠান, তাতে স্বার্থসংঘাত এড়ানোর নির্দেশ ছিল স্পষ্ট। বোর্ডের অনুদান ঠিক মতো ব্যয় হচ্ছে কি না, সেই সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য। বোর্ডের ওয়েবসাইটে ব্যালান্সশিট ও বিভিন্ন খাতে বড় খরচের হিসাব, এমনকী কোন প্রাক্তন ক্রিকেটারকে কত টাকা পেনশন দেওয়া হয়, তার বিবরণ পর্যন্ত প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেন বোর্ড প্রেসিডেন্ট।
শোনা যাচ্ছে, লোঢা কমিশন সুপারিশ করবে, বিসিসিআই-কে তামিলনাড়ু সোসাইটি রেজিট্রেশন অ্যাক্টের আওতা থেকে বার করে এনে ‘পাবলিক ট্রাস্ট’ হিসেবে নথিভুক্ত করা হোক। যাতে বোর্ডের কাজকর্ম সব কিছু জনসমক্ষে আনা যায়। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদকেও সাম্মানিক হিসেবে না রেখে কর্পোরেট প্রথায় এই সব পদে বেতনভূক পেশাদারদের নিয়োগ করা উচিত। এর জেরে বোর্ডের ওয়ার্কিং কমিটি বলেও কিছু থাকবে কি না, এই প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছে। হয়তো ‘বোর্ড অফ ডিরেক্টর্স’-এর হাতেই চলে যাবে আসল ক্ষমতা।
শোনা যাচ্ছে আইপিএল কাউন্সিলকে-কে নিছকই বোর্ডের একটি সাব কমিটি হিসেবে না রেখে তাকে আলাদা একটি প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি করার সুপারিশ করবে লোঢা কমিশন। যাদের ‘প্রফিট সিকিং অর্গানাইজেশন’ বা লাভজনক সংস্থা হিসেবেই দেখা হবে ও লভ্যাংশ ভবিষ্যতে বিনিয়োগ করবে তারা।
বর্তমান ক্রিকেট কর্তারা সম্ভাব্য এই সুপারিশগুলিকে যে ভাল মনে মেনে নিচ্ছেন, তা বোধহয় নয়। রাজনীতি থেকে আসা এক ক্রিকেট কর্তা রবিবার যেমন মিশেল প্লাতিনির দৃষ্টান্ত তুলে ধরে বলেছেন, ‘‘প্রাক্তন খেলোয়াড় মানেই যে যোগ্য প্রশাসক হবে, তার কোনও মানে আছে? এই তো মিশেল প্লাতিনিকেই দেখুন না। কী কাণ্ডটাই না করল। তা ছাড়া ডালমিয়া, এনকেপি সালভে, আইএস বিন্দ্রারা খেলোয়াড় না হয়েও দেশের ক্রিকেটে যথেষ্ট উন্নতি এনেছেন।’’
লোঢা কমিশনের সুপারিশ বোর্ডকে পুরোটাই মানতে হবে, না কি আংশিক মানলেও চলবে, তা ঠিক করে দেবে শীর্ষ আদালতই। প্রধান বিচারপতি টিএস ঠাকুর ও বিচারপতি খলিফুল্লাহ (এঁদের কাছেই রিপোর্ট জমা পড়ার এবং শুনানি হওয়ার কথা) যদি সুপারিশগুলি সব অক্ষরে অক্ষরে মেনে নিতে বলেন, তা হলে এ রকম কোনও যুক্তিই ধোপে টিকবে না। ভারতীয় ক্রিকেট প্রশাসন নতুন এক বিপ্লব দেখবে। সেটা কতটা সুদূরপ্রসারী হতে পারে, তার ইঙ্গিত হয়তো পাওয়া যাবে আজ।