ইয়েলেনা অস্টাপেঙ্কো। ছবি: রয়টার্স।
২০১৭-য় টেনিসবিশ্বকে চমকে দিয়ে অবাছাই হিসাবে ফরাসি ওপেন জিতেছিলেন। তার পর টেনিস কোর্ট থেকে এক রকম হারিয়েই গিয়েছিলেন। চোট এবং খারাপ ফর্ম চলছিল ধারাবাহিক ভাবেই। আবার স্বমহিমায় ফিরলেন ইয়েলেনা অস্টাপেঙ্কো। মেয়েদের এক নম্বর বাছাই ইগা শিয়নটেককে হারিয়ে ইউএস ওপেনের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে বুঝিয়ে দিলেন তিনি এখনও ফুরিয়ে যাননি। ইগাকে এখনও পর্যন্ত কেউ টানা চার বার হারাতে পারেননি। অস্টাপেঙ্কো সেটাই অনায়াসে করে দেখালেন।
ইউরোপের ছোট দেশ লাটভিয়া থেকে উঠে এসেছেন। অস্টাপেঙ্কোর আগে সে দেশের কোনও খেলোয়াড় গ্র্যান্ড স্ল্যাম জেতা তো দূর, খুব বেশি রাউন্ড এগোতেই পারেননি। তাই অস্টাপেঙ্কো যা করেন সেটাই নজির। ১৯৩৩-এর পর প্রথম অবাছাই খেলোয়াড় হিসাবে ফরাসি ওপেন জিতেছিলেন। পকেটে রয়েছে জুনিয়র উইম্বলডন ট্রফিও। সিঙ্গলসের পাশাপাশি ডাবলসেও খেলেন। কিন্তু এক সময় বিশ্বের পাঁচ নম্বর খেলোয়াড় হলেও পরবর্তী কালে টেনিসজীবনের রেখচিত্র ক্রমশই নীচে নেমেছে। সেখান থেকে আবার নতুন করে উত্থান হয়েছে অস্টাপেঙ্কোর।
লাটভিয়ার রাজধানী রিগাতে ৮ জুন, ১৯৯৭ সালে জন্ম অস্টাপেঙ্কোর। বাবা জেভজেনিস ছিলেন ইউক্রেনের প্রাক্তন ফুটবলার। মা ইয়েলেনা জাকোভলেভা ছিলেন লাটভিয়া এবং রাশিয়ার টেনিস কোচ এবং প্রাক্তন খেলোয়াড়। ফলে খেলাধুলোর পরিবেশেই বড় হয়েছেন অস্টাপেঙ্কো। পাঁচ বছর বয়সে মায়ের হাত ধরেই টেনিসে আসা। তারপর সেরিনা উইলিয়ামসকে দেখে বেড়ে ওঠা।
কিন্তু টেনিসই অস্টাপেঙ্কোর একমাত্র প্রেম ছিল না। তিনি নাচেও পারদর্শী। টেনিসের সঙ্গে একই বয়সে তিনি নাচের তালিম নিতে শুরু করেন। সেখানেও সাফল্য পান। লাটভিয়ার জাতীয় স্তরের বলরুম নাচ প্রতিযোগিতায় জিতেছেন। কিন্তু ১২ বছর বয়স থেকে টেনিসে পুরোপুরি মনোযোগ দিতে শুরু করেন। অস্টাপেঙ্কো স্বীকার করেন, নাচের জন্যেই টেনিস কোর্টে তাঁর নড়াচড়া বাকিদের থেকে আলাদা। অনেক বেশি স্বচ্ছন্দে এবং সাবলীল ভাবে কোর্টে ওঠানামা করতে পারেন তিনি।
২০১৪ সালে প্রথম বার জুনিয়র উইম্বলডন জেতেন অস্টাপেঙ্কো। জুনিয়রদের র্যাঙ্কিংয়ে দু’নম্বরে উঠে এসেছিলেন। ডব্লিউটিএ ইভেন্টে প্রথম বার আসা সে বছরই। তাসখন্দ ওপেনে খেলতে নেমেছিলেন। তার পরের বছর উইম্বলডনের মাধ্যমে গ্র্যান্ড স্ল্যামে অভিষেক হয়। আবির্ভাবেই নবম বাছাই কার্লা সুয়ারেস নাভারোকে হারিয়ে চমকে দিয়েছিলেন। ইউএস ওপেনে দ্বিতীয় রাউন্ডে বিদায় নেন।
২০১৬-য় কাতার ওপেনের ফাইনালে উঠেছিলেন অস্টাপেঙ্কো। তখনকার বিশ্বের আট নম্বর পেত্রা কিতোভাকে হারান। র্যাঙ্কিংয়ে চড়চড় করে উপরের দিকে উঠছিলেন তিনি। সে বছরের ফরাসি ওপেনে প্রথম বার বাছাই খেলোয়াড় হিসাবে নামেন। কিন্তু প্রথম ম্যাচেই হেরে যান।
২০১৭ সাল এখনও পর্যন্ত অস্টাপেঙ্কোর জীবনে সেরা বছর। অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে প্রথম বার কোনও গ্র্যান্ড স্ল্যামের তৃতীয় রাউন্ডে ওঠেন। ফরাসি ওপেনে হাতে ওঠে ট্রফি। ক্যারোলিন উজনিয়াকির মতো খেলোয়াড়কে হারিয়ে সেমিফাইনালে উঠেছিলেন। লাটভিয়ার প্রথম মহিলা খেলোয়াড় এবং প্রথম টিনএজার হিসাবে গ্র্যান্ড স্ল্যামের সেমিফাইনালে ওঠেন। ১৯৮৩ সালে মিমা জাউসোভেচের পর প্রথম অবাছাই হিসাবে ফাইনালে ওঠেন। ফাইনালে প্রথম সেটে হেরে গিয়েও দারুণ ভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে হারিয়ে দেন সিমোনা হালেপকে। গুস্তাভো কুয়ের্তেনের পর অস্টাপেঙ্কোই প্রথম টেনিস খেলোয়াড়, যাঁর জীবনের প্রথম ট্রফিটাই গ্র্যান্ড স্ল্যাম।
পরের বছর ফরাসি ওপেনেই অঘটন। প্রথম রাউন্ড থেকেই ছিটকে যান অস্টাপেঙ্কো। ২০১৮ সাল থেকেই তাঁর পতনের শুরু। একের পর এক প্রতিযোগিতার প্রথম রাউন্ড থেকে ছিটকে যাচ্ছিলেন। সিঙ্গলসে ব্যর্থ হওয়ার পর মন দেন ডাবলসে। সেখানে কিছুটা সফল হন। চারটি ডব্লিউটিএ খেতাব জেতেন। কিন্তু সিঙ্গলসে সেই পুরনো ফর্ম ফিরে পাচ্ছিলেন।
২০২৩ থেকে আবার সিঙ্গলসে পুরনো খেলা দেখাতে শুরু করেছেন অস্টাপেঙ্কো। লাটভিয়ার প্রথম খেলোয়াড় হিসাবে এ বার অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের কোয়ার্টারে ওঠেন। জিতেছেন বার্মিংহাম ক্লাসিক। ফাইনালে উঠেছেন ইটালিয়ান ওপেনের। অবশেষে শীর্ষ বাছাইকে ছিটকে দিয়ে আবার শিরোনামে উঠে এসেছেন।
খেলোয়াড় হিসাবে বেসলাইনে বেশি স্বচ্ছন্দ তিনি। আগ্রাসী খেলাই তাঁর মূলমন্ত্র। ঝুঁকি নিতেও পিছপা হন না। শক্তিশালী ফোরহ্যান্ড এবং ব্যাকহ্যান্ড থাকার কারণে অবলীলায় উইনার মারতে পারেন। তেমনই ঝুঁকি নিতে গিয়ে করেন আনফোর্সড এররও। দীর্ঘ ক্ষণ ধরে পয়েন্ট খেলতে ভালবাসেন না। দ্রুত ম্যাচ শেষ করতে চান। তাই প্রিয় শট হল ক্রসকোর্ট ফোরহ্যান্ড, ডাউন দ্য লাইন ব্যাকহ্যান্ড, সুইং করা ভলি এবং ড্রপ শট। প্রধান দুর্বলতা তাঁর সার্ভ। প্রথম সার্ভ ভাল হলেও দ্বিতীয় সার্ভ খুবই দুর্বল। একদমই ধারাবাহিক নন। সে কারণে প্রায়ই ডাবল ফল্ট হয়। পাশাপাশি তিনি বেশ চোটপ্রবণ। বেশ কয়েক বার চোটের কারণে খেলতে পারেননি গ্র্যান্ড স্ল্যামে। তবে সেই সমস্যা মিটিয়ে আবার তাঁকে দেখা যাচ্ছে পুরনো ফর্মে।
এহেন ইয়েলেনার নাম নিয়ে ছোটবেলা থেকেই তৈরি হয়েছিল সমস্যা। তাঁর পরিবারের লোকেরা অ্যালোনা বলে ডাকতেন। কিন্তু সেই নামটি লাটভিয়ার সরকারি নামের তালিকায় ছিল না। ফলে তাঁর নাম ইয়েলেনা রাখা হয়। এখন লাটভিয়া সরকার সেই নিয়ম বদলে দিয়েছে। লাটভিয়া এবং বাকি সব জায়গায় অস্টাপেঙ্কোকো অ্যালোনা নামে ডাকা হলেও আইনি ঝামেলা এড়াতে তিনি ইয়েলেনাই ব্যবহার করেন। এখন দেখার, তাঁর হাতে আর কোনও অঘটন ঘটে কি না।