অক্লান্ত: নিজেকে আরও উন্নত করতে চান অ্যান্ডারসন। ফাইল চিত্র
সেই ১৭ বছর আগে, লর্ডসে জ়িম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে ছেলেটা যখন বল হাতে দৌড় শুরু করেছিলেন, কেউ ভাবতেও পারেননি এক দিন টেস্টে ৬০০ উইকেটের মালিক হয়ে উঠবেন তিনি। প্রথম পেসার হিসেবে এই অবিশ্বাস্য মাইলফলক ছুঁয়েই অবশ্য থেমে যেতে চান না জিমি অ্যান্ডারসন। ৩৮ বছর বয়সি ইংল্যান্ড পেসারের পরবর্তী লক্ষ্য, ৭০০ টেস্ট উইকেট পাওয়া! অ্যান্ডারসন নিজেই বলেছেন, ‘‘৭০০ উইকেট কি আমি পেতে পারি? কেন নয়?’’
এক জন পেসার যে কখনও ৬০০ ক্লাবের সদস্য হতে পারেন, তা বোধ হয় ভাবতে পারেননি কেউই। যে কারণে অভিনন্দনের ঢেউ আছড়ে পড়ছে। মুগ্ধ সচিন তেন্ডুলকরের টুইট, ‘‘১৭ বছরের ক্রিকেট জীবনে ৬০০ টেস্ট উইকেট তোমার মানসিক কাঠিন্য, অধ্যবসায় এবং নিখুঁত বোলিংয়েরই প্রতিফলন।’’ অ্যান্ডারসনে মুগ্ধ ভারত অধিনায়ক বিরাট কোহালির টুইট-বার্তা, ‘‘৬০০ উইকেট। সত্যি দুর্দান্ত কৃতিত্ব। নিশ্চিত ভাবে আমার খেলা অন্যতম সেরা বোলার।’’ ভারতের প্রাক্তন অধিনায়ক এবং বর্তমান বোর্ড প্রেসিডেন্ট সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘৬০০ উইকেট দুর্দান্ত একটা মাইলফলক। এক জন পেসার ১৫৬ টেস্ট খেলছে, এটা ভাবাই যায় না।’’
টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারির তালিকায় একচেটিয়া আধিপত্য স্পিনারদেরই। মুথাইয়া মুরলীধরনের ঝুলিতে ৮০০ উইকেট, শেন ওয়ার্নের শিকারের সংখ্যা ৭০৮। অনিল কুম্বলে পেয়েছেন ৬১৯ উইকেট। স্পিনারদের ক্ষেত্রে বলা হয়ে থাকে, তাঁদের পরিণত হতে সময় লাগে এবং দীর্ঘদিন ধরে খেলে যেতে পারেন। উপরের তিন স্পিনারের ক্ষেত্রে একটা মিল পাওয়া যায়। ওয়ার্ন, কুম্বলে এবং মুরলী— তিন জনেই টেস্ট ক্রিকেটকে বিদায় জানান ৩৮ বছর বয়সে।
সেখানে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তৃতীয় টেস্টের শেষে অ্যান্ডারসন বলেছেন, ‘‘জো রুটের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। ও বলেছে, পরের বছর অস্ট্রেলিয়া সফরে আমাকে দলে চায়। আমি তো অ্যাশেজে না খেলার কোনও কারণ দেখছি না। ফিটনেসের উপরে জোর দিচ্ছি, উন্নত করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’’ অ্যান্ডারসনের এই কথার মধ্যেই লুকিয়ে তাঁর সাফল্যের চাবিকাঠি। এক, নিজেকে ক্রমাগত উন্নত করার মরিয়া চেষ্টা। দুই, ফিটনেস।
প্রথম দিন থেকেই কিন্তু অ্যান্ডারসন দু’দিকে সুইং করাতে পারতেন না। জ়িম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে অভিষেক টেস্টে এক ইনিংসে পাঁচ উইকেট নিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু পূর্ণাঙ্গ সুইং বোলার হয়ে উঠতে তাঁর আরও বছর পাঁচেক সময় লাগে। যার পরে দু’দিকেই বল সুইং করানোর বিরল ক্ষমতা আয়ত্ত করেন তিনি। পেস বোলারদের মধ্যে উইকেটশিকারির তালিকায় দু’নম্বরে থাকা গ্লেন ম্যাকগ্রাও মুগ্ধ অ্যান্ডারসনে। টেস্টে ৫৬৩ উইকেট পাওয়া অস্ট্রেলিয়ার কিংবদন্তি পেসার বলেছেন, ‘‘অ্যান্ডারসনের মতো দক্ষতা আমার নেই। যখন ও নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে দু’দিকেই বল সুইং করায়, তখন ওর চেয়ে ভাল আর কেউ হয় না।’’
তবে উপমহাদেশের নিষ্প্রাণ পিচে সফল হওয়ার জন্য অ্যান্ডারসনকে নিজের দক্ষতা আরও পালিশ করতে হয়েছে। অস্ত্রভাণ্ডারে যোগ করতে হয়েছে রিভার্স সুইং। এই রিভার্স সুইংয়েই ২০১২ সালে ইডেনে ভারতকে ভেঙেছিলেন তিনি। পরে সচিনের মুখেও শোনা গিয়েছিল অ্যান্ডারসনের রিভার্স সুইংয়ের প্রশংসা। এর পরে আরও একটি বিশেষ বল আয়ত্ত করেছিলেন সর্বকালের অন্যতম সেরা এই পেসার। অফস্টাম্পের উপরে পড়া গুডলেংথ স্পট থেকে বাড়তি বাউন্স পাওয়া একটা ডেলিভারি। যা বেরিয়ে যাওয়ার মুখে ছোবল মারে ব্যাটে। অ্যান্ডারসনের ৬০০তম উইকেট, পাকিস্তানের আজহার আলি এ রকমই একটা বলের শিকার। ওয়াসিম আক্রম, ডেল স্টেনের মতো কিংবদন্তি ফাস্ট বোলাররাও মুগ্ধ অ্যান্ডারসনের সাফল্যে। এ দিন আইসিসি টেস্ট র্যাঙ্কিংয়ে আট নম্বরে উঠে এলেন অ্যান্ডারসন।
ফিটনেসের সমস্যায় অ্যান্ডারসন মাঝে, মাঝে ভুগলেও তা কখনওই তাঁকে দীর্ঘদিন ক্রিকেটের বাইরে রাখেনি। একটা ছোট্ট পরিসংখ্যানই তাঁর ফিটনেসের মাপকাঠি বুঝিয়ে দেবে। ১৫৬ টেস্টে এখনও পর্যন্ত ৩৩,৭৪৫টি বল করেছেন অ্যান্ডারসন। পেসারদের মধ্যে টেস্টে বল করার নিরিখে এক নম্বরে। দু’নম্বরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কোর্টনি ওয়ালশ (৩০,০১৯)।
ক্রিকেটমহলে অনেকের কাছে অ্যান্ডারসন আবার ‘ম্যারাথন ম্যান’ বলেও পরিচিত। কারণ, বিশ্লেষকরা দেখেছেন, ইংল্যান্ডের হয়ে বল হাতে মোটামুটি ৬০০ কিলোমিটার দৌড়ে ফেলেছেন তিনি। তাঁর মসৃণ রানআপ এবং নিখুঁত অ্যাকশন অ্যান্ডারসনকে এতদূর নিয়ে এসেছে বলেও অনেকের ধারণা।