দাদা মহম্মদ হাবিব ও বন্ধুদের সাথে এক ফ্রেমে মহম্মদ আকবর। বাঁদিক থেকে প্রথম। পারিবারিক অ্যালবাম থেকে।
সাত ও আটের দশকে তাঁকে কলকাতা ময়দানের ‘বাদশা’ বলা হত। তিন প্রধানে খেলা মহম্মদ আকবরের এতটাই প্রতিপত্তি ছিল যে, শুধু বিপক্ষ দল নয়, তাঁর দাদা মহম্মদ হাবিব পর্যন্ত ভাইকে সমীহ করতেন। কারণ ডার্বি যুদ্ধে তাঁর করা ১৭ সেকেন্ডের গোল। দীর্ঘ ৪৫ বছর পরে যা আজও ‘বড় ম্যাচ’-এর ইতিহাসে দ্রুততম গোল হিসেবে রয়ে গিয়েছে।
হায়দরাবাদ নিবাসী ভারতীয় ফুটবলে অনেক দ্যুতি ছড়িয়েছেন। তবুও তাঁর কেরিয়ারের সেরা ম্যাচ বলতে গেলে এখনও ১৯৭৬ সালে ইডেন গার্ডেন্সে আয়োজিত সেই ডার্বি ম্যাচের কথা চলে আসে। আর কয়েক ঘণ্টা পরেই ফতোরদা স্টেডিয়ামে এসসি ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে মাঠে নামবে এটিকে মোহনবাগান। তবে এখনও সেই গোল নিয়ে একই রকম রোমাঞ্চিত আকবর সাহেব।
৪৫ বছর আগে এমনই এক ডার্বি ম্যাচে ১৭ সেকেন্ডে গোল করে ভারতীয় ফুটবলে অনন্য নজির গড়েছিলেন মহম্মদ আকবর। খেলা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই নারায়ণস্বামী উলগানাথনের ক্রস থেকে ১৭ সেকেন্ডের মাথায় হেডে গোল করেন আকবর। মোহনবাগান ১-০ গোলে সেই ম্যাচটা জিতেছিল। সেই ঐতিহাসিক ডার্বি নিয়ে এখনও একই রকম রোমাঞ্চিত প্রাক্তন স্ট্রাইকার। হায়দরাবাদের বাড়ি থেকে আনন্দবাজার ডিজিটালকে বলছিলেন, “১৯৭৫ সালে ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে ৫-০তে হারের পর, ১৭ সেকেন্ডের ওই গোলটা ছিল মোক্ষম জবাব। কারণ দীর্ঘ ৬ বছর পর ডার্বি জয়ের স্বাদ পেয়েছিল সবুজ-মেরুন।” এরপরেই জুড়ে দিলেন, “১৯৭৫ সালে আমি মহমেডানে ছিলাম। তবে কলকাতায় থাকার সুবাদে লাল-হলুদের সেই হারের আঁচ বেশ টের পাই। আর ভাল লাগার ব্যাপার হল আমার সেই গোলের জন্য মোহনবাগান সেই ডার্বি জেতার পাশাপাশি সেই মরসুমেও দল ঘুরে দাঁড়িয়েছিল।”
কেমন ছিল সেই ডার্বির স্মৃতি? আকবর স্মৃতির ঝুলি উপড়ে দিলেন। সেই ম্যাচ যেন এখনও তাঁর কাছে জীবন্ত। বলছিলেন, “৭৫’এর ডার্বিতে একরাশ লজ্জা হজম করার পর মারাত্মক চাপ তৈরি হয়েছিল। সেটা আমার দাদা মহম্মদ হাবিব, দলের অধিনায়ক প্রশান্ত মিত্র, সুব্রত ভট্টাচার্য থেকে শুরু করে আমাদের কোচ প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ও প্রচুর চাপে ছিলেন, যা ড্রেসিংরুম পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। ইডেনে সেই ম্যাচ আয়োজিত হওয়ার দুই-তিন আগে থেকে শুরু হল ব্যাপক বৃষ্টি। ২৪ জুলাইয়ের সেই ম্যাচ শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ আগেও জোরে বৃষ্টি হয়েছিল। এক হাঁটু কাদা হয়ে যাওয়ার জন্য মাঠে দাঁড়ানোই যাচ্ছিল না। তবুও খেলা শুরু হতেই গোলের খোঁজে আমি ইস্টবেঙ্গল বক্সের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হাবিব ভাই মাঝমাঠ থেকে উল্গার দিকে বল বাড়ান। সেই ক্রস উল্গা আমার দিকে তুলতেই বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে ইস্টবেঙ্গলের জালে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম।”
সেই গোলের জন্য অবশ্য প্রয়াত কোচ প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কেও ধন্যবাদ জানালেন নিজামের শহরের এই ডার্বি গোলদাতা। বললেন, “ইস্টবেঙ্গলের গোলে ছিল তরুণ বসু। এর আগের মরসুমে প্রদীপদা লাল-হলুদের কোচিং করানোর সুবাদে তরুণের একটা দুর্বল দিক জানতেন। তরুণের একটা সংস্কার ছিল। খেলা শুরু হয়ে গেলেও ও দুই হাতের দস্তানা পড়ত না। ওদের ডিফেন্ডার বল পায়ে না লাগালে তরুণ ওর বাঁ হাতে দস্তানা ঢোকাত না। আর সেটা খুব ভালভাবে জানতেন প্রদীপ দা। সেটা ম্যাচ শুরু হওয়ার আগে এই বিষয়টা আমাদের বলেছিলেন। আমি ওর এই দুর্বলতার সুযোগে গোল করে দিয়েছিলাম। কারণ, উল্গার ক্রস থেকে আমি যখন হেড দিতে উঠছিলাম, তখন তরুণ ওর বাঁহাতে দস্তানা ঢোকাচ্ছিল!”
আর কিছুক্ষণ পর আরও একটা ডার্বি। যদিও এই প্রাক্তন তেমন আগ্রহ দেখালেন না। ম্যাচটা কি দেখেবেন? ময়দানের ‘ছোটে মিয়াঁ’ শেষে যোগ করলেন, “আধুনিক যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দুই প্রধান আইএসএল খেলছে। সেটা ভাল কথা। কিন্তু আবেগ ও আন্তরিকতা বড্ড কম। ম্যাচ দেখব কিনা ঠিক করিনি। তাছাড়া মাঠে তো এবার দর্শক নেই। ডার্বি ম্যাচ খেলার সময় সমর্থকদের চিৎকার কানে না এলে সেই খেলার আর মজা কোথায়!”