ISL 2020

মোহনবাগান +৩, ইস্টবেঙ্গল -৩, বাংলার দুই প্রধানের প্রাথমিক পোস্টমর্টেম

সবে তিনটি করে ম্যাচ খেলেছে কলকাতার দুই ক্লাব। ‘দিল্লি’ এখন ঢের দূর। তবে সকাল দেখে দিন কেমন যাবে অনেকটা তো বোঝা যায়, সবটা না হলেও...

Advertisement

কৃশানু মজুমদার

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০২০ ১৬:৩৩
Share:

চাপে ফাওলার। ফুরফুরে মেজাজে হাবাস।

৩ ম্যাচের ৩টিতেই জয়। একটিও গোল না খেয়ে, পয়েন্ট টেবলে ৯ পয়েন্ট নিয়ে সবার উপরে এটিকে-মোহনবাগান।
৩ ম্যাচের ৩টিতেই হার। একটি গোলও না করে, কোনও পয়েন্ট না পেয়ে লিগ টেবলের তলায় এসসি-ইস্টবেঙ্গল।
এ বারের আইএসএল-এ এখনও পর্যন্ত কলকাতার দুই বটবৃক্ষ ক্লাবের এটাই স্কোরশিট। এই বিস্তর ফারাক গড়ে দিল কোন কোন ফ্যাক্টর। কলকাতার প্রাক্তন ফুটবলারদের সঙ্গে নিয়ে তারই ময়নাতদন্ত রিপোর্ট।

Advertisement

ইস্টবেঙ্গল এ বারের আইএসএল-এ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে একেবারে শেষ দিকে। মেগা টুর্নামেন্টে খেলবে কি খেলবে না, তা নিয়ে টালবাহানা চলছিল। স্পনসর পাওয়া যাচ্ছিল না। কথা এগিয়েও পিছিয়ে যেতে হয়। শেষ মুহূর্তে স্পনসর পাওয়ায় আইএসএল-এর পৃথিবীতে ঢুকে পড়ে লাল-হলুদ। দেরিতে ছাড়পত্র পাওয়ায় দল তৈরি করতেও সমস্যায় পড়তে হয়। কারণ ততদিনে ভাল মানের স্বদেশি ফুটবলার অন্য ক্লাবে সই করে ফেলেছেন। অনেকে আবার দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করে বসে রয়েছেন।

দেশীয় প্লেয়ার নির্বাচন একদমই ঠিক হয়নি। যাঁদের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে, তাঁরা এখনও নিজেদের নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মনে হয়েছে, ফুটবল বোধেরও যথেষ্ট অভাব রয়েছে। গত শনিবার নর্থইস্ট ইউনাইটেডের বিরুদ্ধে সুরচন্দ্র সিংহের আত্মঘাতী গোলে পিছিয়ে পড়ে ইস্টবেঙ্গল। তার আগে মুম্বই সিটির বিরুদ্ধে এই সুরচন্দ্রের ভুলেই গোল হজম করে ইস্টবেঙ্গল। গতিতে তাঁকে পিছনে ফেলে হুগো বৌমস গোলের গন্ধ মাখা বল বাড়ান লিফন্দ্রেকে। গোল করতে ভুল করেননি তিনি। ইস্টবেঙ্গলের গোল হজম করার ধরন দেখে লাল-হলুদ মাঝমাঠের প্রাক্তন ব্রিগেডিয়ার মেহতাব হোসেন বলছিলেন, “অনেক দিন আগের একটা ম্যাচের কথা মনে পড়ছে। ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে ইউনাইটেড স্পোর্টসের খেলা ছিল। জোসিমার আমাদের রক্ষণকে তছনছ করে গোল করতে এগিয়ে গিয়েছিল। আমি পিছন থেকে দৌড়ে গিয়ে জোসিমারকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিই। তার জন্য আমাকে কার্ড দেখানো হয়। ইউনাইটেডকে পেনাল্টি দেওয়া হয়। সেই পেনাল্টি মিস করে জোসিমার। তেমনই সুরচন্দ্রও তো বৌমসকে ফাউল করে আটকাতে পারত। তার জন্য হয়তো ওকে কার্ড দেখতে হতো।” গোল হয়তো সে যাত্রায় হতও বা। কিন্তু খেলার কথা কে বলতে পারে!

Advertisement

ইস্টবেঙ্গলের অবস্থা এখন স্কট নেভিলের মতোই।

শুধু সুরচন্দ্র কেন, অন্য দেশীয় ফুটবলাররাও নিজেদের জাত চেনাতে পারেননি এখনও পর্যন্ত। অথচ এই দলে রয়েছেন ভারতীয় ফুটবলে পরিচিত সব মুখ। বলবন্ত সিংহর মতো গোল চেনা স্ট্রাইকার। জাতীয় দলে সুনীল ছেত্রীর পাশে খেলা জেজে। প্রথম বারের আইএসএলে এটিকে-কে চ্যাম্পিয়ন করা মহম্মদ রফিক। মোহনবাগানের আই লিগ জয়ী দলের সদস্য শেহনাজ সিংহ। কিন্তু মাঠে নেমে ‘নো নেটওয়ার্ক’ জোনে সবাই। নিজেদের মধ্যে কোনও বোঝাপড়া নেই। দেখে মনে হচ্ছে কেউ কাউকে চেনেন না। অজস্র মিস পাস হচ্ছে, দানা বাঁধছে না আক্রমণ। প্রতিপক্ষের গোলমুখে লোক তুলে আনতে পারছে না। ম্যাচ যত এগোচ্ছে ততই ক্লান্ত দেখাচ্ছে ফুটবলারদের। ভাল স্ট্রাইকারের অভাব ফাওলারের দলের সমস্যা বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণে। জাক মাঘোমা গতকাল সামান্য নড়াচড়া করলেও নিজের চেনা ফর্মের ধারেকাছে পৌঁছননি। অ্যান্থনি পিলকিংটন জাত চেনালেও সমর্থকদের প্রত্যাশা মেটাতে পারেননি এখনও। তার উপরে টুর্নামেন্ট শুরু হতেই ইস্টবেঙ্গলের সমস্যা বাড়িয়ে দিয়েছে চোট-আঘাত। মুম্বই সিটির বিরুদ্ধে ম্যাচের পাঁচ মিনিটেই চোট পেয়ে উঠে যান ড্যানি ফক্স। ফলে ডিফেন্সকে নেতৃত্ব দেওয়ার কেউ নেই। আর এক বিদেশি স্টপার স্কট নেভিল এ লিগে সাইড ব্যাকে খেলতেন। এখানে তাঁকে করে দেওয়া হয়েছে স্টপার। নেভিলের দুর্বলতা চোখে পড়ছে। গতকাল নর্থইস্টের প্রথম গোলের সময়ে নেভিলের দুর্বলতা আরও প্রকট হয়ে যায়। তিন প্রধানে খেলা ব্রাজিলীয় ফুটবলার ডগলাস দ্য সিলভা বলছিলেন, “ভারতে ব্রিটিশ খেলোয়াড়দের খেলতে অসুবিধা হয়। ১০০ জনের মধ্যে হয়তো ১০ জন ভাল খেলতে পারে। আমার মনে হয়, ইস্টবেঙ্গল বিদেশি নির্বাচনেও ভুল করেছে। রাইট ব্যাকের ফুটবলারকে স্টপারে খেলাচ্ছে। সব দিক থেকেই মনে হচ্ছে পরিকল্পনাহীন।”

লিভারপুল কিংবদন্তি রবি ফাওলার ছেলেদের সঙ্গে টেবল টেনিস খেলেন। এমনকি টিম বাসের ড্রাইভারকেও সেই খেলায় সামিল করেন। উদ্দেশ্য একটাই। একটা সুতোয় বেঁধে ফেলতে চান গোটা দলকে। কিন্তু টিম কম্বিনেশনের দিক থেকে এই ইস্টবেঙ্গল এখনও পর্যন্ত বিশাল একটা শূন্যই পাবে। প্রাক্তন ফুটবলার কৃষ্ণেন্দু রায় বলছিলেন, “আমাদের সময়ে ভাস্করদা (গঙ্গোপাধ্যায়), বাবলুদা (সুব্রত ভট্টাচার্য), মনাদাদের (মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য) সঙ্গে কথাবার্তা বলতাম, আলোচনা হত, গল্প গুজব চলতো। এগুলোর মাধ্যমে একটা বোঝাপড়াও তৈরি হতো। তার প্রতিফলন মাঠে গিয়ে পড়তো। গোয়ার হোটেলে ইস্টবেঙ্গল ফুটবলাররা কী করছেন, তা আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। তবে এই দলটার মধ্যে কোনও বোঝাপড়াই দেখতে পাচ্ছি না। ইস্টবেঙ্গলের খেলা দেখে আমি খুব হতাশ। যে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবকে আমি দেখেছি, এই ক্লাব আমার কাছে সম্পূর্ণ অচেনা। জার্সি পরলে যে ক্লাবের ফুটবলাররা উদ্বুদ্ধ হয়, সে রকম কিছুই দেখলাম না এ বারের লিগে। টানা তিনটি ম্যাচে হারের পরে আমার মনে হচ্ছে, দর্শকদের সামনে যদি এই খেলা তুলে ধরত ইস্টবেঙ্গল, তা হলে কী যে হতো....।” কথা শেষ করতে পারেন না একসময়ের ডাকাবুকো সাইড ব্যাক। চেনা আতঙ্কের ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠায় শিহরিত হন।
টানা হার বাড়ায় চাপ। মেজাজ হারান কোচ, প্লেয়াররা। রবি ফাওলারের মতো কোচও দেশীয় ফুটবলারদের সম্পর্কে আলটপকা মন্তব্য করে বলে ফেলেছেন, “দলের কয়েকজন ভারতীয় ফুটবলারকে দেখে মনে হয়েছে যে তাঁরা কোনও প্রশিক্ষণই পাননি।” যা নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি। কৃষ্ণেন্দু অবশ্য ফাওলারের পাশে দাঁড়িয়ে বলছেন, “এ ব্যাপারে আমি ফাওলারের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। উনি সমস্ত ভারতীয় ফুটবলার প্রসঙ্গে বলেননি। ইস্টবেঙ্গলে যে ভারতীয় ফুটবলাররা রয়েছে, তাদের সম্পর্কেই এমন কড়া কথা বলেছেন ফাওলার। এর মধ্যে আমি কোনও ভুল দেখতে পাচ্ছি না। অনেক বিশেষজ্ঞ অবশ্য ফাওলারকে সমালোচনায় বিদ্ধ করছেন। আমি ওঁর কথার মধ্যে কোনও ভুল খুঁজে পাচ্ছি না।”

গ্রাফিক -শৌভিক দেবনাথ।

এটিকে-মোহনবাগান

দল জিততে শুরু করলে ঢেকে দেয় নেতিবাচক দিক। চোখের সামনে ভেসে ওঠে কেবল ইতিবাচক দিকগুলোই। এটিকে-মোহনবাগানের ক্ষেত্রেও তেমনটাই ঘটছে। যদিও দলের ‘হেডস্যর’ হাবাস নিজে দলের দুর্বলতা খুঁজে পেয়েছেন। আরও একটু সময় চেয়ে নিয়েছেন তিনি। কিন্তু টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই গড়গড়িয়ে চলতে শুরু করেছে হাবাস-রথ। ধারাবাহিকতা দেখানোর পিছনে অবশ্য কারণও রয়েছে। ঐতিহাসিক সংযু্ক্তিকরণের ফলে লাভবান হয়েছে মোহনবাগান। এটিকে-র একটা তৈরি দল আগে থেকেই ছিল। স্পেনীয় কোচের হাত ধরেই গতবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে এটিকে। এ বার হাবাসের হাতে এটিকে-মোহনবাগানের রিমোট কন্ট্রোল। এই দলকে হাতের তালুর মতো চেনেন তিনি। দলের নিউক্লিয়াসটাও ধরে রেখেছেন। মাঠে নেমে সমস্যা হচ্ছে না এটিকে-মোহনবাগানের। যদিও তাদের খেলা দেখে মন ভরছে না। কিন্তু হাবাস-দর্শনটাই অন্যরকম। ৬ গোল দিলেও ৩ পয়েন্ট ঘরে আসবে। ১ গোলে জিতলেও ৩ পয়েন্ট পাওয়া যাবে।

হাবাসের দলের ভারতীয় প্লেয়াররা খুবই ভাল মানের। প্রবীর দাস, প্রণয় হালদার, প্রীতম কোটালরা অনেক দিন ধরেই খেলছেন এটিকে-র জার্সিতে। তাঁদের সঙ্গে সন্দেশ ঝিঙ্গানের অন্তর্ভুক্তি এটিকে-মোহনবাগানের রক্ষণের শক্তি বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণে। সেই কারণেই যে কোনও প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নিশ্ছিদ্র দেখাচ্ছে মোহনবাগান রক্ষণকে। বিদেশি ফুটবলাররা খেলার ভাগ্য নির্ধারণ করে দিলেও, দেশীয় ফুটবলারদের সাপোর্টিং প্লেটাও খুবই দরকারি হয়। এটিকে-মোহনবাগান এই জায়গায় সফল।

রয় কৃষ্ণর সঙ্গে এটিকে-মোহনবাগানও এখন উড়ছে।

এই এটিকে-মোহনবাগানের বেঞ্চ স্ট্রেন্থ খুবই শক্তিশালী। কথায় বলে, দল কতটা শক্তিশালী তা রিজার্ভ বেঞ্চ দেখেই বোঝা যায় । হাবাসের দলের শক্তির জায়গা রিজার্ভ বেঞ্চও। পরিবর্ত হিসেবে ধুরন্ধর কোচ যাঁদের নামাচ্ছেন, তাঁরাও নিজেদের পরিচয় দিচ্ছেন। ইস্টবেঙ্গল ঠিক এই জায়গাতেই ব্যর্থ হচ্ছে। পরিবর্ত হিসেবে নামা ফুটবলাররা ফাওলারকে নির্ভরতা দিতে পারছেন না। হাবাস নিজে স্বীকার করে নিয়েছেন, সক্ষমতার দিক থেকে ১০০ শতাংশ জায়গায় এখনও পৌঁছয়নি তাঁর দল। তবুও তাঁদের জিততে সমস্যা হচ্ছে না। কারণ একটাই। দলে রয়েছেন রয় কৃষ্ণর মতো একজন গোলদাতা। যে কোনও সময়ে ফিজির এই স্ট্রাইকার হাবাসকে এনে দিতে পারেন ৩ পয়েন্ট। ওডিশা এফসি-র বিরুদ্ধেই তো দেখা গেল তা। ৯৪ মিনিটে জ্বলে উঠলেন কৃষ্ণ। এটিকে-মোহনবাগানের এই নির্ভরযোগ্য স্ট্রাইকারকে দেখে কৃষ্ণেন্দুর মনে পড়ে যাচ্ছে চিমা ওকোরির কথা। তিনি বলছিলেন, “চিমা থাকা মানেই আমরা নিশ্চিন্ত থাকতাম। বহু ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারণ করে দিয়েছিল চিমা। রয় কৃষ্ণকে দেখে আমার চিমার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।”
সবে তিনটি করে ম্যাচ খেলেছে কলকাতার দুই ক্লাব। ‘দিল্লি’ এখন ঢের দূর। তবে সকাল দেখে দিন কেমন যাবে অনেকটা তো বোঝা যায়, সবটা না হলেও...

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement